প্রকৃতি থেকে বিলুপ্তির পথে চিরবিরহী পাখি 'ডাহুক'

আবহমান বাংলার প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের মোহনীয় রূপ আমাদের মুগ্ধ করলেও এ সৌন্দর্য বর্ধনের বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে নানা প্রজাতির পাখি। গ্রাম-বাংলার মানুষের কাছে অতি পরিচিত পাখি ডাহুক। আমাদের দেশে যে ক’টি পাখি ডাকের জন্য বিখ্যাত তাদের মধ্যে অন্যতম পাখি ডাহুক। একসময়ে দেশের খাল-বিল, নদী-নালা, জলাভূমি ও পতিত দীঘির পাশের ঝোপঝাড়ে ডাহুকের 'কোয়াক'..'কোয়াক'.. কলরব শোনা যেতো। কিন্তু কালের বিবর্তন আর মানুষের অসচেতনতার কারণে আজ বিলুপ্তির পথে দৃষ্টিনন্দন এ পাখি।

'ডাহুক তার গলার ভেতর রাত্রিকে খানিক খেলিয়ে, খানিক বাজাতে বাজাতে নিজের ভেতর স্থির হয়। ডাহুক গহনতায় ডুব দিতে থাকে ক্রমাগত; ডাহুকের পালকগুলো রাত্রি হয়ে ওঠে। রাত্রিময়তা রাত্রিকে স্পর্শ করে ডাহুককন্ঠে।' নাগরিক কবি খ্যাত বাংলার অন্যতম আধুনিক কবি শামসুর রহমানের 'মেঘলোকে মনোজ নিবাস' কাব্যগ্রন্থের 'ডাহুক' কবিতার পুরো অংশ জুড়েই বর্ণনা করেছেন জলচর এই পাখিটির মায়ার ডালি। আবার ডাহুকী নিয়ে প্রকৃতি, লুকানো জীবনে প্রাণবন্ত রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'ঝরা পলক' এর 'ডাহুকী' কবিতায় লিখেছেন- 'মালঞ্চে পুষ্পিত লতা অবনতমুখী, নিদাঘের রৌদ্রতাপে একা সে ডাহুকী; বিজন- তরুর শাখে ডাকে ধীরে ধীরে; বনচ্ছায়া-অন্তরালে তরল তিমিরে!' ডাহুক নামটি সুন্দর হওয়ায় অসংখ্য লেখকের গান, গল্প, কবিতা ও নাটকে বহুবার উঠে এসেছে এই পাখির নাম। বর্ষা মৌসুমে কচুরিপানায়, ঝোপঝাড়ে বসে উঁচু স্বরে 'কোয়াক'.. 'কোয়াক'.. ডাকে চারপাশ আন্দোলিত হয়। রাত যতো গভীর হয়, নিঝুম হয় ততো ডাহুকের ডাকাডাকি  বেড়ে যায়। ডাহুকের ডাক শোনা যায় বহুদূর থেকে।সরেজমিনে উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে ও এলাকাবাসীর সাথে কথা বললে তারা জানান, একসময়ে পুকুর, খাল-বিল, নদী-নালা ও জলাভূমির ঝোপঝাড়ে ডাহুক পাখির দেখা মিলতো। আগে বর্ষা ও শরৎ কালে বাড়ির আঙিনায় খাবারের খোঁজে হাঁস-মুরগির পাশাপাশি ঘুরে বেড়াতো ডাহুক পাখি। কিন্তু এখন পাখিটি তেমন আর চোখে পড়ে না।

তারা বলেন, টিনের চালে রিম-ঝিম বৃষ্টির শব্দ আর শাপলার বিলে ডাহুকের 'কোয়াক'.. 'কোয়াক'.. ডাক। এ যেন গ্রামবাংলার বর্ষার চিরন্তন রূপ। বর্ষা মৌসুমে কচুরিপানায়, ঝোপঝাড়ে বসে উচ্চ স্বরে 'কোয়াক'.. 'কোয়াক'.. করে ডাকে। এই পাখিদের ডাকাডাকিতে চারপাশ আন্দোলিত হয়। রাত যতই গভীর, নিঝুম হয় ততই এদের ডাকাডাকি আরও বেড়ে যায়। সেই ডাক শোনা যায় বহুদূর থেকেই। কিন্তু বর্তমানে ক্রমেই প্রকৃতির এই সুন্দর রূপ ধ্বংস হচ্ছে। কৃষিজমিতে অতিমাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগ, বন-জঙ্গল উজাড়, খাদ্য সংকট, প্রজনন কালীন সময়ে শিকারিদের অবাধে শিকার। এসব নানা কারণে এখন হারিয়ে যাওয়ার পথে ডাহুক পাখি।

