হারিয়ে যাচ্ছে হাতের ফোঁড়নে গড়া নকশী কাঁথার ঐতিহ্য

একসময়ে গ্রাম-বাংলার খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের পরিবারের গৃহবধূ ও কিশোরীদের সুনিপুণ হাতের ছোঁয়ায় নতুন অথবা পুরোনো জীর্ণ কাপড় দিয়ে মনের মাধুরী মেশানো অনুভুতিতে তৈরি করা হতো গ্রামীণ নকশী কাঁথা। এই কাঁথায় সুচ আর সুতা দিয়ে তাদের মনের মাধুরি মিশিয়ে ফুটিয়ে তোলা হতো নানা রঙের নকশা। সুচের ফোঁড়ে স্বপ্ন বুনন, পল্লী নারীদের উপার্জন প্রাচীন ঐতিহ্য গ্রামীণ নকশী কাঁথা। কালের বিবর্তন ও আধুনিকতার স্পর্শে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ নকশী কাঁথা।
'বহুদিন পরে গাঁয়ের লোকেরা গভীর রাতের কালে, শুনিল কে যেন বাজাইছে বাঁশি বেদনার তালে তালে। প্রভাতে সকলে আসিয়া দেখিল সেই কবরের গায়; রোগ পান্ডুর একটি বিদেশী মরিয়া রয়েছে হায়। সারা গায়ে তার জরায়ে রয়েছে সেই নক্সী কাঁথা, আজও গাঁর লোকে বাঁশী বাজাইয়া গায় এ করুণ গাথা।' পল্লীকবি জসীম উদ্দিনেরঅনবদ্য আখ্যানকাব্য 'নকশী কাঁথার মাঠ' কাব্যগ্রন্থের পুরো অংশ জুড়েই বর্ণনা করেছেন গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের সাথে মিশে থাকা প্রাচীন শিল্পকলার নিদর্শন। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় ও যান্ত্রিক সভ্যতার ভীড়ে হারিয়ে যাচ্ছে হাতের ফোঁড়নে গড়া এই নকশী কাঁথার ঐতিহ্য। একসময়ে পল্লী গাঁয়ের প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরেই তৈরি করা হতো নকশী কাঁথা। তখনকার সময়ে দৈনিন্দন সাংসারিক কাজ সেরে খাওয়ার পর ক্লান্ত দুপুরে নারীরা ঘরের মেঝে, বারান্দা বা গাছের ছায়ায় মাদুর বিছিয়ে সুচ আর নানা রঙের সুতা নিয়ে বসে যেতো বাহারি নকশী কাঁথা সেলাইয়ে। কোন প্রশিক্ষণ ছাড়াই গ্রামের মেয়ে, বউ, ঝি একত্রিত হয়ে মনের আনন্দে কাঁথায় নকশা ফুটিয়ে তুলতো। সুচের প্রতিটি ফোঁড়ে যেন তৈরি হয় এক একটি না বলা কথা, কতশত ইতিহাস আর গল্প।
সরেজমিনে বারহাট্টা উপজেলার সদরসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম ঘুরে ও বয়ষ্কদের সাথে কথা বললে তারা বলেন, একসময়ে গ্রাম-গঞ্জের হাট-বাজার ও শহরের পাড়া-মহল্লার ওলিতে-গলিতে নানি-দাদি, খালা-ফুফু ও বধু-কন্যাদের হাতে তৈরি নানা রকমের ফুল-ফল, পশু-পাখি, গাছ-পালা ও প্রকৃতির ডিজাইনে গড়া নকশী কাঁথা বিক্রি হতো। শীত মৌসুমে ব্যাবসায়ীরা সাইকেলের পিছনে বেঁধে অথবা ভার বয়ে সারাদিন ঘুরে ঘুরে বিক্রি করতেন সেই নকশী কাঁথা। শুধু তাই নয়, একটা সময় এই হস্তশিল্প দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে ব্যাপক সুনাম কুড়িয়েছিল। অথচ এখন বড় বড় কারখানায় তৈরীকৃত দেশি-বিদেশী রঙ-বেরঙের রেডিমেইড কাঁথা-কম্বলের ভীড়ে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের গ্রাম-বাংলার এই দেশীয় শিল্পটি।
উপজেলা সদরের কাশবন গ্রামের নকশী কাঁথা কারিগর নমিতা সিংহ, অর্চনা দাস, বাউসী ইউনিয়নের রামভদ্রপুর গ্রামের কাঞ্চনবালা মন্ডল, সখিনা খাতুন, সাহতা ইউনিয়নের ডেমুরা গ্রামের বেণু বালা সরকার, হাজেরা বেগম, রায়পুর ইউনিয়নের শাসনউড়া গ্রামের হাজেরা বিবি, জরিনা আক্তারের সাথে কথা বললে তারা জানান, একসময়ে কাঁথা সেলাইয়ের কাজে ব্যস্ত সময় কাটাতো গ্রামাঞ্চলের কিশোরী ও মহিলারা। গ্রামের নারীদের আড্ডা আর খোস গল্পের ছলে কাঁথা সেলাইয়ে ব্যস্ত সময় পার করা ছিল দৈনন্দিন নেশা। পুরাতন শাড়ি, লুঙ্গি, ওড়না বা যেকোনো কাপড়ে রঙ-বেরঙের সুতা দিয়ে সুনিপুণ হাতে তৈরি করা হয় এ কাঁথা। গ্রামের নারীরা মনের মাধুরী মেশানো অনুভুতিতে নান্দনিক রূপ-বর্ণ-বৈচিত্রে এই গ্রামীণ কাঁথা বুনন করতেন। নারীদের সুক্ষম হাতে সুচ আর লাল, নীল, সবুজ, বেগুনি, হলুদসহ বিভিন্ন রঙের সুতায় নান্দনিকতার বৈচিত্রে সেলাই করা হয়ে থাকে এ কাঁথা।
তারা বলেন, আমরা নিজেরাই এর শিল্পী, রূপকার এবং কারিগর। এ শিল্পের সাথে জড়িয়ে আছে গ্রাম বাংলার আর্থ-সামাজিক কর্মকান্ড। অথচ দুঃখের বিষয় সময়ের ব্যবধানে নতুনত্বের ছোঁয়ায় আজ হারিয়ে যেতে বসেছে মনের মাধুরী মেশানো হাতের সেলাইয়ে গড়া এই কাঁথার ঐতিহ্য।
কথা হয় উপজেলা সদরের কাশবন গ্রামের ৬০ বছর বয়সী নিলীমা ক্ষত্রিয় এর সাথে তিনি বলেন, এক সময় সাংসারিক দৈনিন্দন কাজের পাশাপাশি নকশী কাঁথা তৈরি করে বিক্রি করেছি। বিভিন্ন নকশা করে এক একটি কাঁথা তৈরি করতে প্রায় তিন-চার মাস সময় লাগতো। নকশী কাঁথার দাম জানতে চাইলে তিনি মুচকি হাসি দিয়ে বলেন, এখন বিক্রি অথবা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে নয় বাড়িতে ব্যবহারের জন্য এবং ঝি-জামাই, নাতি-নাতনিদের উপহার দেওয়ার জন্য শখের বশে বিভিন্ন নকশা করে কাঁথা তৈরি করি।
অতীতের স্মৃতিচারণ করে উপজেলার রায়পুর গ্রামের আয়শা বেগম (৮০) জানান, আগে সাংসারিক কাজের পাশাপাশি কাঁথা সেলাই করে দুই-চার আনা রোজগার করেছি। যা বিপদ-আপদে সংসারে কাজে লেগেছে। কিন্তু এখন কেউ আর কাঁথা সেলাই করায় না।
বারহাট্টা প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফেরদৌস আহমেদ বলেন, গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যে মিশে আছে গ্রাচীন শিল্পকলার নিদর্শন এই সুচ শিল্প। আর এ শিল্পের সাথে জড়িয়ে আছে গ্রামের আর্থ-সামাজিক কর্মকান্ড। বর্তমানে বড় বড় কারখানায় তৈরিকৃত দেশি-বিদেশী রঙ-বেরঙের রেডিমেইড লেপ-কম্বলের চাপায় হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় গ্রামীণ ঐতিহ্যের এ শিল্পটি। কালের বিবর্তনে আজকাল আর চোখে পড়ে না গ্রামীণ এ কাঁথা সেলাইয়ের দৃশ্য।
তিনি আরও বলেন, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড হিসেবে উৎপাদন, আয় বৃদ্ধি ও নতুন কর্ম-সংস্থান তৈরির ক্ষেত্র হিসেবে এই খাতের সম্ভাবনা রয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা এগিয়ে আসলে হারানো ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব। তবে এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে ঋণ সহায়তার পাশাপাশি বাজারজাত করার উদ্যোগ গ্রহন করা প্রয়োজন।
সমাজ কল্যাণ সংস্থার প্রশিক্ষক রাণী সরকার বলেন, এক সময় গ্রামীণ ঐতিহ্য ছিল নকশী কাঁথার। গ্রামের মেয়েরা তাদের মনের মাধুরী মিশিয়ে সেলাই করতেন। যেখানে প্রতিটি ফোঁড়ে গেঁথে থাকত প্রিয়জনদের বলা না বলা কথা। সেই সব নকশী কাঁথা এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। গ্রামের নারীরা যারা এসব শিল্পের সঙ্গে জড়িত তাদের সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা হলে পুনরায় এ শিল্পকর্মকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। সেই সঙ্গে হাতেকলমে হস্তশিল্পের নকশা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
এমএসএম / এমএসএম

