গণতান্ত্রিক যাত্রার ওপর সচেতন আঘাত
অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ জোর দিয়ে বলেছিলেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হবে। সেটা যে হয়নি, সম্প্রতি ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনাই তার প্রমাণ। তাঁর অবস্থা শঙ্কাজনক। রাজনৈতিকভাবে তিনি যেই মতেরই অনুসারী হোন না কেন, এভাবে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হবেন, এটা ভাবা যায় না। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দীন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করলেন। আর শরিফ ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হলেন ঐদিন দুপুরে। আগামী বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি একযোগে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ ও গণভোট অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। তফসিল ঘোষণার পর জনমনে যেই উচ্ছ্বাস ও উদ্দীপনা থাকার কথা, সেটি মিইয়ে গেল ওসমান হাদিকে গুলিবিদ্ধের ঘটনায়। চারদিকে এখন থমথমে ভাব।রাজনৈতিক সব পক্ষ থেকে এ ঘটনার প্রতিবাদ ও বিবৃতি জানানো হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এ সন্ত্রাসী হামলার প্রতিবাদে মিছিল বের হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পরিচিত মুখ হয়ে উঠা ওসমান হাদি এখন জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। সবাই তাঁর ফিরে আসার প্রার্থনা করছেন। ওসমান হাদির ফেসবুক পেজ থেকে শরিফ ওসমান হাদির ওপর হামলাকে একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এটা একটা বার্তা। আর বার্তাটা খুব সোজা, রাজনীতির মাঠে যে কণ্ঠটা একটু আলাদা, আবার বড় দলগুলোর সরাসরি ছায়ায় নেই, তাকে আঘাত করো। কম ঝুঁকি, বেশি লাভ। ঘটনাটা ঘটেছে ১২ ডিসেম্বর ২০২৫, পল্টন থানাধীন বিজয়নগর বক্স কালভার্ট এলাকায়, দিনের আলোয়, জুমার পরের সময়ের মধ্যে। প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্যেও জুমার পরের কথাই এসেছে। পুলিশ বলছে, মোটরসাইকেল আরোহীরা গুলি করে পালিয়েছে।
ওসমান হাদি জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে গড়ে ওঠা প্ল্যাটফর্ম ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র, আবার ঢাকা-৮ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার কথা বলে মাঠে ছিলেন। পরে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল থেকে এভারকেয়ারে নেওয়ার খবরও আসে। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দিকটা হলো টাইমিং। তফসিল ঘোষণার পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই এমন একটা হামলা, এটাকে সাধারণ অপরাধ বলে উড়িয়ে দিলে বাস্তবতা ধরা পড়বে না। সংবাদ রিপোর্টে পরিষ্কার যে তফসিল ঘোষণার পরপরই ঘটনাটা ঘটেছে, আর দেশ এখন ফেব্রুয়ারি ২০২৬ নির্বাচনকে সামনে রেখে দাঁড়িয়ে। এই মুহূর্তে একজন পরিচিত মুখকে গুলি করা মানে এক ঢিলে অনেক পাখি মারা। জনমনে আতঙ্ক বাড়বে, রাজনৈতিক পক্ষগুলো সন্দেহ করবে, পাল্টা ভাষা আরও কড়া হবে, মাঠ আরও উত্তপ্ত হবে। নির্বাচনের আগের বাংলাদেশে অস্থিরতা তৈরি করার চেয়ে কার্যকর অস্ত্র খুব কম আছে। হাদিকে টার্গেট করার যুক্তিটা এখানেই। তিনি বিএনপি-জামায়াতের মতো বড় দলগুলোর প্রকাশ্য কর্মী নন। ইনকিলাব মঞ্চ নিজেকে আলাদা প্ল্যাটফর্ম হিসেবে তুলে ধরে, হাদি নিজেও সেই পরিচয়ই সামনে রাখেন। ফলে তাঁকে আঘাত করলে কোনো দল দলীয় আক্রমণ বলে সঙ্গে সঙ্গে পুরো মেশিন নামাবে না, কিন্তু জনমনে তার প্রতিক্রিয়া হবে বড়। কারণ, হাদি এক বছরের বেশি সময় ধরে জনপরিসরে দৃশ্যমান ছিলেন, শক্ত ভাষায় কথা বলতেন, যার অনেক কথা নিয়ে সমালোচনা তৈরি হয়, সেই কথার সঙ্গে যেমন কিছু মানুষ একমত হয়েছেন, তেমনি অনেকে বিরোধিতা করেছেন, কিন্তু মানুষ তাঁকে শুনতেন।এই শোনা,এই দৃশ্যমানতা, এই আবেগই তাঁকে হাই ভ্যালু টার্গেট করে তোলে।অন্যদিকে আমাদের দেশে নিরপেক্ষ শব্দটা যতটা গ্ল্যামারাস, ততটাই বিপজ্জনক। দলীয় রাজনীতির ছায়া না থাকলে আপনি স্বাধীন থাকেন, কিন্তু একা থাকেন। নিরাপত্তা, সংগঠন, শৃঙ্খলা, পাল্টা চাপ তৈরি করার ক্ষমতা, এগুলো একা থাকলে কমে যায়। হাদির ক্ষেত্রে এই একা থাকার সুবিধা আর ঝুঁকি দুটোই কাজ করেছে।
