আমার বুনো বাগান বনাম অধুনা পরিবেশ

কোথায় আমার বাগান?
চারদিক সমুদ্র ঘেরা এক দ্বীপ, আয়ারল্যান্ড। কবিরা নাম দিয়েছে ‘Emerald Island’ বা ‘পান্নাদ্বীপ’। আজ থেকে চল্লিশ বৎসর আগে আমি সেথায় বসতি গড়েছি। অপূর্ব শ্যামল এই দেশ! আর মানুষগুলি প্রাণ গেলেও এই সবুজের হানি হতে দেয়নি। খুব জনবিরল দেশ। পাহাড়ে ঘেরা শীলা সমৃদ্ধ ভূমি, প্রচুর বৃষ্টি হয় এবং ইউরোপের অনেক জায়গার তুলনায় ঠান্ডা কম। শহরের কেন্দ্র থেকে একটু বাইরে গেলেই সবুজ আর সবুজ এবং দূরে দূরে সাজানো লোকালয়। বেশ প্রশস্ত আয়তনে লোকজন বসতি নির্মাণ করে। সবুজ বৃক্ষরাশি আর লতা গুল্ম সবকিছু মিলেমিশে একাকার এখানে।
আমার বুনো পরিবেশের বাগান খুব ভাল লাগে। যতটা পেরেছি প্রকৃতিতে যেমন অনেক রকম গাছ, লতা গুল্ম এক সাথে আত্নীয় স্বজনের মত মিলেমিশে থাকে- বন্দে আলী মিয়ার কবিতাতে যেমন,
‘আমগাছ জামগাছ বাঁশ ঝাড় যেন,
মিলে মিশে আছে ওরা আত্মীয় হেন’।
অনুরূপভাবে, আমার বাগানটা গড়ার চেষ্টা করেছি।
ইউরোপিয়ানদের ফিটফাট বাগানঃ
অতীতে ইউরোপিয়ানরা খুব ফিটফাট আর কাটছাঁট (Formal Garden), বিশেষ
করে টোপিয়ারি করা উদ্যানে খুব আগ্রহী ছিল যেমন ছবিতে দেখুন, ড্রোমল্যান্ড ক্যাসেল, এনিস, আয়ারল্যান্ড ও বিডুলফ গ্রেঞ্জ উদ্যান, ইংল্যান্ড। এখন অধুনা যুগে অনেক কিছুর পরিবর্তন এসেছে। এই ধরণের বাগান নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ
প্রচন্ড ব্যয় বহুল হয়ে উঠেছে। সেই সাথে বৃহৎ বাগান ও বাড়ি জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলছে। সে কারণে, বেশির ভাগ মানুষ এখন শহরে কিংবা কান্ট্রিসাইডে ছোট বাগানের এবং অপেক্ষাকৃত ছোট আয়তনের বাড়িতে বাস করতে শুরু করেছে। ছোট এমন বাগান হতে হবে যাতে, নিজেরাই দেখাশোনা করতে পারে। কিন্তু, তেমন ছোট নয় যে মন ভরবে না। তাই শহর থেকে দূরের বাড়িগুলি সর্বনিম্ন আয়তন দেড় বিঘা বা ত্রিশ কাঠা হয়ে থাকে। অতীতে তার চার কি পাঁচ গুন সর্বনিম্ন আয়তনের জায়গা ব্যবহৃত হতো। স্থানীয় আইরিশ জনগণ প্রথাগতভাবে, এপার্টমেন্টে থাকেনা। তাই প্রধান চারটি সিটিতে বিশেষ করে, রাজধানী ডাব্লিন শহরের কেন্দ্র স্থলে এপার্টমেন্ট বিল্ডিং দেখা যায়, যা ছয়তালার বেশি নয়। শহরের বাইরে দোতলা বা আড়াই-তলার অনুমতি রয়েছে। সরকারের সম্পূর্ণ অনুমতি ব্যতিরিকে কোন বাড়িঘর নির্মাণ করা যায়না।
ফিটফাট বাগান রক্ষনাবেক্ষন খরচঃ
এই সব দেশে বাংলাদেশের মত কাজের লোক রাখা একেবারেই অসম্ভব। ফিটফাট আর কাটছাঁট বাগান রাখতে গেলে মালী রাখা দারকার। যেটা দারুণ ব্যয় বহুল এবং প্রায় অসম্ভব হয়ে গেছে। এখানে প্রতি ঘন্টার জন্যে সর্বনিম্ন মজুরি হলো ১২.৫ ইউরো, দিনের আট ঘন্টার জন্যে আসে প্রায় নয় হাজার টাকা। কাজেই এই বিলাসিতা বিল গেইটস, কুইন এলিজাবেথদের মত মহামানবরাই বহন করতে পারে। আমাদের মতন আমজনতা এসমস্ত একেবারেই চিন্তা করতে পারে না। বছরে বিরাট কিছু, আওতার বাইরে কাজের জন্যে দু’তিন দিন লোক ভাড়া করতেই পকেটে টান পড়ে। এদেশে শারীরিক পরিশ্রমের প্রচন্ড দাম। মনে করেন, ঝড়ে গাছ পড়ে গেছে, সেটা কেটে নিয়ে যাওয়ার জন্যে লোক পাওয়া যায় বটে! কিন্তু, একটা গাছ কাটতে অনেক সময় প্রায় পঞ্চাশ থেকে ষাট হাজার টাকা লেগে যায়, যদিও তারা এই কাঠ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে বা বিক্রয় করে।
কাটছাঁট বাগান থেকে পরিবেশের ক্ষতি কিভাবে হয়?
অতিরিক্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন অর্থাৎ আগাছা বর্জিত কাটছাঁট বাগান রাখতে গিয়ে প্রচুর পরিমাণে বিষ ব্যবহার করতে হয়। তাতে বিরাট সমস্যা সৃষ্টি করে, আগাছা মারার জন্যে ব্যবহৃত হয় আগাছা নাশক বা উইড কিলার। এগুলি বেশির ভাগ হরমোন ভিত্তিক যৌগিক বা কম্পাউন্ড। যা কিনা, পাতা দিয়ে শোষিত হয়, আগাছা হিসেবে যেগুলি পরিচিত তাতে স্প্রে করলে মরে যায়। প্রস্তুতকারকরা দাবি করে, এই বিষ মাটিতে গিয়ে বিষাক্ত আর থাকেনা। কিন্তু, এই কথা আদৌ সত্য নয়! মাটিতে শোষিত হয়ে ধীরে ধীরে মাটিকে বন্ধা করে দেয়। অর্থাৎ, বীজ মাটিতে পড়লে কি পুঁতলেও, অঙ্কুরোদগম হয়না। এভাবে অনেক প্রজাতি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বিষাক্ত মাটি থেকে পানি চুয়ে চুয়ে অন্যান্য গাছের গোড়ায় চলে যায়। তাতে, সে গাছের ফুলের মধুতে বিষ উৎপন্ন হয়, যা মধুপেয়রা পান করে মৃত্যু বরণ করে। তার উপর, এই চোয়া পানি জলাধারে চলে যাবার সম্ভাবনাও খুব বেশি। এক জায়গায় দিনের-পর-দিন এক ধরনের হরমোন ব্যবহার করলে, সে বিষ আর কাজ করে না। তাছাড়া, এ সব বিষের দ্রবণ বাষ্পীভবনের কারণে বাতাস দূষিত হতে পারে যা, সব স্তরের জীবনের শ্বসন ক্রিয়ার জন্যে হানিকর।
কীট ও ছত্রাক বিনাশক দ্বারা স্প্রে করা গাছের ফুল ও ফলে বিষাক্ততা এসে যায়। সে সব গাছের ফুলের মধু খেয়ে মধুপেয়রা মৃত্যু বরণ করে। অন্যদিকে ফল, শস্য আর সবজি খেয়ে মানুষের মধ্যে নানারকম অসুস্থার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই সব বিষাক্ত স্প্রে দরকারি ফাঙ্গাস ও কীট ধবংস করে ফেলে। এইভাবে মৌমাছি, অন্যান্য মধুপেয়, দরকারি কীট ও ফাংগাস চিরতরে বিলীন হয়ে যেতে পারে। আমরা সবাই জানি, পৃথিবীতে মৌমাছির সংখ্যা অনেক কমে এসেছে। তার থেকে একটা ভয়ানক পরিণতি দাঁড়াতে পারে ভবিষ্যতে, সেটা সম্বন্ধেও আমরা অবশ্যই ওয়াকিবহাল! মানুষের বেঁচে থাকার বিশুদ্ধ পরিবেশতো নষ্ট হয়েই গেছে তার উপর আসবে খাদ্য ঘাটতি এবং তরান্বিত হয়ে আসবে মানব জাতি কেন, প্রাণী জগতেরও বিনাশ। আমি বেশি বাড়িয়ে বলছিনা!
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পদক্ষেপঃ
এই সমস্ত দিক বিবেচনা করে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এ বিষয়ে খুব বিরাট পদক্ষেপ নিয়েছে। এখন ইউরোপে, সমস্ত হরমোন ভিত্তিক ও অনেক রকম কড়া বিষ উৎপাদন ও ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। গরমকালে, ঘাসসহ যে সমস্ত উদ্ভিদ রাস্তার ধারে জন্মায় তা কেটে ফেলা বা বিষে মেরে ফেলা নিষিদ্ধ। এই সব উদ্ভিদ নিয়ে আসে বুনো ফুলের মেলা যেমন, ডেইজি, বাটারকাপ, মার্গারিট, লিকনিস, হানিসাকেল, আইপোমিয়া এমনি হাজার ধরণের একটার পর একটা ফুটতেই
থাকে, শীত না আসা পর্যন্ত। আর সাধারণ ডেইজি! সারা বছর ফোটে মাঠে, ঘাটে। তাছাড়া, রাস্তার ধারে জন্মায় কত রকম বৃক্ষ এবং এদের ফুলের ও ফলের সমাহার ও সুবাস বছরের বিভিন্ন সময়ে সৌন্দর্যের উৎসব ডেকে আনে, ছবিতে দেখুন আইরিশ কান্ট্রি রোড ও মাঠ ভর্তি বাটার কাপ ফুল।
এখন ইউরোপের বাজারে আগাছা মারার কড়া বিষ জনসাধারণের প্রাপ্তব্য নয়। জনসাধারণ শুধু সরকার অনুমোদিত হালকা ধরণের বিষ কিনতে পারে। যার মূল্য এখন খুব বেড়ে গেছে। আগেকার মত কড়া বিষ বাজারে একেবারেই আসেনা। শুধুমাত্র বড় বড় কৃষক যাদের লাইসেন্স আছে, তারা কৃষি ভিত্তিক দোকান থেকে কিনতে পারে কৃষি খামারে ব্যবহারের জন্যে।
পরিবেশ বান্ধব আগাছা আর কীট নাশকঃ
আজকাল গার্হস্থ্য উদ্যানের জন্যে ভিনিগারের ব্যবহার আগাছা নাশক হিসাবে আর কীটনাশক হিসেবে তরলীকৃত ওয়াসিং-আপ দ্রবন, লেবুপানি ও রসুন রসের হালকা দ্রবণের ব্যবহার বেড়ে গেছে। পরিবেশ রক্ষার্থে আরেকটি সমাধানঃ
সব উদ্ভিদের আমন্ত্রন!
হোক অবাঞ্ছিত ঘাস,
ভুলে যাওয়া বুনো ফুল
কি ফলের গাছ, এসো সবাই!
মিতা হয়ে বাগানে, বাগানে।
উপভোগ করি, ভরাই নয়নে-
তোমাদের সৌন্দর্য মহিমা।
আমার বাগানের সাত মিশেলি গাছের সমাহার দেখুন।
ধীরে ধীরে বড় বড় পার্ক, অফিস, বানিজ্য পার্ক, শিক্ষা কেন্দ্র ইত্যাদি ধরণের প্রতিষ্ঠানের বড় বড় বাগান এখন প্রাকৃতিকভাবে নির্মাণ করার প্রবণতা এসে গেছে। সেখানে ঘাস ও তথাকথিত আগাছেকে ফুলের গাছের সঙ্গে সংযোগ করা হয়। সবুজ ঘাস মরে গেলে বা বেশ বড় হয়ে উঠলে টেনে তুলে ফেলা হয়। আগে এসব মারার জন্যে বিষ ব্যবহার প্রচলিত ছিল। টোপিয়ারি করা বাগান প্রায় বিলীন হয়ে যাচ্ছে। শুধুমাত্র, বড় বড় হোটেল, রাজপ্রাসাদ কিংবা খুব ধনী লোকের বাড়ি ছাড়া এ সমস্ত আর দেখা যায় না।
আমার বাগান
আমি বুনো ফুল খুব পছন্দ করি। খুব ফিটফাট আর কাটছাঁট, বিশেষ করে টোপিয়ারি করা উদ্যানে খুব আগ্রহী কখনই ছিলাম না। আমার বাগানটা প্রায় বত্রিশ বছর আগে তৈরি এবং বড় আকারের। প্রথম থেকেই বাগানে প্রচুর বুনো ফুলের প্রবর্তন করেছি। কোথাও সোজা আকারের ফুলের বেড নেই। কোথাও সারি করা এক ধরণের গাছ বা ফুল নেই, ছবিতে আমার বাগান দেখুন।
ফরমাল ফুলের বেড ও আকার ঠিক রাখতে গেলে, কাজ বেশি বাড়ে। আমার বাগানে সব জড়িয়ে জাপ্টিয়ে একসাথে বাস করে। যেখানে আমিই মালি আর আমিই কবিতা লিখি তাদের নিয়ে...
আমার বাগানে নেই কোন,
সরল রেখার কাঠখোট্টা জ্যমিতি।
রয়েছে আঁকা বাঁকা রেখা,
গোলাকার চত্বর, কিংবা কলকি!
আগাছা, সুগাছা বন্ধু হেথা,
ভালবেসে গড়েছে শ্যামল এক পল্লী-
তোমাদের থেকে বহুদূরে,
বন পাহাড়ি দেশ তার আকাশ নীলাম্বরী।
আমার মন অত খুঁতখুঁতে নয় - আগাছা কোথায় কি জন্মাচ্ছে তা নিয়ে? আমাদের কাজ হলো লন কাটা, পথকে ঘাস ও আগাছা বিহীন রাখা, অতিরিক্ত বাড়ন্ত ডাল কেটে ছেঁটে রাখা, কয়েকটি কনিফার (ঝাউ গাছ) আকারে ঠিক রাখা, জল সিঞ্চন, বছরে দু’বার সার প্রয়োগ, পোকা আর ফাংগাস আক্রমণের দিকে খেয়াল করা। আর শীতের দেশে অনেক বাড়তি কাজ রয়েছে, গাছপালা বাঁচিয়ে রাখার জন্যে... সে সব আজ থাক।
বিস্তর পরিশ্রম! খেয়াল রাখি, যেন সব বুনো ফুল খুব বেশি বীজ ছড়ায়। ফুল শেষ হয়ে গেলেই ছড়াটি কেটে ফেলি। যাতে করে, বীজ ছড়িয়ে বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে পুরো বাগানটাই না দখল করে ফেলে। আয়ারল্যান্ডের এত বুনোফুল রয়েছে এবং এত সুন্দর, এক একটি দেখতে! আমার বাগান ভরা এ সমস্ত বুনোফুল রয়েছে। আমার বুনো বাগানের আরও তিনটি ছবি দেখুন।
সূত্র:সম্পূর্ণ নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে রচিত।
তিন থেকে ছয় পর্যন্ত সব ছবি নিজ বাগানের লিমেরিক, আয়ারল্যান্ডে অবস্থিত।
এমএসএম / এমএসএম

ফেসবুক ছিল বিনোদনের জায়গা, এখন আয়ের মূল উৎস

তোমাদের মৃত্যুর দায় আমরা এড়াতে পারি না

সুফি ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভাবাদর্শ প্রতিষ্ঠার ১ যুগ পার করল সুফি স্পিরিচুয়াল ফাউন্ডেশন

ব্যতিক্রমী ধারার আলো নেভার পথে

টেকসই কৃষির জন্য চাই জৈব বালাইনাশক

ঈদযাত্রা হোক দুর্ঘটনামুক্ত

রমজানে ভ্রমণে যে বিষয় মেনে চলা জরুরি

সুস্থ থাকার জন্য কেমন পানির ফিল্টার নির্বাচন করবেন

সাপের ক্ষিদে মেটাতে পাখিশূন্য দ্বীপ

একদিনের ট্যুরেই ঘুরে আসুন চীনামাটির পাহাড়ে

আধ্যাত্মিকর যাত্রা পথে সুফি মেডিটেশন এর গুরুত্ব

খাজা ওসমান ফারুকীর কুরআন দর্শন
