ঢাকা শুক্রবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৫

ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে দক্ষিণ এশিয়া


রায়হান আহমেদ তপাদার  photo রায়হান আহমেদ তপাদার
প্রকাশিত: ১৮-১২-২০২৫ দুপুর ১০:১০

এশিয়া ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশের মত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতেও প্রাকৃতিক দূর্যোগ একটি নিত্য নৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এসব দেশের জনগণও ঝড় ঝঞ্জা মোকাবিলায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। কিন্ত ভূমিকম্পের বিষয়টি একেবারেই আলাদা। এ যে কখন ঘটবে তা এখন পর্যন্ত আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে পূর্বাভাস করা সম্ভব হয়ে উঠছে না। ভূমিকম্পের দুর্যোগ কখন আসবে কাঁপিয়ে তুলবে তার দিনক্ষণ সুনির্দিষ্ট করে পূর্বাভাস দেয়া যায় না। তবে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, ভূতাত্তিক বা ভূস্তরের ভেতরের গঠন-বৈশিষ্ট্য, বিভিন্ন ধরনের ভূতাত্তিক পরিবর্তনের আলামত এবং এ অঞ্চলে ভূমিকম্পের ইতিহাসক্রম থেকে ভূতত্ত বিজ্ঞানীরা সতর্ক করছেন, অদূর ভবিষ্যতে যে কোন সময়েই শক্তিশালী ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে। নীরব হলেও পৃথিবীর অন্যতম ভূমিকম্প-প্রবণ বলয়ে বাংলাদেশ ও এর আশপাশ অঞ্চলের অবস্থান। মাঝেমধ্যে ছোট ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পগুলো বড়সড় বিপদের আগেই সজাগ হওয়ার জন্য ইশারা মাত্র। এর ধারাবাহিকতায় প্রবল ভূমিকম্প সংঘটিত হতে পারে। এ অবস্থায় বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে দেশ। তাছাড়া রাজধানী ঢাকা ও এর চারপাশ, বন্দরনগরী চট্টগ্রাম, সিলেট নগরী, কক্সবাজারসহ দেশের শহর-নগর-শিল্পাঞ্চলে যথেচ্ছ অপরিকল্পিত বাড়িঘর ভবন তৈরি হচ্ছে। নদী-খাল-পুকুর-জলাশয় ভরাট, প্রকৃতির পেরেক পাহাড় ও টিলা কেটে-খুঁড়ে ধ্বংস, রাস্তাঘাট-সড়ক- গলি, খোলা জায়গা ক্রমাগত বেদখল ও সরু হয়ে যাচ্ছে। পরিণামে বাড়ছে ভ মিকম্পের ঝুঁকির মাত্রা। যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর ও বাংলাদেশের গবেষকদলের ‘নেচার জিওসায়েন্স’ জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়, ভূ-গঠন বৈশিষ্ট্য নিয়ে বাংলাদেশ যে অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে তাতে বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে।
এক দশক আগে ২০১৫ সালের নেপাল ভূমিকম্পে প্রায় নয় হাজার মানুষ নিহত হন এবং ২০২৫ সালের মার্চে মিয়ানমারে সাত দশমিক সাত মাত্রার ভূমিকম্পে তিন হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়।এই অঞ্চলে শুধু গত এক দশকে বেশ কয়েকটি প্রাণঘাতী ভূমিকম্প হয়েছে, যাতে প্রাণহানি এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমানও কম নয়। কিন্তু এমনটা কেন হয়? দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলাে কি ভূমিকম্পপ্রবণ? এর উত্তর লুকিয়ে আছে এই অঞ্চলের ভূপৃষ্ঠের অনেক অনেক গভীরে যেখানে রয়েছে জটিল টেকটোনিক প্লেটের বিন্যাস।