এখন প্রশ্ন আসছে, রাষ্ট্র কোথায় ছিল? ৫ আগস্ট ২০২৪-এর সরকার পতনের পর দেশ একটা দীর্ঘ ট্রানজিশনের পথে যাত্রা করেছে, ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন। সেই সময় মানুষ ভাবছিল আইনশৃঙ্খলা ঠিক হবে,ভয়ের চক্র থামবে, নির্বাচন হবে, ক্ষমতা হস্তান্তর হবে। রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আইনশৃঙ্খলা নিয়ে রাষ্ট্র বারবার আশ্বাস দিয়েছে, মাঠে মানুষ বারবার অনিশ্চয়তা দেখেছে। তফসিল ঘোষণার পরদিন দিনের আলোয় একজন প্রার্থী এবং রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের মুখপাত্রকে গুলি করার ঘটনা সেই অনিশ্চয়তাকে নগ্ন করে দিল। রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে এসেছে। প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর দ্রুত তদন্ত ও গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছে। পুলিশও 'মনুষ্য-শিকার' বলছে। কিন্তু সমস্যা কেবল নির্দেশে না, সমস্যাটা হলো বিশ্বাসে। মানুষ কাগজে নির্দেশ দেখে না, মানুষ রাস্তায় নিরাপত্তা দেখে। মানুষ দেখে, নির্বাচনের আগের মাঠে কে হাঁটতে পারছে, কে হাঁটতে ভয় পাচ্ছে। বাংলাদেশ এখন দুটি বড় জটিলতার মাঝখানে দাঁড়িয়ে। একদিকে আওয়ামী লীগ-বিরোধী শক্তিগুলো আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত পরাজয় চায়, অন্যদিকে আওয়ামী লীগপন্থীরা রাজনীতিতে ফিরে আসতে চায়। এই দুই জটিলতা যখন প্রতিশোধের ভাষায় কথা বলে, তখন সরকারের কাজ ছিল মাঝখানে দাঁড়িয়ে অভিভাবক হওয়া। কিন্তু গত এক-দেড় বছরে অনেক ঘটনায় আমরা দেখেছি, সরকার অনেক সময় জনপ্রিয় আবেগের পেছনে হেঁটে গেছে, সামনে হেঁটে পরিস্থিতি সামলাতে পারেনি। ৫ আগস্টের পরে সচেতনভাবে বাংলাদেশকে গৃহযুদ্ধের পথে নেওয়ার প্রথম পদক্ষেপ ছিল ৩২ নম্বর বাড়িটি ভেঙে ফেলা, এবং তা করা হলো গণ-অভ্যুত্থানের পাঁচ মাস পর এসে। ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫-এ মব করে ওই বাড়িটি ভাঙচুর করে, পরে তা গুঁড়িয়ে দেওয়ার দৃশ্য দেশ দেখেছে। ওই ঘটনায় রাষ্ট্রের নির্লিপ্ততা ও নিয়ন্ত্রণহীনতা একদিকে প্রতিশোধের রাজনীতিকে উসকে দিয়েছে।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগকে ভিকটিমহুডের শক্ত প্রতীক দিয়েছে। বাংলাদেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার দ্বিতীয় ধাপ হলো জুলাই আন্দোলনের পরিচিত মুখ হাদির ওপর নৃশংস হত্যাচেষ্টা। বেশ কিছুদিন ধরে পতিত শক্তির কাছ থেকে হত্যার হুমকি পাচ্ছিলেন বলে অভিযোগ করেছিলেন তিনি। কিন্তু হাদি এখনো আশঙ্কা জনক অবস্থায় রয়েছেন। তাঁকে হারালে এর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। জুলাই অভ্যুত্থানের শক্তি ও পতিত শক্তি এক অন্তহীন সংগ্রামে জড়িয়ে পড়তে পারে, যার শেষ কোথায় গিয়ে থামবে আমরা কেউ জানি না। ভয়ের আরেকটা কারণ হচ্ছে, হামলাটা ঘটেছে এমন এক সময়ে, যখন নির্বাচন নিয়ে ইতিমধ্যে বড় উত্তেজনা আছে, দলগুলোর মধ্যে অবিশ্বাস আছে, আর কে নির্বাচন ঠেকাতে চায় এই সন্দেহ বাতাসে ভাসছে। ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এর ভোট হবে, তফসিল হয়েছে, আর দেশ এক টান টান রাজনৈতিক পর্বে ঢুকেছে। এই টান টান সময়ের প্রথম বড় আঘাত যদি এমন হয়, তাহলে সামনে আরও খারাপ ঘটনাও অস্বাভাবিক নয়। এই পরিস্থিতি সরল দাবি হচ্ছে, এই ঘটনা তদন্তের নামে লম্বা সময়ের নাটক বানালে চলবে না। এখানে কেবল অপরাধী ধরার প্রশ্ন না, এখানে রাষ্ট্রের সক্ষমতা দেখানোর প্রশ্ন। সরকারকে এখনই সঠিক কাজগুলো করতে হবে।