শেকৃবিতে নিয়োগে আওয়ামী পুনর্বাসন, এলাকাপ্রীতি ও অর্থ লেনদেনের অভিযোগ

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শেকৃবি) কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগে আওয়ামী পুনর্বাসন, এলাকা প্রীতি ও নিয়োগ বাণিজ্যসহ অদক্ষ জনবল নিয়োগের অভিযোগ উঠেছে। আওয়ামী লীগ নিয়োগের বিষয়ে স্বীকার করলেও বাকি অভিযোগ মানতে নারাজ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

এ বছরের মার্চ মাসে প্রকাশিত পূন:বিজ্ঞপ্তিতে ৮৩ পদে জনবল নেওয়ার কথা উল্লেখ থাকলেও ১৪৫ জনকে নিয়োগ দিয়েছে প্রশাসন। যদিও এর মধ্যে অজানা কারণে ৬টি পদে কর্মকর্তা নিয়োগ না দিয়ে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে কমপক্ষে ২৫ জন আওয়ামী সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এদের মধ্যে চলতি মামলার আসামীসহ ২০১৮ এবং ২০২৪ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারণা, মিটিং এবং শোডাউনে অংশ নেয়া ব্যক্তিরাও নিয়োগ পেয়েছেন। যাদের মধ্যে বেশিরভাগই সংশ্লিষ্ট পদের কাজে অদক্ষ।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২ মামলার আসামী মোঃ গিয়াস উদ্দিন মামুন নিরাপত্তা প্রহরী পদে, বঙ্গবন্ধু কর্মচারী পরিষদের সাবেক সদস্য মোঃ আব্দুর রশিদ নিরাপত্তা প্রহরী পদে এবং তার জামাতা মো. শাহিন হাসান ট্রাক্টর ড্রাইভার হিসেবে, বঙ্গবন্ধু কর্মচারী পরিষদের আরেক সাবেক সদস্য নয়ন সিকদারের স্ত্রী এটেন্ডেন্ট পদে নিয়োগ পেয়েছেন। এছাড়া নিরাপত্তা প্রহরী পদে মোঃ আফজাল হোসেন এবং জাহাঙ্গীর হোসেন, কম্পিউটার অপারেটর পদে মোঃ মাসুদ রানা, এটেন্ডেন্ট পদে আলাউদ্দিন আহমেদ এবং অফিস সহায়ক পদে আবু হানিফসহ একাধিক নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যাক্তির আওয়ামী কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের ছবি এবং তথ্য প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। এছাড়াও উপাচার্যের ব্যক্তিগত সহকারী(পি.এ) পদে ছাত্রলীগকর্মী এবং উপাচার্যের এলাকার সাব্বির আহমেদকে নিয়োগ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

জুলাই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের বিপক্ষে অবস্থান নেয়া বরখাস্তকৃত অধ্যাপক ফরহাদ হোসেনের আত্মীয়কেও ডাইনিং বয় হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক আবুল বাশার বলেন, এভাবে হিসেব করতে গেলে তো আগের ৩৫০০ শিক্ষার্থীর কেউই ছাত্রলীগের বাইরে ছিল না। আওয়ামী সংশ্লিষ্ট এবং মামলার আসামী নিয়োগের ব্যাপারে তিনি বলেন, আমরা জানতাম না। পরবর্তী পুলিশ ভেরিফিকেশনে প্রমানিত হলে তারা বাদ পড়ে যাবে।

উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুল লতিফ বলেন, "আমাদের পক্ষ থেকে যতটুকু সম্ভব যাচাই করা হয়েছে। পুলিশ ভেরিফিকেশনের মধ্য দিয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে। তাছাড়া আমরা তো ভাইভা বোর্ডে কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারিনা যে সে আওয়ামী লীগের দোসর কিনা।"

এসবের পাশাপাশি অভিযোগ উঠেছে অর্থ লেনদেনেরও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক অধ্যাপক জানান, কর্মচারী নিয়োগে টাকার লেনদেনসহ অনিয়মের বিষয় সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই জানলেও কেউই এটা নিয়ে কোন প্রতিবাদ করছে না।
একাধিক মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিচের গ্রেডগুলোতে ৭ থেকে ১০ লাখ এবং উপরের গ্রেডগুলোতে কমপক্ষে ১৪ লাখ করে নিয়োগপ্রাপ্তরা দিয়েছেন। তবে কাকে দিয়েছেন, এ ব্যাপারে কেউ মুখ খুলতে রাজি নন।
 
এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচলিত এলাকাভিত্তিক রাজনীতিতে ৫ টি ভাগ রয়েছে। সর্বমোট ১৪৫ জন নিয়োগ প্রাপ্তদের মধ্যে উত্তরাঞ্চল থেকে ৬৯ জন এবং ঢাকা অঞ্চল থেকে ২১ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে শুধু ঠাকুরগাঁও থেকে ১৮ জন এবং রাজশাহী থেকে ৯ জন নিয়োগ পেয়েছেন। উল্লেখ্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাড়ি রাজশাহী এবং উপ-উপাচার্য ও প্রক্টরের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ে।

