ঢাকা রবিবার, ১৫ জুন, ২০২৫

বাংলাদেশ সংবিধানের আলোচিত ৭০ অনুচ্ছেদ প্রেক্ষিতঃ রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যমত


নিজস্ব প্রতিবেদক photo নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১৩-৬-২০২৫ বিকাল ৫:২৯
এস এম আকাশ:
গেল বছরের ঐতিহাসিক ৫ আগষ্ট পরবর্তী বাংলাদেশে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের সংবিধান সংশোধনের দাবিতে সংস্কার কমিশন গঠন করেছেন। উক্ত কমিশনের বেশ কিছু অনুচ্ছেদ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নানান মতপার্থক্য দৃশ্যমান রয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে ১৯৭২ সালে সৃজনকৃত ৭০ অনুচ্ছেদের সংশোধন প্রশ্নে চেতনার দায়বদ্ধতা থেকে সংশোধনের বিষয়ে দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ বাকি দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছেছে। যা দেশের নাগরিকদের সত্যিই স্বাধীনতার আলো দেখাচ্ছে। কেননা বাংলাদেশ সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ প্রকৃতপক্ষে একটি বিতর্কিত ও সমালোচিত ধারা যা দেশের সংসদে কঠোর দলীয় শৃঙ্খলা আরোপে জীবন্ত এক আয়নাঘর। ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে দেশের সংসদকে"রাবার স্ট্যাম্প সংস্থা"হিসাবেও বর্ণনা করেছেন বহু আইন প্রণেতা। যেখানে নির্বাচিত এমপিরা ফ্লোর অতিক্রম করতে পারবেনই না এমনকি নিজের বিবেক ভোটও দিতে অক্ষম।
এমতাবস্থায় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার উক্ত অনুচ্ছেদ সংশোধনের শর্তের মধ্যে তিন টি বিষয় দাঁড় করিয়েছন। ১) অর্থবিল ২) আস্থা ভোট ৩) সংবিধান সংশোধন। এতে কমিশন বলতে চেয়েছে এ তিনটি বিষয় ছাড়া সংসদ সদস্যরা বাকি সব বিষয়ে স্বাধীন ভাবে কথা বলতে পারবেন। নিজ দলের বিরুদ্ধেও ন্যায়সংগত কথা বলতে কোনো বাধা থাকবে না।কমিশনের এই মতামতে একমত হয়েছেন দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক দলগুলো।
অদ্যাবধি চলমান সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ-সদস্যরা নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারেন না। নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হিসাবে কোনো ব্যক্তি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর যদি তিনি ঐ দল থেকে পদত্যাগ করেন বা সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোট দেন,তাহলে গঠিত সংসদে তার আসন শূন্য ঘোষণা করতে পারবেন। এর মাধ্যমে ব্যক্তি-চিন্তা বা ব্যক্তিগত মতকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে অস্বীকার করা হয়েছে। অপর দিকে এ অনুচ্ছেদ না থাকলে সংসদে ‘হর্স ট্রেডিং’হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আর"হর্স ট্রেডিংয়ের"সুযোগ থাকলে সরকারের মেয়াদ হুমকিতে পড়ার আশংকা থাকে। তাই এখন উপযুক্ত সময় এসেছে বলে মনে করছেন সংস্কার কমিশন তাই ঐকমত্যের ভিত্তিতে এই বিতর্কিত অনুচ্ছেদের সংশোধন আনতে কাজ করছেন তারা। প্রসঙ্গত: প্রথমেই এটির পরিবর্তনের প্রস্তাব করেছিল ৫ আগষ্ট পরবর্তী গঠিত বর্তমান সংবিধান সংস্কার কমিশন। এতে অর্থবিল ছাড়া অন্য যে কোনো বিষয়ে সংসদে সদস্যরা নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা ও স্বাধীনতা পাবে। পবিত্র ঈদুল আজহা ২০২৫ পূর্ববর্তী সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্বের আলোচনায় ৭০ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন প্রশ্নে বিএনপির প্রস্তাবনা ছিল,৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আস্থা ভোট না থাকলে সরকার পরিচালনায় স্থায়িত্ব হারাবে। এতে প্রতিনিয়ত সরকার পরিবর্তন হতে থাকবে। তাই আস্থা ভোট,অর্থবিল এবং সংবিধান সংশোধন ছাড়া সংসদ-সদস্যরা স্বাধীনভাবে মতামত প্রদান করবেন। এ বিষয়ে বিএনপি একমত শুধু মাত্র জাতীয় নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত করতে চায় দলটি। এর বাইরে উক্ত অনুচ্ছেদের বাকি সব বিষয়ে দলের বিপক্ষে সংসদ সদস্যরা ভোট দিতে পারবেন মর্মে তারা একমত।
অন্যদিকে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে অর্থবিল,আস্থা ভোট ও সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিষয় ছাড়া বাকি সব বিষয়ে সংসদ-সদস্যদের দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে ভোট দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন দেশের বৃহৎ ইসলামি দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। অপরদিকে ছাত্রদের গঠিত নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি'র মতামত ছিল অর্থবিলের পাশাপাশি আস্থা ভোট থাকতে হবে,কারণ সংসদ-সদস্যদের স্বাধীনতা যেমন দরকার, তেমনই দরকার সরকারের ব্যালেন্সিং পন্থা। উক্ত মতামত গুলোর ভিত্তিতে বুঝা যাচ্ছে ৭০ অনুচ্ছেদ পরিবর্তনের প্রশ্নে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান প্রায় কাছাকাছি। এ বিষয়ে মোটামুটি ঐকমত্য রয়েছে। যা আগামীর বাংলাদেশ ও নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বের জন্য মাইলফলক বলে মনে করছেন দেশের বিশিষ্ট আইন প্রণেতা ও বিশিষ্ট নাগরিকরা।
এই অনুচ্ছেদের পিছনে গুরুত্বপূর্ণ হেতু গুলোর মধ্যে রয়েছে; ততকালীন সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী কর্তৃক জারিকৃত বাংলাদেশ গণপরিষদের (সদস্যপদ বাতিল) আদেশ ১৯৭২ সৃজন হয়। যার অনুবলে ৭০ অনুচ্ছেদটি লেখা হয়েছিল। ততকালীন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনায় এটি করা হয়েছিল। ঐ সরকারেরই দলীয় আইনপ্রণেতা কে এম ওবায়দুর রহমান বলেছিলেন, বাংলাদেশের গণপরিষদে এ আইন প্রণয়নের ক্ষমতা কেন নেই...? সে বিষয়ে প্রশ্ন তোলাতে ততকালীন প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হন এবং তারই প্রেক্ষিতে ১৯৭২ সালের অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধানের অধীনে লিপিবদ্ধ হয় এই বিধি। পরিতাপের বিষয় হলো তখন আইন প্রণয়নের ক্ষমতা নির্বাহী বিভাগের হাতেই ছিল। যা আজ পর্যন্ত বাঙালি জাতি গোটা বিধান টাকে ৭২ এর সংবিধান বলে জানে।
এই অনুচ্ছেদটির কারণে সংসদ সদস্যদের অবাধ ভোটদান,ফ্লোর ক্রসিং এ বাঁধা,দলীয় সংসদ সদস্যরা তাদের দলের বিরুদ্ধে ভোট দিলে তবে তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাদের সংশ্লিষ্ট আসন হারাবেন। উক্ত অনুচ্ছেদ অনুসরণে সংসদ মূলত ক্ষমতাসীন দল ও জোট কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপের জন্য রাবার স্ট্যাম্প হিসেবে কাজ করে। যাতে করে প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে পর্যন্ত অপসারণের উপর অনাস্থা ভোট দিতে পারেন না নিজ দলীয় সংসদ সদস্যরা। অথচ যেখানে দলীয় সংসদ সরকারের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটায় কিন্তু এখানে তার সম্পূর্ণ বিপরীতটিই দেখে আসছে বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ। যেখানে "সু-কার্যক্ষম ওয়েস্টমিনস্টার" ব্যবস্থা পরিস্কার দেখা যায়। যেটি মার্কিন কংগ্রেস এবং জাপানি ডায়েট এর মতো গণতান্ত্রিক দেশের সাথেও আমাদের নিয়মের পরিপন্থী।
সমালোচকদের যুক্তি দেখলে পরিস্কার হওয়া যায় যে,৭০ অনুচ্ছেদ সংবিধানের মৌলিক অধিকারের সাথে সাংঘর্ষিক। যার মধ্যে রয়েছে বাকস্বাধীনতা এবং বিবেকের স্বাধীনতা আটকে রাখা। উক্ত সংসদে জবাবদিহিতার অভাব হওয়ার ফলে প্রধানমন্ত্রী অটো ব্যাপক ক্ষমতা পেয়ে যায়। আর যিনি প্রধানমন্ত্রী হন তিনি বরাবরই ইতিহাসের চিহ্নিত একনায়কতন্ত্রের প্রবক্তা হয়ে হাজারো অভিযোগে অভিযুক্ত হোন।
নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের অনাস্থা প্রস্তাবের বিকল্প কোন দায়িত্ব না থাকায় প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার উপর প্রাতিষ্ঠানিক ও বিবিধ ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করা উল্লেখযোগ্য ভাবে সীমিত থাকে। ঠিক এই বিশ্লেষণে সমালোচকদের উম্মুক্ত বক্তব্য থাকে যে, ৯ মাস যুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া গনতান্ত্রিক বাংলাদেশের একজন সাধারণ বাংলাদেশি নাগরিক দেশের প্রধানমন্ত্রীকে আইনত দরখাস্ত ও বরখাস্ত বা আইনের উর্ধে না রাখার স্বাধীন আইনী সুযোগ পেয়েছেন..? বা এমন দৃষ্টান্ত কখনো কি তৈরি হয়েছিল..? যার দরুন এটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক চর্চার পরিপন্থী একতরফা অনুচ্ছেদে। সুতরাং সর্বসম্মতিক্রমে এই অনুচ্ছেদ সংশোধন অতি গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরী বলে মত দিয়েছেন বর্তমান সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা ও আত্ম বিশ্বাস রেখে সাধারণ বাংলাদেশী দায়িত্বশীল নাগরিকরা বলছেন জাতির কাঙ্খিত প্রত্যাশা ও আগামীর বাংলাদেশ গঠনে এমনই ভাবে ঐক্যমত জরুরী। রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশের ও দলের স্বার্থে অবশ্যই রাজনৈতিক দলগুলো জনতার অধিকার আদায়ে আন্দোলন সংগ্রাম মিছিল মিটিং হরতাল অবরোধ অবশ্যই করবে কিন্তু দেশের আপামর জনসাধারণের জন্য আগামী প্রজন্মের জন্য ও আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মানের জন্য এবং ছাত্র জনতার আন্দোলনে বিতাড়িত ফ্যাসিজম ঠেকাতে এক মুহূর্তের জন্যেও পিছপা হওয়া যাবে না। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি সর্বস্তরের নাগরিকদের এতটুকুই প্রত্যাশা।
 
