ঈদ সামনে রেখে জাল নোট তৈরির কারিগর ব্যস্ত

আসন্ন ঈদ সামনে রেখে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশেই জাল টাকা প্রস্তুতকারী, বিনিময়সহ বাজারজাতকারী চক্র মাঠে। চক্রের সদস্য ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে এসব জাল টাকার নোট ছড়িয়ে দিচ্ছে সাধারণ মানুষের হাতে। আর এই টাকা হাতে পেয়ে অনেক মানুষ প্রতারিত হচ্ছে।
সূত্র জানায়, প্রতারচক্রের নায়ক হচ্ছেন লিয়াকত হোসেন জাকির ওরফে মাজার জাকির। তিনি এক সময় মিরপুর শাহআলী মাজারসহ বিভিন্ন মাজারে পড়ে থাকতে বিধায় তার নাম হয়েছে মাজার জাকির। এই জাকির শুধু জাল নোট তৈরি কিংবা বিক্রির সঙ্গেই জড়িত নয়, জাল নোট তৈরির প্রযুক্তিও বিক্রি করে আসছিলেন লিয়াকত হোসেন জাকির ওরফে মাজার জাকির। আবার জাল নোট তৈরির কারিগরদের কাছে তিনি ‘গুরু জাকির’ নামে পরিচিত। গত ২৫ বছর ধরে এই কাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন তিনি। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা পুলিশের হাতে একাধিকবার গ্রেফতারও হয়েছেন। চতুর জাকির পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্ধী থাকা অবস্থায় অনেক অপরাধীকে তিনি জাল টাকা তৈরীর প্রযুক্তি শিক্ষা দিয়েছেন। ফলে তিনি কারাগার থেকে জামিনে বের হলে তারা একত্রে পুনরায় জাল টাকা তৈরীর কাজে লিপ্ত হতেন।
অপর দিকে রাজধানীর ওয়ারী এলাকায় অভিযান চালিয়ে সাড়ে ৩৮ লাখ টাকার দেশি জাল নোট ও ৭৭ হাজার ১০০ ভারতীয় রুপির জাল নোটসহ জালনোট তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করেছে গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। এসময় জাল নোট চক্রের দুই সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতাররা হলেন মো. সাইদুর রহমান (৩২) ও মো. মেহেদী হাসান (২৫)।
পুলিশ জানায়, ঈদ সামনে রেখে বিপুল পরিমাণ জাল নোট তৈরি করে বাজারে ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন গ্রেফতারকৃতরা। গত রোববার দিবাগত রাত সাড়ে ৩টার দিকে রাজধানীর ওয়ারী থানার আর কে মিশন রোডের একটি ভবনের ষষ্ঠ তলায় অভিযান চালায় ডিবি-উত্তরা বিভাগের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও মাদক নিয়ন্ত্রণ টিম। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তারা জানতে পারেন যে,-একটি চক্র ঈদ সামনে রেখে বিপুল পরিমাণ জাল নোট তৈরি করে বাজারে ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালালে পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে পালানোর চেষ্টা করে জাল নোট কারবারি সাইদুর ও মেহেদী। তাৎক্ষণিক অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়। এসময় চক্রের আরেক সদস্য পালিয়ে যান। আর গ্রেফতার দুজন দীর্ঘদিন ধরে জাল নোট তৈরি করে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করছিলেন। আসন্ন ঈদ কেন্দ্র করে তারা বিপুল পরিমাণ জাল নোট মজুত করেছিলেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেন। এ ঘটনায় গ্রেফতার দুজনসহ পলাতক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ওয়ারী থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করা হয়েছে। আইনগত প্রক্রিয়া চলমান বলে জানিয়েছে পুলিশ।
সূত্র জানায়, জাল টাকার কারিগররা শুধু তৈরী করেন। আর তা দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দিচ্ছে এজেন্টদের মাধ্যমে। আর এজেন্টরা দেশের সরকারী বেসরকারি ব্যাংকের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কর্মচারীদের সহায়তায় তার সাধারণ মানুষের হাতে পৌছে দিচ্ছে। গত ৩ মার্চ সোমবার সকালে রাজশাহীর বাগমারা উপজেলায় সোনালী ব্যাংকের ভবানীগঞ্জ শাখার ভেতরে খাদিজা নামের একজন গ্রাহক জাল টাকা দিয়ে আসল টাকা নিয়েছে প্রতারকচক্রের সদস্যরা। ভুক্তভোগী খাদিজা বেগম (৪৫) একই উপজেলার চানপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। ঈদ ও রোজার কেনাকাটা জন্য ৬৮ হাজার টাকা উত্তোলন করেন। টাকাগুলো তিনি জমিয়ে রেখেছিলেন। এ ঘটনায় বিকালে বাগমারা থানায় জিডি করেছেন খাদিজা।
তিনি গণমাধ্যমে বলেছেন, সোনালী ব্যাংকে নিজের জমানো অর্থ তুলতে আসেন ব্যাংকে। কাউন্টারে চেক জমা দিলে তাকে টাকা দেওয়া হয়। এ সময় পেছন থেকে এক ব্যক্তি বলেন, আমি ব্যাংকের লোক। আপনাকে যে টাকাগুলো দেওয়া হয়েছে, সেগুলো জাল। আমাকে দেন, আমি পাল্টে দিচ্ছি’ তিনি সরল বিশ্বাসে টাকাগুলো ওই ব্যক্তির হাতে দেন। পরে খাদিজার ৬৮ হাজার টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যান ওই ব্যক্তি।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ঘটনার দিন সকালে ব্যাংকের ওই শাখায় টাকা উত্তোলনের জন্য আসেন খাদিজা। নিজের জমানো ৬৮ হাজার টাকা একটি চেকের মাধ্যমে তুলতে চান। এজন্য চেকটি নারী গ্রাহকদের বুথে জমা দেন। এ সময় তার পেছনে পরিপাটি অবস্থায় তিন ব্যক্তি ছিলেন। ব্যাংক থেকে টাকা বুঝে পাওয়ার পর ওই তিন ব্যক্তি তার কাছাকাছি আসেন। এদের একজন নিজেকে ব্যাংকের লোক হিসেবে পরিচয় দিয়ে জানান, ভুলক্রমে তাকে জাল টাকা দেওয়া হয়েছে। সেগুলো পাল্টে আসল নোট দেওয়ার আশ্বাসে টাকাগুলো ওই নারীর কাছ থেকে নেন তারা। পাশের কাউন্টারে যাওয়ার কথা বলে কৌশলে ব্যাংকের ভেতর থেকে দ্রুত সটকে পড়েন তারা। পরে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ও স্বজনদের বিষয়টি জানানো হয়। ব্যাংকের সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করে তিন ব্যক্তিকে শনাক্ত এবং টাকা উদ্ধারের চেষ্টা চালানো হয়। তবে তাদের শনাক্ত করতে না পেরে বিকালে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন তিনি।
খাদিজা বেগম জানিয়েছেন, প্রতারক নিজেকে ব্যাংকের লোক পরিচয় দেওয়াতে বিশ্বাস হয়েছে। ব্যাংকের ভেতরে এ রকম হবে, তা ভাবতেও পারেননি। তিনি টাকা উদ্ধারসহ প্রতারকদের গ্রেফতারের দাবি জানান। আর ব্যাংকের ব্যবস্থাপক আনোয়ার হোসেন বলেছেন, ‘সিসিটিভি ফুটেজ দেখে মনে হয়েছে, প্রতারকরা আগে থেকেই ওই নারীকে অনুসরণ করেছে। সুযোগ বুঝে টাকা নিয়ে সটকে পড়েছে। ভুক্তভোগী গ্রাহককে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ব্যাংক তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করবে।
আর গত বছরের জুন মাসে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী দনিয়া ও কদমতলী এলাকায় অভিযান চালিয়ে ডিএমপির লালবাগ গোয়েন্দা বিভাগ জাল টাকার কারিগরসহ ৩জনকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতার ব্যক্তিরা হলেন লিয়াকত হোসেন জাকির ওরফে মাজার জাকির, তার চার নারী সহযোগী লিমা আক্তার রিনা, সাজেদা আক্তার, রোমানা ইসলাম ও মমতাজ বেগম। তাদের বিরুদ্ধে কদমতলী থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা হয়।