এছাড়া, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কেন্দ্রীয় আহবায়ক কমিটির সদস্য ও শেকৃবি শিক্ষার্থী আশিক আহমেদের ভাই তৌকির আহমেদ সহকারী একাউন্টেন্ট পদে নিয়োগ পেয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেন, তিনি সংশ্লিষ্ট দাপ্তরিক কাজে অনভিজ্ঞ।

নাম না প্রকাশ করার শর্তে একাধিক জৈষ্ঠ্য অধ্যাপক জানান, কোষাধ্যক্ষের সুপারিশে মানিকগঞ্জের ১২ জনকে বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। যাদের মধ্যে ৮ জনই ঘিওর উপজেলার।

নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যাক্তিদের কি দেখে নিয়োগ দেয়া হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে উপাচার্য এবং কোষাধ্যক্ষ জানান, আবেদনকারীদের এলাকা কিংবা সুপারিশ নয় বরং যোগ্যতা অনুযায়ী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তবে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, এসব নিয়োগপ্রাপ্তরা বেশিরভাগই তাদের কাজে অদক্ষ।

সম্প্রতি গাড়ি চালক ফায়াজুল হক বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি নিয়ে দূর্ঘটনা ঘটায়। দূর্ঘটনার শিকার গাড়ির মালিক কৃষি রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ আরিফুল ইসলাম বলেন, আমার পার্কিং করা গাড়িতে সে ধাক্কা দেয়। এতে আমার গাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ঐ ড্রাইভার ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হয়েছেন। এছাড়া একাধিক আবাসিক হলে নিয়োগপ্রাপ্ত বাবুর্চীদের কেউ কেউ হলে এসেই প্রথম রান্না করছেন। লিফট অপারেটর পদে নিয়োগ পাওয়া ৪ জনের কাউকেই হলগুলোতে দেখা যায় না। শিক্ষার্থীরা বলছেন, জরুরী প্রয়োজনে কল দিতে লিফটের ভেতর নাম ও নাম্বার সাটিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছেন তারা।

নিষিদ্ধ আওয়ামী সংশ্লিষ্ট এবং ক্যাম্পাসে ফটোকপি দোকান ব্যবসায় জড়িত রিপন কর্মকার লিফট অপারেটর পদে নিয়োগ পেয়েছেন। পাশাপাশি তার দুই ভাইয়ের স্ত্রীকেও কর্মচারী পদে নিয়োগ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তাকে ননবাব সিরাজউদ্দৌলা হল এবং এম মহবুবুজ্জামান ভবনের লিফট অপারেটর হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হলেও তিনি ক্যাম্পাসেই ফটোকপি দোকানের ব্যবসায় জড়িত। বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ৪৫(৭) ধারা অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন বেতনভোগী কর্মকর্তা বা কর্মচারী কর্তব্যে অবহেলা, অসদাচরণ, অদক্ষতার পরিচয় দিলে তাকে চাকুরী হতে অপসারণ বা অন্য প্রকার শাস্তি প্রদান করার উল্লেখ রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার রেজাউল করিম জানান, লিফট উঠানাম করানো লিফট অপারেটরদের কাজ। তারা কাজে অবহেলা করে ব্যক্তিগত কাজ করলে কিংবা কোন ব্যবসায়ে জড়িত হলে সেটি বেআইনি।

বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশিত সংখ্যার বেশি নিয়োগের বিষয়ে তিনি বলেন, এটি একাধিকবার রিভিউ হয়েছে। একাধিক সার্কুলার না দিয়ে একই সাথে নেয়া হচ্ছে। ইউজিসি বিষয়টি অবগত। উল্লেখ্য, আগের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া এই বিজ্ঞপ্তির নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করলে নানা অনিয়মের অভিযোগের কারণে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্থগিতাদেশ দিয়েছিল বিশ্বদ্যিালয় মঞ্জুরি কমিশন।

সার্বিক বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ আব্দুল লতিফ বলেন, নিয়োগের ক্ষেত্রে নিদিষ্ট একটা কাঠামো এবং প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়েছে । যোগ্য এবং প্রকৃত দাবিদার প্রাথীদেরকেই নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। নিয়োগের ক্ষেত্রে এলাকাপ্রীতি হওয়ার সুযোগ নেই। কিছু অঞ্চল রয়েছে যেসব জায়গা থেকে আবেদন আসেনি। তাই সেসব অঞ্চল থেকে নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ ছিল না। এছাড়া সকল অঞ্চলের আবেদনকৃত প্রার্থীদের মধ্যে যোগ্যদের নেওয়া হয়েছে।