কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে, গ্রাম-বাংলার মাছ ধরার ঐতিহ্য
শরতের পর হেমন্তের রোদেলা দুপুরে খাল-বিলের পানি কমে গেলে হাঁটু কাদা পানিতে মাছ ধরা গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য। বহু বছর ধরে সারা দেশের ন্যায় নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় এ ধারা চলে আসলেও চিরায়ত সে দৃশ্য এখন অনেকটাই কমে গেছে।
কালের বিবর্তনে ব্যস্ত জীবনে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম-বাংলায় খাল-বিল, ক্ষেত-খলার পানি বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে শুকিয়ে মাছ ধরার দৃশ্য। বর্ষায় গ্রাম বাংলার নিচু জমি, খাল-বিল, ডোবা-নালা পানিতে ডুবে যেতো আবার হেমন্তের শুরুতে পানি নেমে যাওয়ার পর গ্রামের মানুষ সেখানের বিভিন্ন পদ্ধতি (সেচ পাম্প/কৃত্রিম পদ্ধতি) ব্যবহার করে পানি শুকিয়ে মাছ ধরতেন। সেই সময়ের মাছ ধরার দৃশ্য এখন আর সচরাচর চোখে পড়ে না।
একসময় খাল-বিল, পুকুর-ডোবা আর ক্ষেত-খলা শুকিয়ে এলে গামলা বা তাগাড়ি দিয়ে চলে সামান্য পানি সেচার কাজ। আর পুকুর-ডোবার পানি সেচা হয় পাম্প মেশিন দিয়ে। পানি শুকিয়ে যাওয়ার পর চলে মাছ ধরার উৎসব। এসময় মাছ ধরার উৎসবে আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠতেন গ্রামের মানুষ। রীতিমতো আনন্দ উল্লাস করে লোকজন পুকুর-ডোবা, খাল-বিলের শূন্য পানির কাদার ভিতরে হাত ঢুকিয়ে তুলে আনে একের পর এক মাছ। সেচ দেয়া পুকুরে চাষ করা মাছের পাশাপাশি পাওয়া যায় দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন রকমের মাছ। আর ক্ষেত-খলা ও ডোবায় মেলে শোল, টাকি, পুঁটি, খলসে, কৈ, মাগুর, শিং, ট্যাংরাসহ বিভিন্ন দেশিয় প্রজাতির মাছ।
সরেজমিনে কাদায় মাছ ধরার দৃশ্য দেখা মিলল বারহাট্টা উপজেলা সদরসহ কয়েকটি এলাকার খাল-বিল ও খেত-খলায়। তাও তুলনামূলক ভাবে খুবই কম।
উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ও মাছ শিকারীদের সাথে কথা বললে তারা জানান, ভাদ্র মাসের তীব্র গরম আর রোদের তেজে নদ-নদীর, খাল-বিলের পানি কমে যাবার সাথে সাথে শুকিয়ে যেতে থাকে ডুবে থাকা খেত-খলা। পানি শুকিয়ে যাওয়ার এসব স্থানে আটকা পড়ে নানা রকমের দেশীয় মাছ। আর সে সময়ে বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে পানি সম্পুর্ন শুকিয়ে কাদা পানিতে নেমে হাত দিয়ে মাছ শিকার করি আমরা একদল মাছ শিকারী।
স্থানীয়রা জানান, প্রতি বছর বর্ষাকাল শেষ হলে পানি কমে গেলে এই এলাকার নিচু জমিগুলোতে এমন মাছ ধরার উৎসব চলতো। সেই উৎসবে মাছ ধরায় মেতে উঠতো নারী-পুরুষ, ছেলে-বুড়ো সবাই। কাদা পানিতে নেমে কে কতো বেশি মাছ ধরতে পারে, এই নিয়ে চলে প্রতিযোগীতা।
তারা আরও জানান, আগে এমন করে নানা জাতের দেশীয় মাছ প্রচুর ধরা গেলেও, এখন আর সেদিন নেই। নেই মাছের সে প্রাচুর্য। প্রতিনিয়ত মাছের অভয়ারণ্য কমে যাওয়ায় আগের মতো জমে ওঠেনা মাছ ধরার উৎসব। দেশীয় মাছের উৎসগুলো ক্রমেই যেন হারিয়ে যাচ্ছে।
সাহতা এলাকার ৭০ বছর বয়সী যতীন্দ্র চন্দ্র দাস আক্ষেপ করে বললেন, 'দিন শেষে খাল-বিল থেকে মাছ নিয়ে বাড়ি ফেরার দৃশ্য এখন তেমন চোখে পড়েনা। আমাদের সময়ে মাছ খাওয়ার চাহিদা মিটিয়েও মাছ শুকিয়ে শুটকি সংরক্ষণ করতাম। পাঁচ মিশালী মাছের রান্নার ঘ্রাণ পাড়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়তো। কিন্তু বর্তমানে এখন আর আগের মতো ছড়িয়ে পড়েনা।'
বাউসী অর্দ্ধচন্দ্র উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক আব্দুল মোমেন বিশ্বাস বলেন, কথায় আছে- 'মাছে-ভাতে বাঙালি।' কিন্তু দিনে দিনে কমছে নদী-খাল-জলাশয়। ভরাট করা হচ্ছে, বিভিন্ন প্রজাতি ছোট-বড় মাছের অভায়ারণ্য। যে সব নদী বা খাল রয়েছে তাও আবার বিভিন্ন বিষাক্ত বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে! ফলে দেশি প্রজাতির মাছ এখন বিলুপ্ত পথে।
তিনি আরও বলেন, মাছ শিকারীরা বর্তমানে নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল ব্যবহার করে রেনু পোনাসহ ছোট -বড় সব মাছ শিকার করে ফেলে। এইসব কারণে আমাদের এলাকার নদী, খাল-বিলের মাছ কমে যাচ্ছে। কারেন্ট জাল ব্যবহারের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
বারহাট্টা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো: কামরুল হাসান জানান, কারেন্ট জাল, হাতে টানা ঘন কারেন্ট জাল ব্যবহার রোধসহ জমিতে কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার কমাতে পারলে অন্তত বর্ষা মৌসুমে দেশি মাছগুলো বংশ বিস্তার করতে পারবে। আমাদের মৎস্য অফিসের পক্ষ থেকে প্রতি বর্ষায় কারেন্ট জালসহ অন্যান্য নিষিদ্ধ জালের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়।
T.A.S / T.A.S