ডিবি সূত্র জানায়, যাত্রাবাড়ীর দনিয়া ও কদমতলী এলাকার দুটি বাসায় অভিযান চালিয়ে তাদের করা হয়। আর প্রায় সোয়া এক কোটি জাল টাকা এবং আরও প্রায় তিন কোটি জাল নোট তৈরির সরঞ্জাম জব্দ করা হয়েছে। দুটি বাসায় দীর্ঘদিন ধরে জাল নোট তৈরি করা হতো। চক্রটি কম্পিউটারে গ্রাফিকস ও ফটোশপের মাধ্যমে জাল নোটে নিরাপত্তা সুতা, ওয়াটার মার্ক ও কালার শিফটিং কোয়ালিটি সবকিছু নিখুঁতভাবে করে। সাধারণ চোখে তাঁদের তৈরি জাল নোট নকল মনে হয় না। তবে বেশিক্ষণ নাড়াচাড়া করে দেখলে বা মেশিনে ধরলে এটি ধরা পড়ে। জাল নোট তৈরির সময় সহযোগী বা অন্য কেউ কারখানায় ধরা পড়লে জাকির মাজারে মাজারে অবস্থাান করে। তখন মাজারের কর্মী হয়ে ঘুরে বেড়ান। এ জন্য তাঁকে মাজার জাকির বলা হয়।
বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় জাল নোটের ছোট ছোট ঘরোয়া কারখানা স্থাপনকারীরা জাকিরের কাছ থেকে কারিগর, সফটকপি, পরামর্শ এমনকি মডেল জাল টাকা ও রুপি নেয়। নতুন অপরাধীদের কাছে জাকির প্রযুক্তি বিক্রি করে। এ জন্য এই অপরাধীদের কাছে জাকির ‘গুরু জাকির’ হিসেবেও পরিচিত। গত ২৫ বছর ধরে জাল নোটের খুচরা ও পাইকারি ব্যবসা করার পাশাপাশি বিভিন্ন মানের জাল নোট ও জাল রুপি তৈরিতে অত্যন্ত দক্ষ লিয়াকত হোসেন জাকির। ২০১২ সাল থেকে ৫০০ ও ১০০০ টাকার জালনো ট তৈরি করলেও বর্তমানে মানুষ যাতে সন্দেহ না করে, সে জন্য বড় নোট জাল করার পাশাপাশি ১০০ টাকা, ২০০ টাকার নোটও জাল করে থাকেন।
এর আগে ২০১৩, ২০১৮ ও ২০২০ সালে জাকিরকে অন্তত ছয়বার গ্রেফতার করা হন। তবে তিনি সংশোধন হননি। জামিনে বেরিয়ে পুরোনো অপরাধে জড়ান। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ এড়াতে তিনি খুলনা ও বাগেরহাটের বিলাসবহুল এলাকায় বাসাভাড়া নিয়ে সিসি ক্যামেরায় নজরদারি করে বাসার ভেতরে জাল নোট তৈরি ও বিক্রি করার কাজ করে আসছিলেন।
বাগেরহাট ও খুলনা এলাকা থেকে উত্তরাঞ্চলের জাল নোটের কারবারিরা টাকা নিতে ঝুঁকি হওয়ায় যাত্রাবাড়ীর দনিয়ায় লিমা আক্তার রিনার বাসায় একটি অস্থয়ী কারখানা গড়ে তোলেন তিনি। সেখান থেকেই ঈদে জাল নোট সরবরাহ করার কথা ছিল। আগে জাল নোটের একটি এক লাখ টাকার বান্ডিল ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে কাগজ, ল্যাপটপ, কম্পিউটারের কালি ও আনুষঙ্গিক উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রতিটি ১০০০ টাকার এক লাখের একটি বান্ডিল ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করতেন জাকির। তিনি বিভিন্ন এলাকায় জাল নোট পাইকারি বিক্রি করতেন। পুরুষ–নারী মিলে তাঁর প্রায় ১৫–২০ জন কর্মচারী রয়েছে। তাঁদের তিনি দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা বেতন দিতেন। অনলাইনে জাল নোটের অর্ডার নিতেন জাকির। এরপর কুরিয়ারের মাধ্যমে পৌঁছে দিতেন। রাজশাহীর বাগমারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তৌহিদুল ইসলাম ব্যাংক থেকে জাল টাকা দিয়ে আসল টাকা নেওয়ার ঘটনায় থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন।
এমএসএম / এমএসএম

প্রধান প্রকৌশলীর পিএস মুজিবরের মাসিক অবৈধ আয় লাখ টাকা!

অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ সামাদ ভূঁইয়া দম্পতি বিরুদ্ধে

যাদের কথা হয়না বলা

অভাবির পেটের ভাড়া ৩০ হাজার টাকা

ফ্যাসিস্ট সরকারে প্রতাপশালী জেলার মাহবুবের লাপাত্তা

অবৈধ সম্পদের পাহাড় নিয়ে ওসমান গণির রাম রাজত্ব কায়েম

মিরপুরের ত্রাস তানজিব গ্রেফতার, জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য

১৭ বছর পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তা আমিনুল

বিতর্কিত প্রধান শিক্ষিকা নার্গিস আক্তারের বিরুদ্ধে আবারো তদন্ত কমিটি গঠন

প্রিমিয়ার গ্রুপের ইকবাল গেছে পালিয়ে, দুর্নীতির দুর্গ আছে দাঁড়িয়ে

অর্থ শাখায় চাকরি করেই শত কোটি টাকার মালিক মাহবুবুর রহমান

ঈদ সামনে রেখে জাল নোট তৈরির কারিগর ব্যস্ত