এই প্লেটগুলো ক্রমাগত সরতে থাকায় বারবার ভূমিকম্প হয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো বহু টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত। যেমন, ভারতীয় প্লেট, ইউরেশিয়ান প্লেট, ইন্দো-অস্ট্রেলিয়ান প্লেট, সুন্দা প্লেট, বার্মিজ প্লেট এবং প্যাসিফিক প্লেট। ভারতীয় প্লেট প্রতি বছর প্রায় পাঁচ সেন্টিমিটার করে উত্তর দিকে সরছে এবং ইউরেশিয়ান প্লেটের সঙ্গে ধাক্কা খাচ্ছে। এমন সংঘর্ষ থেকেই যেমন এক সময় হিমালয় পর্বতমালার সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি এখন প্রচণ্ড ভূ-ভৌগোলিক চাপ সৃষ্টি করছে এবং প্রাচীন ফল্ট লাইনগুলোকে পুনরায় সক্রিয় করে তুলছে। দক্ষিণ এশিয়ার ভৌগোলিক রূপ বেশ জটিল।এখানে আছে উঁচু উঁচু পাহাড় ও গভীর উপত্যকা, সেইসাথে আছে নরম পলি বা বালুকাময় মাটি, বিশেষ করে ভারত ও বাংলাদেশে। এই ভৌগলিক রূপ ভূমিকম্পের তীব্রতা আরও বাড়িয়ে দেয়।এ অঞ্চলে টেকটোনিক প্লেটগুলোর অবস্থানও অগভীর ভূমিকম্পের সৃষ্টি করে, যা আরো বেশি ধ্বংসাত্মক, কারণ এতে বিস্তৃত এলাকার পৃষ্ঠ তীব্রভাবে কেঁপে ওঠে। এছাড়া এই অঞ্চলের বেশিরভাগ ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা ঘনবসতি হওয়ায় হতাহতের সংখ্যাও বেশি হয়। কাবুল, ইসলামাবাদ, দিল্লি, কাঠমান্ডু এবং ঢাকার মতো বড় শহরগুলোর অবস্থান মূল ফল্ট সিস্টেমের কাছাকাছি হওয়ায় এখানকার কোটি কোটি মানুষ ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছে। দ্রুত নগরায়ন এবং নিরাপত্তা মানদণ্ড না মেনে করা নির্মাণকাজও এ অঞ্চলের ভবন ও স্থাপনাগুলোকে বিপজ্জনক করে তুলেছে।
উদাহরণস্বরূপ, আফগানিস্তানের গ্রামীণ অঞ্চলের অধিকাংশ বাড়ি কেবল মাটি ও পাথরের তৈরি, ফলে মধ্যম মাত্রার ভূমিকম্পেও বহু মানুষ হতাহত হয়। ভারতে বেশ কয়েকটি সক্রিয় ফল্ট সিস্টেম রয়েছে এবং সেখানে ইন্ট্রাপ্লেট ভূমিকম্প অর্থাৎ একটি টেকটোনিক প্লেটের মধ্যে যে ভূমিকম্প হয়, তাও অনুভূত হয়েছে, যা অনেক সময় প্রাচীন ফল্ট লাইনের পুনরায় সক্রিয় হওয়ার কারণে ঘটে। ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় দ্রুত নগরায়ণও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়ি দিয়েছে।বাংলাদেশও একাধিক ফল্ট লাইনের ওপর অবস্থিত, যেমন ডাউকি ফল্ট, সিলেট ফল্ট এবং চেরদাং ফল্ট, যেগুলো সাম্প্রতিক সময়ে সক্রিয় হয়েছে এবং ভূমিকম্প দেখা যাচ্ছে। তবে দক্ষিণ এশিয়ার ভৌগোলিক অবস্থান ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে দিয়েছে এবং ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগের ক্ষেত্রে সংবেদনশীল করে তুলেছে, কারণ বিশ্বের সবচেয়ে বড় নদী ডেল্টা, সুন্দরবন ডেল্টা বাংলাদেশের বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। পাকিস্তানেও বেশ কিছু প্রধান ফল্ট লাইন রয়েছে, যেমন চামান ফল্ট এবং মেইন ম্যান্টল থ্রাস্ট বিশেষভাবে সক্রিয়। খাইবার পাখতুনখাওয়া, গিলগিত-বালতিস্তান এবং বেলুচিস্তানে সময়ের সাথে সাথে গভীর এবং অগভীর উভয় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে। তবে, ২০০৫ সালে কাশ্মীরে সাত দশমিক ছয় মাত্রার ভূমিকম্পটি এ অঞ্চলের সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল, যেখানে ৮০ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যায়।
