ঢাকা বৃহষ্পতিবার, ২৬ জুন, ২০২৫

বিকল্প বাজারজাত না করে পলিথিন নিষিদ্ধ বাস্তবায়নের অন্তরায় হতে পারে


জিয়াউদ্দিন লিটন photo জিয়াউদ্দিন লিটন
প্রকাশিত: ৪-১১-২০২৪ দুপুর ১:৩৮

বাংলাদেশের প্লাস্টিকের ব্যবহার বেড়েই চলেছে। ২০০৫ সাল থেকে শুরু করে ২০২০ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে বার্ষিক মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার বেড়েছে তিন গুণ।  বাংলাদেশে প্লাস্টিক দ্রব্যাদির বাজার  ১বিলিয়ন ডলারের। সরকারি হিসাব অনুযায়ী প্লাস্টিক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ৪   হাজার। এর বাইরেও অনুমতি ছাড়া প্লাস্টিক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে বেশ কয়েক   হাজার।  প্লাস্টিক এবং পলিথিন এখন সাগরের তলদেশ থেকে শুরু করে মাউন্ট এভারেস্টের চূড়া  পর্যন্ত বিস্তৃত। সারা বিশ্বের প্রতি মিনিটে প্লাস্টিকের বোতল বিক্রি হয় প্রায় পাঁচ লাখ। এই কারণে  পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পলিথিন বিশ্বজুড়ে যখন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তখন ২০২৪ সালের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্যোগে বাংলাদেশের নতুন করে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার আবারও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে  এটি একটি ভালো উদ্যোগ। 

পলিথিনের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি অনেক। চোখ জ্বালা করা, শ্বাসকষ্ট, লিভারের সমস্যা, ক্যান্সার, চর্মরোগ থেকে শুরু করে অনেক মারাত্মক রোগের জন্য পলিথিন দায়ী। আমরা বাজারে গেলে পলিথিনে করেই সব কিছু নিয়ে আসি। এমনকি বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যও। অথচ পলিথিনে মোড়ানো এসব খাবারই খাদ্যে বিষক্রিয়ার জন্য দায়ী। মাছ-মাংস পলিথিন ছাড়া আমরা রাখি না। কিন্তু পলিথিনে মাছ-মাংস প্যাকিং করলে অবায়বীয় ব্যাকটেরিয়ার জন্ম হয়। প্লাস্টিকের বর্জ্য মাইক্রো ও ন্যানো কণা রূপে মানুষের শরীরে ঢুকে হরমোনজনিত নানা সমস্যা সৃষ্টি করছে। এটি মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের নানা রোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুক্রাণু ও ডিম্বাণু উৎপাদন ব্যাহত করছে। ক্যান্সারসহ ত্বকের নানা রকম রোগ সৃষ্টি করছে। সম্প্রতি এক গবেষণায় জানা গেছে, পৃথিবীর ৮৫ শতাংশ কলের পানিতে মাইক্রোপ্লাস্টিক রয়েছে, যেখান থেকে প্রতি মাসে ২১ গ্রাম এবং বছরে ২৫০ গ্রাম এই প্লাস্টিক মানুষের শরীরে ঢুকে গুরুতর ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফথেলেটস, বিসফেনোন, অর্গানোটিনস, পার ও পরি ফ্লোরোঅ্যালকাইল, বিসফেনল এ প্রভৃতি রাসায়নিক উপাদান প্লাস্টিকে থাকে, যা স্থূলতা, গর্ভধারণের ক্ষমতা হ্রাস, বিভিন্ন স্নায়ুরোগ ঘটাতে পারে। প্লাস্টিক জনস্বাস্থ্যের জন্যই হুমকি নয় শুধু। এটি পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব সৃষ্টি করছে। পলিথিনে, বিশেষ করে রঙিন পলিথিনে থাকে সিসা ও ক্যাডমিয়াম, যা চর্মরোগের জন্য দায়ী। অথচ এই পলিথিন ছাড়া আমরা যেন অচল।