বারহাট্টা সরকারি ডিগ্রি কলেজের জীববিজ্ঞান বিষয়ের অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র প্রভাষক মজিবুল হকের সাথে কথা বললে তিনি বলেন, ডাহুকের ইংরেজি নাম- White breasted Waterhen, বৈজ্ঞানিক নাম- Amaurornis phoenicurus এবং Rallidae গোত্রের অন্তর্গত পাখি। এরা গড়ে ৩২ সেন্টিমিটার পর্যন্ত দীর্ঘ হয়। পাখিটি স্ত্রী ও পুরুষের আকৃতি দেখতে প্রায় অবিকল হয়ে থাকে। এরা একা একা বা জোড়ায় জোড়ায় থাকে। এ পাখির কপাল ধবধবে সাদা, মাথা চাঁদের মতো, ঘাড়, পিঠ, ডানা ও লেজের উপরিভাগ কালো। আর গলা, বুক, চিবুক ও দুই চোখই সাদা। পেট ও লেজের তলার রঙ খয়েরি। ডানার নিচে, বুকের দু'পাশ কালো। ঠোঁট হলদে ও লাল, পা হলদে। লম্বা পায়ের আঙুলগুলো ধারালো।

তিনি জানান, বর্ষা ঋতুতে এদের বংশ বিস্তার ঘটে। জুন থেকে সেপ্টেম্বর এদের প্রজননকাল। এরা ৬ থেকে ৭টি ডিম পাড়ে। ডিমের রং ফিকে হলুদ বা গোলাপি মেশানো সাদা। ডাহুক-ডাহুকি মিলেই ডিমে তা দেয়। বাচ্চার রং সব সময় হয় কালো। গোপন লুকোনো ডিম ফোটে প্রায় ২০ থেকে ২৪ দিনে। আর ২৪-৩০ ঘণ্টা পরই বাচ্চারা বাসা ছাড়ে। মাস তিনেক পরে বাচ্চারা আলাদা জীবন বেছে নেয়। প্রজননের সময় একটি পুরুষ ডাহুক অন্য একটি পুরুষ ডাহুককে সহ্য করতে পারে না। দেখলেই তারা মারামারি করে। এই পাখি লড়াকু প্রকৃতিরও। ডাহুক পাখির প্রিয় খাদ্য জলজ পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গ। এছাড়াও শাপলা-পদ্ম ফুলের নরম অংশ, কচি পানিফল, জলজ শেওলা, লতাগুল্মের নরম অংশ, ধান, কাউন, ডাল, সরিষা, শামুক, কেঁচো, জোঁক, মাছ, ছোট মাছ, শাকসবজি ও ফল খেয়ে থাকে। পাখিটি বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখা যায়।

বারহাট্টা প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফেরদৌস আহমেদ বলেন, গ্রাম-বাংলার মানুষের কাছে অতি পরিচিত পাখি ডাহুক। ডাহুক কচুরি পাতার ফাঁক দিয়ে লম্বা লম্বা পায়ে পানির ওপর চলাফেরা করতে করতে খাবার সংগ্রহ করে। মাঝারি আকৃতির জলের পাখি ডাহুক। খুব সতর্ক পাখি ও আত্মগোপনে পারদর্শী। পল্লী গাঁয়ের ঝোপঝাড়ে রাতের আঁধারে 'কোয়াক'.. 'কোয়াক'.. ডাক শুনে সহজেই টের পাওয়া যায় পাখিটির উপস্থিতি।

তিনি আরও বলেন, প্রয়াত সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ ডাহুক পাখির ডাককে লালন ফকিরের গানের সাথে তুলনা করেছেন। ডাহুক পাখি পোষ মানে। তাই শিকারীরা এই অনুগত পোষা পাখিটি দিয়ে বুনো ডাহুক শিকার করে। নানা কারণে প্রকৃতি থেকে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে পরিবেশবান্ধব এ প্রজাতির পাখি। পাখির বিলুপ্তি ঘটায় জীব বৈচিত্রের সংকট যেমন বাড়ছে, তেমনি আমরা হারিয়ে ফেলছি সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ। প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় পাখির ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাই কেবল আমাদের সচেতনতা ও সহনশীলতাই রক্ষা করতে পারে পাখির স্বাভাবিক বেঁচে থাকা।

কথা হয় একসময়ের উপজেলার কয়েকটি গ্রামের ডাহুক পাখি শিকারীদের সাথে তারা বলেন, একসময়ে প্রতিদিন নিজের পালিত ডাহুক দিয়ে ফাঁদ পেতে ৩-৪ জোড়া ডাহুক শিকার করে বাজারে বিক্রি করে সংসার চালাতাম। বর্তমানে ডাহুক পাখির সংখ্যা কমে যাওয়ায় এখন আর ফাঁদে তেমন ডাহুক ধরা পড়ে না তাই এ পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশা বেছে নিয়েছি।

এ বিষয়ে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোঃ সিরাজুল ইসলাম বলেন, আবহমান গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী সুন্দর পাখিগুলো আজ বিলুপ্তির পথে। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক মিশ্রিত খাবার খেয়ে পাখির সংখ্যা ও ডিম পাড়ার পরিমাণ কমে যাওয়া, ঝোপ-ঝাড় ও গাছপালা কেটে ফেলায় নিরাপদ আবাসস্থলের অভাব, নির্বিচারে শিকার করাসহ বিভিন্ন কারণে ডাহুক পাখি বর্তমানে বিলুপ্ত হতে চলেছে। এ পাখি রক্ষা করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। এ জন্য প্রশাসনের পাশাপাশি সবাইকে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে।