ওসমান হাদির বিদায় ও তরুণ প্রজন্মের স্বপ্ন
ইনকিলাব মঞ্চের অকুতোভয় মুখপাত্র এবং চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর শরিফ ওসমান হাদির অকাল ও আকস্মিক মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস সহ গোটা দেশের মানুষ। সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম অগ্রনায়ক এবং ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি মৃত্যুবরণ করেন। শরিফ ওসমান হাদি কেবল একজন সংগঠকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন জুলাই বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশের এক স্বপ্নদ্রষ্টা। ফ্যাসিবাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রাজপথের লড়াই থেকে শুরু করে জনমত গঠনে তার সাহসী ভূমিকা দেশবাসীর হৃদয়ে চিরজাগরূক থাকবে। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে তার মতো একজন ত্যাগী ও দেশপ্রেমিক তরুণের বিদায় জাতির জন্য এক অপূরণীয় শূন্যতা সৃষ্টি করল। যা কোনোভাবেই পুরণ করা সম্ভব নয়। জুলাই ঐক্যের পক্ষ থেকে দেশের বিপ্লবী জনগণকে ধৈর্য ধারণ করার আহ্বান জানানো হলেও এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত রাজপথে থাকার সংকল্প ব্যক্ত করা হয়েছে। গত ১২ ডিসেম্বর রাজধানীর বিজয়নগরে সন্ত্রাসী হামলায় মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন শরিফ ওসমান হাদি। বিজয়ের ৫৫ বছরে দাঁড়িয়ে আমাদের অনুভূতি গর্ব ও গ্লানিতে মিলেমিশে আছে। গর্ব এই কারণে যে, ১৯৭১ সালে এই দেশের মানুষ ভাষা, সংস্কৃতি ও মর্যাদার প্রশ্নে আপসহীন থেকে উপনিবেশবাদ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে অসম সাহসে লড়েছিল। আবার গ্লানি এই কারণে যে, এত বছর পরও আমরা সেই বিজয়ের পূর্ণ অর্থ বাস্তবে রূপ দিতে পারিনি।
বৈষম্য, দমন-পীড়ন ও দুর্নীতির ফলে স্বাধীনতা বহু সময় নাগরিকের অধিকার হিসেবে নয়, রাষ্ট্রের ক্ষমতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। কিন্ত বাস্তবতা হচ্ছে, দেশ বদলাতে হলে রাজনীতি বদলাতে হবে। রাজনীতি বদলাতে হলে, রাজনীতিবিদ বদলাতে হবে। হাদি সেই রাজনীতিকে বদলে দেওয়া রাজনীতিবিদ। রাজনীতি করা, আর নেতা হওয়া এক বিষয় নয়। একজন রাজনীতিবিদকে সত্যিকারভাবে নেতা হতে হলে কিছু গুণাবলি থাকতে হয়। প্রয়োজন সততা, সৎসাহস, সুশিক্ষা, দেশপ্রেম, নির্লোভতা ও দূরদর্শিতা। হাদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়াশোনা করে, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। বাংলাদেশের কিছু রাজনীতিবিদদের অন্যতম খারাপ দিক হলো ব্যক্তিগত লোভ, দুর্নীতি এবং নিজের ও নিজ দলের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া। কিন্তু হাদি ছিলেন ব্যতিক্রম। একমাত্র রাজনীতিবিদ হাদি, যিনি সব আর্থিক হিসাব-নিকাশ প্রকাশ্যে জনগণকে জানাতেন। তার রাজনীতি ও ইনকিলাব মঞ্চ পুরোপুরি চলত জনগণের স্বেচ্ছা অনুদানে। নিজেও পরিবার নিয়ে ঢাকায়, খুবই সাধারণ জীবনযাপন করতেন। যেদিন তাকে গুলি করা হয়, সেদিন তার গ্রামের বাড়িতে চুরি হয়। টেলিভিশনে তার গ্রামের বাড়ির ঘর দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, তার আর্থিক সামর্থ্য নেই মায়ের জন্য ভালো একটি ঘর বানানোর। হাদি চাইলে, জুলাইয়ের পর অনেক টাকা আয় করতে পারতেন। কিন্তু তিনি করেননি। হাদির সবচেয়ে বড় গুণ ছিল বাংলাদেশের অন্যায়, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, রাজনীতিবিদদের দুর্বলতা ও রাষ্ট্রের মৌলিক সমস্যাগুলো নিয়ে প্রকাশ্যে গলা ফাটিয়ে কথা বলা। এ ধরনের সাহস কেবল সৎ ও দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদদেরই থাকে। হাদি সবসময় বলতেন, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তার রাজনীতির অনুপ্রেরণা। গত চল্লিশ বছরে হাদির মতো সৎ, নির্লোভ ও সাহসী নেতা আমাদের চোখে দেখিনি।