বাংলাদেশ বিশ্বের প্রথম দেশ যে দেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো ২০০২ সালে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকারের সময় (২০০১-২০০৬) তৎকালীন পরিবেশ মন্ত্রী শাহজাহান সিরাজ বাজার গুলো পলিথিন মুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ২২ বছর আগে শুরু করা শাজাহান সিরাজের  উদ্যোগ অনেক দিন টিকে ছিল সাফল্যের সঙ্গে। ২০১০ সালে প্লাস্টিকের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ন্যাশনাল থ্রি আর নীতি চালু করে। ন্যাশনাল থ্রি আর অর্থ হলো রিডিউস, রিইউজ  ও রিসাইকল। প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধে ২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার জুট প্যাকেজিং আইন পাস করে।  ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের শুরুর দিকে পলিথিন ব্যবসায়ীরা বাজারে ঢুকতে না পারলেও পরে ধীরে ধীরে সরকারের শিথিল নীতির কারণে পলিথিনের সয়লাভ হয়ে ওঠে বাজার।

সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিবেশ বন ও জলবাইয়ু উপদেষ্টা  সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান  দায়িত্ব নেওয়ার পর প্লাস্টিক পলিথিন ব্যবহার বন্ধে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন। এরই মধ্যে ১    অক্টোবর থেকে সুপার শপ এ পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং ১ নভেম্বর থেকে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বাজারে পলিথিনের ব্যবহার। পানিতে বর্জ্যের ৭০ শতাংশ পলিথিন ব্যাগ। এ  কারণে ২০২০ সাল থেকে ইউরোপের দেশগুলোতে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করার আইন করছে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট। ইউরোপে বছরে ১০০ বিলিয়ন পলিথিন ব্যাগ ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে    ২০০২ সালে পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হলেও সর্বত্র এটিই ব্যবহার করা হচ্ছে। ঢাকা শহরে  এক একটি পরিবার দিনে গড়ে  চারটি করে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে। শুধু ঢাকায় প্রতিদিন এক  কোটি ৪০ লাখ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করা হয়। সে হিসেবে সারাদেশে কোটি কোটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করা হচ্ছে প্রতিদিন। 

একটি গবেষণার তথ্য মতে দোকানে ব্যবহৃত প্লাস্টিক ২০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। কোমল পানীয়তে ব্যবহৃত প্লাস্টিক ৫০ বছর আর বোতল হিসেবে ব্যবহৃত প্লাস্টিক ৭৫০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। বাংলাদেশের প্রতিদিন ৩০০০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়। বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে ঢাকায় প্রতিদিন ৬৪৬ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়। ঢাকার মোট প্লাস্টিক বর্জ্যের ৩৭.২%  পুন:ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশে উৎপাদিত প্লাস্টিক বর্জ্যের ৬০% মেশে রাস্তাঘাট আর নদীতে।  সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দেওয়া  তথ্য মতে আমাদের দেশের প্রতি বছর ৮ লাখ ২১ হাজার ২৫০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য হয়। এর মাত্র ৪০ শতাংশ পুনর্ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ ২ লাখ ২৮ হাজার টন পুনরায় ব্যবহার করা হয় বাকি অংশ পরিবেশেই থেকে যায়।

বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৭২ টি দেশ পলিথিন এর ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। সব দেশেই পলিথিনের ব্যবহার বন্ধের শাস্তির বিধান করলেও ব্যবহার বন্ধ করা যায়নি। কেনিয়া  সরকার কারো হাতে  পলিথিন দেখলে গ্রেফতার করার বিধান জারি করেছিল। আয়ারল্যান্ড সরকার পলিথিন ব্যবহার কমাতে বাড়তি কর আরোপ করেছে। পর্তুগাল, স্পেন এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। উগান্ডার   বিমানবন্দরে পলিথিনসহ কাউকে পেলে তাকে গ্রেপ্তার করার বিধান রাখা হয়েছিল কিন্তু পলিথিনের   বিকল্প জানা না থাকায় এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যায়নি। সুতরাং বাংলাদেশে পলিথিনের   ব্যাগ নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি পলিথিনের বিকল্প বাজারজাত করা অত্যাবশ্যকীয়। তা না করতে  পারলে সরকারের এই পরিকল্পনা নিঃসন্দেহে ব্যর্থ হবে। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পলিথিন ব্যাগ ওয়ান টাইম ইউজ প্লাস্টিক বাজার থেকে তুলে দিতে হলে বিকল্প উৎসগুলো সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য করতে হবে। পাট বাংলাদেশের অর্থকরী ফসল। পাট ও পাটজাত পণ্য শুধু পরিবেশবান্ধব এবং সহজে পচনশীলই নয় এটি পরিবেশে রাখে বিরাট অবদান। দেশে বর্তমানে ৮ লাখ হেক্টর এর উপরে পাট ও পাট জাতীয় ফসলের চাষাবাদ হয়। পাটের তৈরি ব্যাগ বাজারজাত নিশ্চিত করা যেতে  পারে। পলিথিন নির্ভরতার বড় কারণ তা সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য। সহজলভ্যতা  রোধ করতে হলে পলিথিন উৎপাদনকারী কারখানা গুলো বন্ধ করতে হবে। এক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ঋণের মাধ্যমে স্বল্প পুঁজির ছোট ছোট ব্যাগ উদ্যোক্তা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। আর এ উদ্যোগ নিলে বিপুল সংখ্যক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরি হবে এবং বেকারদের জন্য কর্মসংস্থান হবে। এর মধ্য  দিয়ে কাগজের ব্যাগ, চটের ব্যাগ কম দামে ক্রেতাদের হাতে পৌঁছানো নিশ্চিত করতে হবে। পলিথিন এর বিকল্প হিসেবে কাগজ, কাপড় ও চটের ব্যাগের ব্যবহার বাড়াতে হবে। এর জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে মনোযোগ দিতে হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ঋণ দিয়ে উদ্যোক্তা তৈরি করা সম্ভব। এর মাধ্যমে বাজারে পলিথিনের যোগান বন্ধ হবে এবং কাপড়, কাগজ ও চটের ব্যাগের ব্যবহারের চাহিদা বাড়বে। আর এমনটি নিশ্চিত করতে পারলে নিঃসন্দেহে অনেকেই উদ্যোক্ত হতে এগিয়ে আসবেন।

লেখকঃ শিক্ষক, সাংবাদিক এবং কলামিস্ট 

এমএসএম / এমএসএম

মার্কেটিং বিক্রি বাড়ায়, যোগাযোগ ব্র্যান্ড তৈরি করে

নির্বাচনী ব্যবস্থায় গণমাধ্যম নীতিমালার প্রস্তাবিত সংস্কার ও গণমানুষের প্রত্যাশা

বাংলাদেশ সংবিধানের আলোচিত ৭০ অনুচ্ছেদ প্রেক্ষিতঃ রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যমত

শতাব্দির সেরা মাটির সৈনিক কৃষক যোদ্ধা

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট ও জনগণের প্রত্যাশা

ট্রাম্প-সালমান কথোপকথনে বিশ্ব কী বার্তা পেল

এফবিসিসিআইর ডিজিটাল রূপান্তর : ব্যবসায়িক নেতাদের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল সেবা

জাতীয় ঐকমত্য কঠিন হলেও উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ

রাজনৈতিক অঙ্গনে এক অনন্য উচ্চতায় তারেক জিয়া

কেমিক্যাল আতঙ্ক নয়, চাই বিজ্ঞানসম্মত আমচাষ ও প্রশাসনিক সচেতনতা

শুভ অক্ষয় তৃতীয়া: দানে ধ্যানে অনন্তকালের পূণ্যলাভ

শিক্ষা উপকরণের ব্যবহার ও গুরুত্ব, বাংলাদেশ প্রেক্ষিত

ইসরায়েলের বর্বরোচিত যুদ্ধের অবসান হোক