চেয়ারম্যান নেই, আমলারা চালায় ইউপি
কর্ণফুলী উপজেলায় ১% বরাদ্দে ৩৯ লাখ ঘুষ!
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় ইউনিয়ন পরিষদের ১% বরাদ্দ থেকে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে ইউএনও-এসিল্যান্ড যৌথভাবে ৩০% হারে নগদ অর্থ আদায় করছেন—এমন গুরুতর অভিযোগ উঠেছে সংশ্লিষ্ট ইউপি সদস্যদের পক্ষ থেকে। ইউপি সচিবরা বলেছেন ভিন্ন কথা। আর উপজেলা এলজিইডি প্রকৌশলী তাসলিমা জাহান প্রকল্পের বরাদ্দ ও প্রকল্পের নামের তালিকা দিতেও নানা বাহনায় লুকোচুরি করেন।
অভিযোগ অনুযায়ী, প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যদের দুই লাখ টাকার কম বেশি সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প বরাদ্দ দিয়ে, সচিবদের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে নগদ অর্থ আদায় করা হয়। একাধিক ইউপি সদস্যদের দাবি, প্রকল্পের চেক হাতে পেতে হলে আগে ৩০% ‘কাটমানি’ পরিশোধ করতে হয়। কেউ কেউ জানান, ১ লাখ টাকার প্রকল্পেও ৩০ হাজার টাকা আগাম দিতে বাধ্য হন মেম্বারগণ। দুই লাখ টাকার প্রকল্পে ৬০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সচিবরা!
জানা গেছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বিগত সরকার পতনের পর ইউপি চেয়ারম্যানদের কার্যত নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হলে, কর্ণফুলীর পাঁচ ইউনিয়নে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পান উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাসুমা জান্নাত ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) রয়া ত্রিপুরা। শিকলবাহা ও চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের দায়িত্বে ইউএনও, আর জুলধা, বড়উঠান ও চরলক্ষ্যার দায়িত্বে এসিল্যান্ড। একইসঙ্গে তাঁরা উপজেলা প্রশাসনের কার্যক্রমও সামলান।
প্রশাসনিক এ দ্বৈত-দায়িত্ব এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অনুপস্থিতি সুযোগ হিসেবে কাজে লাগানো হয়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। বরাদ্দ সংক্রান্ত তথ্য গোপন, প্রকল্প অনুমোদনে অস্বচ্ছতা এবং তদবিরনির্ভর প্রক্রিয়া স্থানীয় পরিষদ সদস্যদের হতাশ করেছে।
ইউপি সদস্যদের ভাষ্য, অতীতে ভ্যাট-ট্যাক্সসহ সর্বোচ্চ ১৮-১৯% পর্যন্ত অর্থ দিতে হলেও বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০%-এ, যা একেবারেই ঘুষ ও দুর্নীতির পর্যায়ে পড়ে। উল্লেখযোগ্য যে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে পাঁচ ইউনিয়নে ১% বরাদ্দ হিসেবে মোট ১ কোটি ২৯ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। তাতে জুলধা ২১ লাখ, শিকলবাহা ৩০ লাখ, বড়উঠান ২৬ লাখ, চরপাথরঘাটা ২৭ লাখ এবং চরলক্ষ্যা ২৫ লাখ টাকা। কিন্তু বরাদ্দ পেল কত? অনেকেই জানান, প্রতি বছর ৩ কোটি টাকার উপরে বরাদ্দ পান। তাহলে বাদ বাকি টাকা কোন খাতে কোথায় ব্যয় করা হচ্ছে তাঁর কোনো ব্যাখ্যা নেই।
এই ১ কোটি ২৯ লাখ টাকার মধ্যে প্রায় ৩৮ লাখ ৭০ হাজার টাকা ‘কাটমানি’ হিসেবে আদায়ের অভিযোগ উঠলেও, সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে নীরব ভূমিকা পালন করছেন। এমনকি সরকার থেকে এবারে মোট বরাদ্দ কত পেয়েছেন তাও বলতে নারাজ ইউএনও এসিল্যান্ড ও এলজিইডি প্রকৌশলী। এতে কাটমানির মধ্যস্থতায় কাজ করেছেন মূলত ইউপি সচিবরা।
প্রশ্ন উঠেছে—সরকারি ১৪.৫% ভ্যাট-ট্যাক্স হিসেবেও যদি কেটে রাখা হয়, তবুও অতিরিক্ত প্রায় ২০ লাখ টাকার ব্যবহারবিধি সম্পর্কে কোনো ব্যাখ্যা নেই। বরাদ্দকৃত অর্থের মোট অঙ্ক, তার সুষ্ঠু ব্যবহার, প্রকল্প বাছাইয়ের পদ্ধতি এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা—সব কিছুই এখন প্রশ্নবিদ্ধ।