নিরাপদ সড়কের দাবিতে চৌগাছায় শিক্ষার্থী অভিভাবকদের মানববন্ধন

নাচোলে বিনামূল্যে প্রান্তিক কৃষকদের মাঝে রাসায়নিক সার ও বীজ বিতরণ

কাপ্তাই ১০ আরই ব্যাটালিয়ন কতৃক সহায়তা প্রদান

পটুয়াখালীর বাউফলে কেটে কেটে আ.লীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালন

বাঁশখালীতে কৃষকের মাঝে বিনামূল্যে আমন ধানের বীজ ও সার বিতরণী উদ্বোধন

বাকেরগঞ্জ গৃহবধূ আসমার হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে মানববন্ধন

মাদারীপুরে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য সচিবকে কুপিয়ে জখম

গোপালগঞ্জে পলিথিন বিরোধী ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান

টাঙ্গাইলে অর্ধকোটি টাকার লুন্ঠিত ৭৫ ড্রাম তেল'সহ ২ ডা/কা'ত গ্রেফতার

দাউদকান্দিতে মাইথারকান্দি খালের আবর্জনা অপসারণ উদ্বোধন

সীতাকুণ্ডে সরকারী জায়গা দখলকৃত শিপইয়ার্ড উচ্ছেদ করলো প্রশাসন

বারি’র “জাতীয় পরিবেশ পদক” অর্জন
