পরিবেশ নিয়ে আরো কাজ করতে চাই : তানজীলা
তানজীলা আহমেদ বাঁধন, বাড়ি কুষ্টিয়া জেলা শহরে। বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা। ছিলেন ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি, মা গৃহিণী। এক ভাই এক বোন, ভাই-ভাবি ডেনমার্কে বসবাস করছেন। কুষ্টিয়া সরকারি মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সমাপ্ত করে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ থেকে (IUB) পরিবেশ বিজ্ঞানে অনার্স এবং মাস্টার্স করেন। পরিবেশ বিজ্ঞান নিয়ে পড়াকালীন ২০১৬ সালে পরিবেশ এবং সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। ২০১৬ সাল জলবায়ু পরিবর্তন এবং নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে প্রথমে কাজ শুরু করেন তিনি।
গ্রামে অনেকটা সময় থাকার কারণে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন গ্রামের নারীরা পারিবারিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। তারা অনেকটা পিছিয়ে। সেটা উপলদ্ধি করে উদ্দেশ্য ছিল নারীর ক্ষমতায়নকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। অন্যদিকে এটাও বুঝতে পারেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গ্রামের নারীদের যেন ভোগান্তির শেষ নেই। একজন পুরুষ কখনই বাসায় সর্বক্ষণ সময় দিতে পারে না। একজন মা অর্থাৎ একজন নারীর পক্ষে সম্ভব একটা পরিবারকে সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা। আর সেজন্যই তানজীলার প্রথম কাজ ছিল ২০১৬ সালে গ্রামীণ নারীভিত্তিক কিছু কার্যক্রম চালু করা, যাতে পুরুষদের অনুপস্থিতিতে পরিবারের জন্য ভালো সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণে নিজেদের সক্ষম করে তুলতে পারে।
২০১৬ সালের শেষদিকে আইইউবি ইউনিভার্সিটিতে জ্যাকেল কনজারভেশন নিয়ে কাজ করেন। ক্রমেই জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে গ্রামাঞ্চলে মানুষ বন-জঙ্গল কেটে ঘর তৈরি করছে, যে কারণে জঙ্গলে প্রাণী তার বসবাসযোগ্য বাসস্থান হারাচ্ছে। আমাদের দেশের শিয়াল ঠিক এমনই একটা প্রাণী, যারা বসবাসযোগ্য বাসস্থান হারাচ্ছে। তাই শিয়াল হঠাৎই মানুষের পরিবেশে ঢুকে হাঁস-মুরগি খেয়ে ফেলেছে। এ কারণে মানুষ শিয়ালগুলোকে হত্যা করছে। আমরা জানি, যে কোনো প্রাণী পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখে।
তানজীলার একটা দল বরিশালের বাকেরগঞ্জ গ্রামে ওখানকার জনগণের মাঝে কী করলে শিয়াল এবং অন্যান্য প্রাণীর বসবাসযোগ্য স্থান থাকবে এবং গ্রামবাসীদেরও ক্ষতি হবে না; এ ধরনের একটি বিশ্লেষণে অংশ প্রকাশ করে। দলটি এনালাইসিস করার পর একটি সিদ্ধান্তে আসে, যদি কিছু জায়গা ছেড়ে দেয় বন্যপ্রাণীদের বাসস্থান করার জন্য তাহলে বন্যপ্রাণী বাঁচতে পারবে, পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা পাবে। ২০১৭ সালের প্রথম দিকে তানজীলা 'পাইথন' ও 'টাইটেল' কনজারভেশনের ট্রেনিং নিতে যান। সেখানে অজগর এবং কচ্ছপ কিভাবে তাদের লাইফস্টাইল বিলং করে সেটা জানার জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
২০১৮ সালে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (IUB) ক্যাম্পাসে রিভার কনজারভেশন ক্লাব এক্টরের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। সেখানে মাত্র ১০ জন মেম্বার নিয়ে কাজ শুরু করেন। তিন বছরের মাথায় প্রায় ৩০০ জন মেম্বারে রূপান্তরিত হয়। এই ক্লাব থেকে বড় একটা প্রজেক্ট ছিল 'বালুনদী প্লাস্টিক ফ্রি'। প্রজেক্টটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তানজীলার নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। প্লাস্টিক ফ্রি এবং বালুনদীর দূষণমুক্ত রক্ষার্থে তারা বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।
দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক অনেক ইন্টারভিউ নেয়ার পর তারা একটি সিদ্ধান্তে আসেন, বালু নদীতে কোনো ডাস্টবিন নেই। তখন তারা তাদের ক্লাবের পক্ষ থেকে বালু নদীর চারপাশে ডাস্টবিন দেয়ার ব্যবস্থা করেন পানিদূষণ কমানোর জন্য। তখন এই পরিকল্পনা যথেষ্টভাবে প্রচার হয় জাতীয় এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তানজীলা পরিবেশবান্ধবের পাশাপাশি বৃদ্ধাশ্রমে অসহায় মানুষের মাঝে নিজেকে উপস্থিত করে তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনছেন। ভবিষ্যতে এসব বৃদ্ধাশ্রমে যারা আছেন তাদের নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা রয়েছে তার।
ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের অধ্যাপক ড. চৌধুরী কামরুল হাসান বলেন, তানজীলা একজন নিবেদিতপ্রাণ এবং কঠোর পরিশ্রমী। সে এখন নতুন প্রজন্মের পরিবেশ বিষয়ক গবেষক ও কর্মী। সে তার জ্ঞান এবং শ্রম পরিবেশের উন্নয়নের জন্য অতিবাহিত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তার প্রশংসনীয় কাজের মধ্যে অন্যতম ছিল নারীর ক্ষমতায়ন এবং তাদের পরিবেশ এবং অর্থনৈতিক কাজে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে উদ্বুদ্ধ করা। তার মধ্যে অসাধারণ নেতৃত্বদানের গুণাবলী আছে এবং সে রিভার কনজারভেশন ক্লাবের সভাপতি হয়ে তিন বছর অসাধারণ নেতৃত্ব দিয়ে চোখে পড়ার মতো সাফল্য বয়ে আনে। তার আরো বড় সাফল্য ছিল ‘বালুনদী প্লাস্টিক ফ্রি’ প্রজেক্টে। আমি তার শিক্ষক হিসেবে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, সে একজন অত্যধিক প্রতিভাধর ব্যক্তি এবং বাংলাদেশের উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম।
রিভার ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আজিজ বলেন, তানজীলার একজন শিক্ষক এবং পরামর্শদাতা হিসেবে যতটুকু জেনেছি, সে অত্যন্ত বাধ্য এবং নম্র স্বভাবের। একই সাথে সে প্রচণ্ড রকমের উৎসাহী, বিশেষ করে পরিবেশের উন্নয়নমূলক বিষয়ে। তানজীলার যথেষ্ট সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশকর্মীদের কাজের জায়গার সুব্যবস্থা করার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে। আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশের উন্নয়নমূলক কাজে সে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারবে।
তানজীলা এখন বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের সাথে ভ্যোলেনটারিজম ট্যুরিজম ঢাকা ডিভিশনের কো-অর্ডিনেটর হিসেবে কাজ করছেন এবং ভবিষ্যতে পরিবেশ নিয়ে কাজ করার জন্য নিজের একটা প্রতিষ্ঠান খোলার চিন্তা করছেন। ওই প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য হবে পরিবেশ, নারী, শিশু ও পুরুষ উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করা। দুঃখজনক হলেও এটাই সত্য যে, আমাদের দেশে পরিবেশ বিষয়ক গবেষক এবং কর্মীদের উন্নয়নমূলক কাজ করার মতো জায়গা নেই। তানজীলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, এমন একটা প্লাটফ্রম তৈরি করা যেখানে পরিবেশ বিষয়ক গবেষক এবং কর্মীদের পরিবেশের উন্নয়নের জন্য কাজ করার একটা পথ তৈরি করা।
এমএসএম / জামান