লেখক;
গণমাধ্যমকর্মী ও নির্বাচন বিশ্লেষক।

এমএসএম / এমএসএম

বাংলাদেশ সংবিধানের আলোচিত ৭০ অনুচ্ছেদ প্রেক্ষিতঃ রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যমত

শতাব্দির সেরা মাটির সৈনিক কৃষক যোদ্ধা

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট ও জনগণের প্রত্যাশা

ট্রাম্প-সালমান কথোপকথনে বিশ্ব কী বার্তা পেল

এফবিসিসিআইর ডিজিটাল রূপান্তর : ব্যবসায়িক নেতাদের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল সেবা

জাতীয় ঐকমত্য কঠিন হলেও উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ

রাজনৈতিক অঙ্গনে এক অনন্য উচ্চতায় তারেক জিয়া

কেমিক্যাল আতঙ্ক নয়, চাই বিজ্ঞানসম্মত আমচাষ ও প্রশাসনিক সচেতনতা

শুভ অক্ষয় তৃতীয়া: দানে ধ্যানে অনন্তকালের পূণ্যলাভ

শিক্ষা উপকরণের ব্যবহার ও গুরুত্ব, বাংলাদেশ প্রেক্ষিত

ইসরায়েলের বর্বরোচিত যুদ্ধের অবসান হোক

চায়না-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ জেনারেল হাসপাতাল নিয়ে তিস্তা পাড় বাসীর প্রত্যাশা

বিশ্ববাণিজ্যে বড় চ্যালেঞ্জ ট্রাম্পের শুল্কনীতি