সব জেনেও জানে না কর্ণফুলী উপজেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রকৌশলী তাসলিমা জাহান। গত অর্থ বছর শেষে উন্নয়ন তহবিলে কত টাকা স্থানান্তরিত হয়েছে তাও জানেন না। জানলেও তথ্য দিতে নারাজ।
গত ৭ বছরে ভ্যাট ট্যাক্স আদায় করা হয়েছে কিনা সে তথ্যও তাঁর জানা নেই। কারণ তিনি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে টানা সাড়ে ১০ বছর আনোয়ারা উপজেলায় কর্মরত ছিলেন সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ও তার এপিএস সায়েম এর খুঁটির জোরে। অথচ নিয়মানুযায়ী কোনো সরকারি কর্মকর্তা একই কর্মস্থলে তিন বছরের অধিক সময় থাকতে পারেন না।
তাঁকে তিনবার বোয়ালখালী, রাঙ্গামাটি বদলি করা হলেও সাবেক মন্ত্রী-এপিএসের হস্তক্ষেপে তাঁর বদলি আদেশ প্রত্যাহার হয় বারবার। বর্তমানে সুকৌশলে আনোয়ারা থেকে কর্ণফুলী উপজেলায় বদলি নিলেন। যাতে বিগত সময়ের সকল অনিয়ম দুর্নীতি থেকে নিজেকে আড়াল রাখতে পারেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব অনিয়মে দুদকের হস্তক্ষেপ জরুরি।
বিগত সময়ে প্রকৌশলী তাসলিমার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো, নিম্নমানের কাজ অনুমোদন, ঠিকাদারের সাথে সখ্যতা গড়ে একাধিক প্রকল্পে লোকসান দেখিয়ে প্রকল্পের বরাদ্দ বাড়ানোর সুপারিশসহ পছন্দসই ঠিকাদার দিয়ে কাজ করানোর।
স্থানীয়রা জানান, স্কীম বাছাই কমিটির অনুমোদন ছাড়া কোন স্কীম গ্রহণ করা যায় না, কিন্তু কর্ণফুলী উপজেলায় আজ পর্যন্ত কোন স্কীম বাছাই কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়নি। এ পরিস্থিতি স্পষ্টতই প্রশ্ন তুলছে, তাহলে স্কীমগুলো অনুমোদিত হয় কীভাবে? এটি একটি গুরুতর অব্যবস্থা, যা সরকারি নিয়মের প্রতি অবজ্ঞা এবং দায়িত্বের অভাবকে ইঙ্গিত করছে।
ভ্যাট-আয়কর কাটা নিয়ে প্রশ্নে সচিবদের দায় এড়িয়ে যাওয়া
ভ্যাট ও আয়কর হিসেবে ৩০% টাকা কাটা হচ্ছে—এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে চরপাথরঘাটা ইউনিয়ন পরিষদের 'সচিব' (বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদ প্রশাসনিক কর্মকর্তা) আবদুল মালেক বলেন, 'বিষয়টি এভাবে নয়। সরকার যে হারে ভ্যাট-ট্যাক্স নেয়, সেই অনুপাতে কাটা হচ্ছে। তবে ৩০% কাটা হচ্ছে কি না, তা আমি নিশ্চিত নই। এ বিষয়ে ইউএনও স্যারের সঙ্গে কথা বলে জানাতে পারব।' তিনি আরও বলেন, 'আয়ের ওপর আগে কম ট্যাক্স ছিল, এখন বেশি। নিয়ম অনুযায়ী ১৪.৫% কাটা যায়, কিন্তু ৩০% কে নিচ্ছে তা বলতে পারছি না। আমি প্রকল্পের পুরো টাকা চেকে দিয়ে দিয়েছি।'
চরলক্ষ্যা ইউনিয়ন পরিষদের সচিব মনোয়ারা বেগম বলেন, '৩০% কারা নিচ্ছে, সেটা মেম্বাররা ভালো বলতে পারবেন। কারণ তারা প্রকল্প সভাপতি। চেয়ারম্যানের জায়গায় এখন এসিল্যান্ড সাহেব প্রকল্প অনুমোদন দিচ্ছেন, উনিই ভালো জানেন। মেম্বাররা যদি কাজ করতে না চান, তাহলে প্রকল্পের টাকা পড়ে থাকবে। ৩০% এর বিষয়টি আমি স্যারদের জানাব। আমার সে ক্ষমতা নেই, কারণ আমি নির্বাহী নই। কে কিভাবে নিচ্ছে, সেটা এসিল্যান্ড সাহেব বলতে পারবেন।'
শিকলবাহা ইউনিয়নের সচিব উকিল আহমেদ বলেন, 'আমি কারো কাছ থেকে ৩০% নেইনি। কেউ এসে প্রমাণ করতে পারবে না আমি নিয়েছি। আমাদের ইউনিয়নের সব প্রকল্পের বিল দেওয়া হয়েছে। মামুন মেম্বার বিদেশ যাওয়ার আগে চেক নিয়েছেন।' তবে মামুন মেম্বার জানান, তিনি ২ লাখ ৪৫ হাজার টাকার কাজ করলেও এখনো বিল পাননি। এ প্রসঙ্গে সচিব পরের প্রশ্নে বোল পাল্টিয়ে বলেন, 'হয়তো ওর ভাই চেক নিয়ে গেছে।'
