পার্বত্যাঞ্চলে অবৈধ ইটভাটা সচল রাখতে ভয়াবহ জালিয়াতি
রাঙামাটিসহ পার্বত্য তিন জেলায় অবৈধভাবে চালু থাকা ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে গেলে সাম্প্রতিক সময়ে স্থানীয় প্রশাসনসহ গণমাধ্যমকর্মীদেরকে হাইকোর্টের রায় দেখিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টিকারী অবৈধ ইটভাটা মালিকরা এবার ভয়াবহ জালিয়াতির সাথে জড়িত এমন তথ্য উঠে এসেছে। সংশ্লিষ্ট্য সূত্রে জানাগেছে, এই জালিয়াত চক্রের সদস্যদের মধ্যে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, লংগদু, রাজস্থলী, কাউখালীসহ খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের অবৈধ ইটভাটা মালিকরা সম্পৃক্ত রয়েছে। উচ্চ আদালতের আদেশ জালিয়াতির এ ঘটনায় বিস্মিত করেছে আইনজীবিসহ সচেতনমহলকে।
তিন পার্বত্য জেলার অন্তত ২৬ জন ইটভাটা মালিকের বিরুদ্ধে হাইকোর্টের রায় পাল্টে দেওয়ার মতো ভয়াবহ জালিয়াতির অভিযোগ উঠে এসেছে। বুধবার বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আসলে এই ঘটনার সাথে জড়িত সকলের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করতে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ। বিষয়টি প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেছেন সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরসেদ।
তিনি জানান, ইটভাটার কার্যক্রম চালু করতে হাইকোর্টে আবেদন করেছিলেন খাগড়াছড়ির কয়েকজন ইটভাটা মালিক। আদালত পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসনকে পরিবেশগত ছাড়পত্র পেতে তাদের (ইটভাটা মালিক) দেওয়া আবেদন নিস্পত্তি করার আদেশ দেয়। তবে, হাইকোর্টে এ আদেশকে পাল্টে দিয়ে নেওয়া হয়েছে জালিয়াতির আশ্রয়।
আদালত ইটভাটায় উৎপাদন চলমান রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন- এমন আদেশ তৈরি করে ইটভাটা চালু রাখতে চেয়েছিলেন মালিকরা।
এমনকি জাল করা আদেশে মামলা সংশ্লিষ্ট নয় এমন বহিরাগত ব্যক্তিদেরকেও করা হয় বাদী। পাল্টানো হয় আদেশের তারিখ। তবে, শেষ রক্ষা হয়নি। জালিয়াতির এ ঘটনা ধরা পড়েছে হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চে।
বুধবার (১১ ডিসেম্বর) বিচারপতি ফাতেমা নজিব ও বিচারপতি শিকদার মাহমুদুর রাজীর হাইকোর্ট বেঞ্চ এক আদেশে এ জালিয়াতিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করতে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে নির্দেশ দিয়েছেন। উচ্চ আদালতের আদেশ জালিয়াতির এ ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা।
এদিকে, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী নূর মুহাম্মদ আজমী জানিয়েছেন, হাইকোর্ট আবেদন নিস্পত্তিসহ রুল দিয়েছিলেন। কিন্তু রিট পিটিশনাররা হাইকোর্টের আদেশকে বিকৃত করে জাল আদেশ তৈরি করে। হাইকোর্ট তার আদেশে ইটভাটার উৎপাদন চালুর বিষয়ে কোনো নির্দেশনা না দিলেও তারা উৎপাদন কার্যক্রম চালু রাখার আদেশ তৈরি করে। এমনকি রিট মামলায় সংশ্লিষ্ট নন এমন ব্যক্তিদেরও জাল করা আদেশে বাদী করা হয়েছে। একটিতে অতিরিক্ত বাদী করা হয়েছে ৯ জনকে। অন্যটিতে অতিরিক্ত বাদী করা হয়েছে ১০ জনকে।
তিনি বলেন, ‘এখানে দুইভাবে জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। হাইকোর্ট ইটভাটার চালুর কোনো আদেশ না দেওয়ার পরেও জাল আদেশ তৈরি করা হয়েছে। অন্যদিকে রিট মামলা সংশ্লিষ্ট নন এমন ব্যক্তিদেরকে বাদী করা হয়েছে। এমন জালিয়াতিকে সহজভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। হাইকোর্ট বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে এ জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলার নির্দেশ দিয়েছেন।’
সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের তথ্যানুসারে, তিন পার্বত্য জেলায় (রাঙামাটি,খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান) অবৈধ ইটভাটার কার্যক্রম বন্ধ করতে ২০২২ এর জানুয়ারিতে হাইকোর্টে রিট আবেদন করে পরিবেশ ও মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি)। একই বছরের ২৫ জানুয়ারি হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ প্রদত্ত আদেশে তিন পার্বত্য জেলায় অবৈধ ইটভাটার কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দিয়ে নির্দেশনা বাস্তবায়নে অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়। ৎ
রিটকারী আইনজীবী সিনিয়র অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে ইটভাটার মালিকেরা আপিল বিভাগে গেলে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় আংশিক সংশোধন করে রায় বহাল রাখে। এর ধারাবাহিকতায় অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিলের অংশ হিসেবে তিনি সম্প্রতি খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। জেলা প্রশাসন থেকে জানানো হয়, ইটভাটার কার্যক্রম চালু রাখা সংক্রান্ত একটি আদেশ তারা পেয়েছেন।
সিনিয়র আইনজীবি অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, আদেশটি সংগ্রহ করার পর দেখা যায়, ইটভাটার কার্যক্রম চলমান রাখতে গত ২ ডিসেম্বর আদেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ হলে ৯ই ডিসেম্বর সোমবার হাইকোর্টের নজরে আনা হয়। আদালত নথি ঘেটে দেখেন যে, এ ধরনের কোনো আদেশ তারা দেননি। তারা ইটভাটার মালিকদের আবেদনটি নিস্পত্তি করতে পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের তথ্যমতে, ইটভাটার কার্যক্রম চালু করতে সম্প্রতি হাইকোর্টে দুটি পৃথক রিট আবেদন করা হয়। যার নম্বর ১৪৩৬২/ ২৪ ও ১৪৩৬৩/ ২৪। এতে ১৬ জন করে দুটিতে ৩২ জন বাদী হন। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ২৬ নভেম্বর বিচারপতি ফাতেমা নজিবের নেতৃত্বে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ সংশ্লিষ্ট বিবাদীদের উদ্দেশ্যে রুলসহ অন্তবতীকালীন আদেশ দেয়।
আদেশে পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে রিট আবেদনকারীদের পরিবেশগত ছাড়পত্র পেতে করা আবেদন ৬০ দিনের মধ্যে নিস্পত্তির নির্দেশ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে রিট আবেদনকারীদের লাইসেন্স ও পরিবেশগত ছাড়পত্র না দেওয়া কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, ইটভাটা চালু করতে ইটভাটা মালিকদের আবেদন নিস্পত্তি করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে তিন সপ্তাহের রুল দেয় হাইকোর্ট।
পরিবেশ ও বন সচিব, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক, পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের পরিচালক, খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে তিন সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। দুটি রিট আবেদনে অভিন্ন আদেশ হয়। হাইকোর্টের এই আদেশের অনুলিপি প্রকাশ হয় গত ১ ডিসেম্বর। কিন্তু জাল করা আদেশে তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ২ ডিসেম্বর।
রিট আবেদনকারীদের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেয়া আইনজীবী সজল মল্লিক বলেন, ‘২৬ নভেম্বর আদেশের পর ১ ডিসেম্বর হাইকোর্টের আদেশের অনুলিপি সংগ্রহ করে রিটকারীদের দিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু পরবর্তীতে তারা (রিটকারী) ২ ডিসেম্বর তারিখ উল্লেখ করে আদেশ টেম্পারিং করেছে। বিষয়টি আমি ৮ ডিসেম্বর জানতে পেরে আদালতকে অবহিত করেছি। আদেশ জালিয়াতির বিষয়টি নিয়ে কীভাবে কি হয়েছে তা নিয়ে আমার ধারণা নেই।’
T.A.S / T.A.S