পাকিস্তানেও বেশ কয়েকটি প্রধান ফল্ট রয়েছে বিশেষত চামান ফল্ট এবং মেইন মান্টল থ্রাস্ট সক্রিয়। তবে, দক্ষিণ এশিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে নেপালে।কারণ দেশটি সরাসরি ভারতীয় প্লেট ও ইউরেশিয়ান প্লেটের সংঘর্ষসীমার ওপর অবস্থিত এবং এখানে বড় বড় ফল্ট সিস্টেম রয়েছে। এখানকার পাহাড়ি ভূপ্রকৃতি ভূমিধস এবং হিমবাহ হ্রদ উপচে বন্যার ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে,সময়ের সাথে কি পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে? মানুষ ও পরিবেশগত কারণ, সেইসাথে এ অঞ্চলের অনন্য ভূতাত্ত্বিক গঠন মিলিয়ে ভবিষ্যতে দক্ষিণ এশিয়ায় তীব্র ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে, যেখানে ধ্বংসযজ্ঞ ভয়াবহ হতে পারে। শত শত বছর ধরে জমে থাকা টেকটোনিক চাপ বড় এবং আরো শক্তিশালী ভূমিকম্পের সৃষ্টি করতে পারে। যদিও প্যাসিফিক রিং অফ ফায়ার অঞ্চলের দেশগুলোতে ভূমিকম্প বেশি হয় এবং সেগুলো শক্তিশালী মাত্রার হয়। তবুও হিমালয় অঞ্চল শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সঞ্চিত প্রচণ্ড টেকটোনিক চাপের কারণে সবচেয়ে বিপজ্জনক ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলের একটি। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন যে নেপাল, ভারত, ভুটান এবং পাকিস্তান জুড়ে বিস্তৃত হিমালয় অঞ্চলে আট বা তার বেশি মাত্রার বড় হিমালায়ান ভূমিকম্প হতে পারে। প্রাচীন এবং নিস্ক্রিয় ফল্ট লাইনগুলোর পুনরায় সক্রিয় হয়ে ওঠাও ভূমিকম্পের প্রবণতাকে আরো বাড়িয়ে তুলছে, যা প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সারা পৃথিবীতে প্রতিবছর প্রায় আট লাখ বারেরও বেশি ভূমিকম্প হয়। কিন্তু এর মাত্রা ৩.৪ এর নিচে থাকায় সাধারণত মানুষের পক্ষে তা সবসময় বুঝে ওঠা সম্ভব হয়না। এটা শুধুমাত্র সিসমোগ্রাফ যন্ত্রেই ধরা পড়ে। তবে ৪.২ মাত্রার ভূমিকম্প সারা বছরে ঘটে প্রায় তিরিশ হাজার বারেরও বেশি। মধ্যবর্তি পর্যয়ের ভূমিকম্প ছাড়াও ৭ বা ততোধিক মাত্রার ভূমিকম্প ঘটে বছরে ১৫টির মতো। ৮ মাত্রার ভূমিকম্প সাধারণত প্রতি পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্যে একটি বা দু'টি ঘটে থাকে। ভূমিকম্প প্রবণ এলাকাগুলোর মানুষকে তাই জীবন যাত্রার ক্ষেত্রে নিয়তই সতর্কতার সাথে পদক্ষেপ নিতে হয়। তা না হলে জীবন ক্ষেত্রে ঘটে যেতে পারে দারুণ বিপর্যয়। পৃথিবী এখন আধুনিক প্রযুক্তিতে এগিয়ে গেছে অনেক দূর। 