হাদির ঘটনায় তদন্তের অগ্রগতি নিয়মিতভাবে জানাতে হবে, যেন গুজব জায়গা না পায়। নির্বাচনী মাঠে প্রার্থী এবং রাজনৈতিক কর্মীদের নিরাপত্তা নিয়ে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নিতে হবে, কাগজে না, রাস্তায়। আগামী দিনে উত্তেজনা বাড়া ঠেকাতে সরকারকে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কিংবা অনানুষ্ঠানিকভাবে উচ্চপর্যায়ের যোগাযোগ খুলতে হবে, ন্যূনতম সংযমে সবাইকে একমত করাতে হবে এবং সামনে যাই উসকানি আসুক না কেন, নির্বাচনী পরিবেশ শান্ত রাখার জন্য সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। সবচেয়ে জরুরি বিষয় হচ্ছে, সরকারকে নিরপেক্ষতার অভিনয় নয়, নিরপেক্ষতার কাজ করতে হবে। কারও আবেগকে প্রশ্রয় দিলে সেটাই পরে রাষ্ট্রের ওপর ফিরে আসে।শেষ প্রশ্নটা তাহলে থেকেই যায়।
তফসিল ঘোষণার পরের দিনের এই গুলির শব্দ কি শুধু একজন মানুষকে আঘাত করেছে, নাকি নির্বাচনকে, শান্তিকে, ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের পথে ফেরত যাওয়ার সুযোগকে আঘাত করেছে? এর উত্তরটা কঠিন নয়। এটা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক যাত্রার ওপর একটা সচেতন আঘাত। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগের দাবিতে বিভিন্ন সংগঠন আন্দোলনও করেছে। একবার বঙ্গভবন ঘেরাও কর্মসূচিও পালন করা হয়েছে। চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতারা কখনো রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনকে মানতে পারেননি। তাঁর পদত্যাগের দাবিতে বহুবার আন্দোলন হয়েছে। একবার বঙ্গভবন ঘেরাও কর্মসূচিও পালন করে কয়েকটি সংগঠন। কয়েকটি রাজনৈতিক দলও তাঁর অপসারণের পক্ষে ছিল।কিন্তু বিএনপি সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার কারণে নতুন রাষ্ট্রপতি না আসা পর্যন্ত তাঁকে রেখে দেওয়ার কথা বলে আসছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হলে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সুযোগও তৈরি হবে। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যতজন রাষ্ট্রপতি এসেছেন, তাঁদের মধ্যে দুজন নিহত হয়েছেন সেনা অভ্যুত্থানে। দুজন দণ্ডিত হয়েছেন আদালতে। আবার ক্ষমতাসীনদের বিরাগভাজন হয়ে অসম্মানজনক পথে বিদায় নিতে হয়েছে কাউকে কাউকে। জুলাই সনদের সাংবিধানিক আদেশ কার নামে হবে, সে নিয়েও বিতর্ক উঠেছিল। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার আদেশ আদালতে চ্যালেঞ্জ হবে, এই বিবেচনা থেকে সেটাও বাদ দিতে হয়। শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির নামেই আদেশ জারি হয়। যেমন আওয়ামী লীগ সরকার বিতাড়িত হওয়ার পর তাঁর নামেই সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ চাওয়া হয়েছিল। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে ইতিহাসের সেরা ও স্মরণীয় নির্বাচন করা দূরে থাক, মোটামুটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করাও কঠিন হবে। প্রশাসনে এখন নানামুখী ধারা চলছে। তফসিল ঘোষণার পর প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্বাচন কমিশনের আওতায় চলে গেলেও এর ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ নেই এটাও বিবেচনায় রাখতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ আর রক্তে ভেজা লাশ দেখতে চায় না, শান্তি চায়।
লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক, যুক্তরাজ্য
এমএসএম / এমএসএম
গণতান্ত্রিক যাত্রার ওপর সচেতন আঘাত
গুলির শব্দের মধ্যে তফসিল ঘোষণা,এ কোন গণতন্ত্রের প্রতিচ্ছবি?
নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা, যখন লড়াই হয় অহিংস ও গণতান্ত্রিক!
দলবদলের রাজনীতিতে আদর্শ প্রশ্নবিদ্ধ
গাজায় যুদ্ধ বিরতি নাকি পশ্চিমাদের যুদ্ধের কৌশল
পুতিনের ভারত সফরে কী বার্তা পেল বিশ্ব
নৈতিক ও অস্তিত্বগত সংকটে বিশ্ব
পরিশুদ্ধ রাজনীতির পরিবেশ ফিরিয়ে আনা খুবই জরুরি
তারেক রহমানের প্রতিশ্রুতি ও জনগণের আকাঙ্ক্ষা
জ্বালানি ব্যবস্থায় আমদানিনির্ভরতা কমাতে করণীয়
ইউরোপ আমেরিকার সম্পর্কের টানাপোড়েন
জুলাই সনদ, গণভোট ও নির্বাচন