বড়উঠান ইউনিয়ন পরিষদের সচিব পংকজ দত্ত জানান, 'আমাদের ইউনিয়নে ১% কাজ বন্ধ রয়েছে। রাজনৈতিক গ্রুপিংয়ের কারণে স্থানীয়ভাবে বাধা দেওয়া হচ্ছে। চারটি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে, কিন্তু এখনো বিল দেওয়া হয়নি। তাই কাজ স্থগিত আছে।'
জুলধা ইউনিয়ন পরিষদের সদ্য সাবেক সচিব জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'আগে আয়কর কাটা হতো ৩%, এখন হচ্ছে ৭%—তাই কিছুটা বেড়েছে। ৩০% কাটার বিষয়টি এসিল্যান্ড স্যার ডিল করছেন। আমরা শুধু তাঁদের নির্দেশনা অনুসরণ করছি। আমি ইতোমধ্যে বিষয়টি তাকে জানিয়েছি।' পরে জানা যায়, এসব তথ্য ফাঁস করায় জাহাঙ্গীর আলমকে বদলি করা হয়েছে।
কর্ণফুলীর এসিল্যান্ড ও জুলধা চরলক্ষ্যা পরিষদের প্রশাসক রয়া ত্রিপুরা দাবি করেন, ‘এটা এলজিএসপি নয়, ১% বরাদ্দের কাজ।’ তবে, ১% প্রকল্প থেকেও কেন ৩০% হারে অর্থ কাটা হচ্ছে—এ প্রশ্নের জবাব তিনি দেননি। ইউএনও মাসুমা জান্নাত একাধিকবার কল করা হলেও সাড়া দেননি।
ওদিকে, এলজিইডি প্রকৌশলী তাসলিমা জাহানের সাথে এক সপ্তাহ যাবত তথ্য উপাত্ত চাইলেও শেষে তিনি জানান, 'এসব ১% এর তথ্য তিনি দিতে পারবেন না। দিলে সমস্যা হবে।' বাকিটা বুঝে নিতে আর কারো সমস্যা হবার কথা না।
জেলা স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক মো. নোমান হোসেন জানান, 'এ বিষয়ে ইউপি সদস্যদের কাছ থেকে লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।' তবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অভিমত, তদন্তের পূর্বেই মৌখিকভাবে প্রাথমিক যাচাই-বাছাই করে অভিযোগের সত্যতা নির্ধারণ করা সম্ভব।
এদিকে, জনপ্রতিনিধিদের দাবি, অতীতে ইউনিয়ন পরিষদগুলো সরাসরি বার্ষিক উন্নয়ন তহবিল, এলজিএসপি ও টি/আর প্রকল্পের বরাদ্দ পেয়ে উন্নয়ন কাজ পরিচালনা করত। তখন ইউএনও ও এসিল্যান্ড পর্যবেক্ষণকারী ভূমিকা রাখলেও, বর্তমানে তাঁরা সরাসরি বরাদ্দ ও ব্যয়ের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছেন—যা স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী।
স্থানীয় প্রশাসনের এ দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত সাপেক্ষে প্রমাণিত হলে, তা কেবল স্থানীয় জনগণের সঙ্গে প্রতারণাই নয় বরং রাষ্ট্রীয় তহবিলের অপব্যবহার হিসেবেও গণ্য হবে বলে অভিমত সংশ্লিষ্ট মহলের।
এমএসএম / এমএসএম
ভূরুঙ্গামারীতে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সংগঠনের এক নেতাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ
বড়লেখায় হাদীর রুহের মাগফিরাত কামনায় জামায়াতে ইসলামীর দোয়া মাহফিল
দেবিদ্বার মোহনপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে নিয়মবহির্ভূত ভাবে প্রধান শিক্ষককে বহিস্কারের অভিযোগ
গজারিয়ায় দিনে দুপুরে এক যুবককে ডেকে নিয়ে কুপিয়ে হত্যার অভিযোগ
চাঁদপুরে শহিদ হাদির গায়েবানা জানাজায় ছাত্র-জনতার ঢল
হেডম্যান পাড়া কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ বিহার উদ্যােগের মহা আচরিয়া গুরু পূজা অনুষ্ঠিত
ক্ষেতলাল উপজেলা পরিষদে সমাজসেবা অফিস সহায়কের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার
কাউনিয়ায় শোকাবহ পরিবেশে ওসমান হাদীর গাইবানা জানাজা সম্পন্ন
আব্দুল আলী ও হালিবন নেছা ফাউন্ডেশন কর্তৃক মুকসুদপুরের ৩১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুষ্ঠিত হলো মেধা বৃত্তি পরীক্ষা
শেরপুরের নকলায় নিখোঁজের চার দিন পর শিশু রেশমীর লাশ উদ্ধার
ভূরুঙ্গামারীতে শরীফ ওসমান হাদি হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল
তানোর কোয়েল পূর্বপাড়া গ্রামের স্বপন আলী অবৈধ মটার স্হাপন জনগণের মধ্যে চরম উত্তেজনা