মানুষ প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করে শিখেছে কী করে এর বিরুদ্ধে যতটা সম্ভব প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়। আর তাই ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলায় সারা বিশ্বে শহরায়নের ক্ষেত্রে বিশেষ করে সুউচ্চ মানের ভবনসহ বিভিন্ন পর্যয়ের নির্মাণে অত্যাধুনিক মানের নির্মাণ উপকরণ ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ছাড়া একটি সুনির্দিস্ট পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে প্রতিটি সচেতন মানুষকেই। উন্নয়নমূখী দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সরকার ও জনগণ যদি অবিলম্বে সতর্ক অবস্থান গ্রহণ করে যথাযথ ব্যবস্থা না নেয় তা নাহলে বিপর্যয়ের মাত্রা অধিক হারে বেড়ে যেতে পারে বলে বিশ্বের ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞদের ধারণা। ভূমিকম্প নিয়ে যতটা ভয়-আতঙ্ক সেই তুলনায় সব পর্যায়ে এই দুর্যোগের ব্যাপারে আগাম সতর্কতা ও প্রস্তুতিতে পেছনে পড়ে আছে বাংলাদেশ। বিজ্ঞানীরা বলছেন, পরিকল্পিত নগরায়ন, পাহাড়-টিলা, জলাশয়, নদী-নালা-খাল, ভ‚মিরূপ, পরিবেশ-প্রকৃতিকে সুরক্ষা, ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড কঠোরভাবে অনুসরণ, প্রাক-প্রস্তুতি ও গণসচেতনতা প্রয়োজন।ভূতত্তবিজ্ঞানী ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ভূমিকম্প নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার চেয়ে এ সম্পর্কে সচেতন হওয়া বেশি জরুরি। ভবন তৈরির সময়ে যথাযথ বিল্ডিং কোড মেনে চলা, সর্বোপরি ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচতে করণীয় কী সেসব জানা জরুরি। অতীতে সংঘটিত শক্তিশালী মাত্রার ভূমিকম্প বর্তমানে রাজধানী ঢাকায় বা এর আশপাশে হলে কী ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি হবে, তা কল্পনা করলে আতঙ্কিত না হয়ে পারা যায় না। কারণ ঢাকা শহরে কেবল পুরোনো নয়, অতি পুরোনো অনেক ভবনও রয়েছে। সেসব ভবনে ঝুঁকি নিয়েই অনেক মানুষ বসবাস করছেন। ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি ন্যূনতম পর্যায়ে রাখার জন্য এ বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। সরকারকেই এ বিষয়ে মুখ্য দায়িত্ব পালন করতে হবে।
লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক, যুক্তরাজ্য

Aminur / Aminur

ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে দক্ষিণ এশিয়া

রক্তে কেনা বিজয়ের চেতনায় উদ্ভাসিত হোক হৃদয়

গণতান্ত্রিক যাত্রার ওপর সচেতন আঘাত

গুলির শব্দের মধ্যে তফসিল ঘোষণা,এ কোন গণতন্ত্রের প্রতিচ্ছবি?

নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা, যখন লড়াই হয় অহিংস ও গণতান্ত্রিক!

দলবদলের রাজনীতিতে আদর্শ প্রশ্নবিদ্ধ

গাজায় যুদ্ধ বিরতি নাকি পশ্চিমাদের যুদ্ধের কৌশল

পুতিনের ভারত সফরে কী বার্তা পেল বিশ্ব

নৈতিক ও অস্তিত্বগত সংকটে বিশ্ব

পরিশুদ্ধ রাজনীতির পরিবেশ ফিরিয়ে আনা খুবই জরুরি

তারেক রহমানের প্রতিশ্রুতি ও জনগণের আকাঙ্ক্ষা

জ্বালানি ব্যবস্থায় আমদানিনির্ভরতা কমাতে করণীয়

ইউরোপ আমেরিকার সম্পর্কের টানাপোড়েন