ওসমান হাদি মোটেও বিদ্বেষী ছিলেন না। তিনি প্রতিপক্ষকে কথার আক্রমণে ছোট করায় বিশ্বাস করতেন না। এখন প্রশ্ন হলো, হাদিকে কারা এবং কেন হত্যার পরিকল্পনা করল? উত্তর খুবই সহজ : যারা হাদিকে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তের বলয় ভেঙে ফেলার হাতিয়ার মনে করে। ফাঁসির আসামি শেখ হাসিনা এবং তার সহযোগী খুনিরা প্রকাশ্যে, প্রতিনিয়ত জুলাই যোদ্ধাদের প্রাণনাশের হুমকি ও পরিকল্পনার কথা অনেক দিন ধরেই জানিয়ে আসছে। এই খুনি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে হাদি একমাত্র রাজনীতিবিদ, যিনি বিরতিহীনভাবে গত দেড় বছর রাজপথে প্রকাশ্যে কথা বলেছেন। এনসিপির নেতারাও বলেছেন, তবে হাদির মতো অনবরত ও রাজপথে উচ্চৈঃস্বরে কেউ বলেননি। এরই ফলশ্রুতিতে হাদি, খুনি গোষ্ঠীর কাছ থেকে বিদেশ থেকে অসংখ্য হত্যার হুমকি পেয়েছে। কিন্তু দেশের ভেতর থেকেও সে হুমকি পেয়েছে, কেন এবং কীভাবে! হাদি প্রকাশ্যে ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সিংহের মতো হুঙ্কার দিত প্রতিনিয়ত। ভারত যেহেতু গণহত্যাকারীদের আশ্রয় দিয়ে তা নিয়ে গর্ব করছে, সেখানে তাদের বিরুদ্ধে হাদির অবস্থান স্বাভাবিক ভাবেই তাকে তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে, হাদি হত্যার হুমকির রিপোর্ট ছিল। কিন্তু সরকার তেমন চিন্তিত হয়নি। হাদির ওপর হামলার ঝুঁকির নির্দিষ্ট রিপোর্ট থাকা সত্ত্বেও, তাকে কেন প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দেওয়া হলো না? হত্যাকারী শনাক্ত হওয়ার পরও, এ পর্যন্ত সরকার তাকে ধরতে পারেনি। অথচ হত্যাকারী ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর, সরকার ৫০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে। এখনো জুলাই যোদ্ধাদের চিকিৎসা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়নি।হাদি খুব ভালোভাবেই জানত যে, তার জীবন হুমকির মুখে। কিন্তু সে এমনই সাহসী ও দেশপ্রেমিক যে, জীবন হারানোর আশঙ্কাকে সে কোনো গুরুত্বই দিত না। সে বহুবার বলেছে, দেশের জন্য কারও বুলেটের আঘাতে মৃত্যু হলে সেটাই হবে তার জন্য সম্মানজনক মৃত্যু।
মৃত্যুর ভয়ংকর সম্ভাবনা জেনেও, মাত্র দশ মাস বয়সী সন্তানের বাবার মুখে এমন কথা বলা সম্ভব একমাত্র হাদির পক্ষেই। এটা তখনই সম্ভব যখন একজন মানুষ সৎ, নির্লোভ দেশপ্রেমিক হয়ে জনগণের জন্য কথা বলেন। না হলে, এমন সাহস হওয়ার কথা না। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলছেন, এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এটা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এর দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নিতে হবে। খুনিকে ধরতে ৫০ লাখ টাকা ঘোষণা করা হয়েছে। এর মানে তাদের ধরার ক্ষমতা নাই। এই স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাটা দিয়ে নির্বাচন হবে না। তাকে পদত্যাগ করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে বলবো, দায়িত্বশীল পদে থেকে এরকম বক্তব্য দেয়া যায় না। সীমান্তের ওপারে যারা আছে তারা আমাদের বন্ধু না। গোয়েন্দা সংস্থা থাকতে কীভাবে হামলাকারীরা ভারতে পালায়? আওয়ামী লীগ আমলে তারা মাইক্রোস্কোপ দিয়ে খুঁজে বিএনপি,জামায়াত বের করতো। এই মাইক্রোস্কোপগুলো গেল কোথায়?দেশে কাউন্টার ক্যু করে শৃঙ্খলা নষ্ট করা হয়। দেশের খলনায়ক প্রশাসনের ভেতরে ঘাপটি মেরে আছে। এরা কারা খুঁজে বের করা প্রয়োজন। এরাই নির্বাচনকে ভণ্ডুল করার চেষ্টা চলছে। মনে রাখতেই হবে, বর্তমানের সুশীলরাই আরেক অশনি সংকেত।অভ্যুত্থানের শক্তিকে নিজদের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখতে হবে। জুলাই অভ্যুত্থানের শক্তি ও পতিত শক্তি এক অন্তহীন সংগ্রামে জড়িয়ে পড়তে পারে, যার শেষ কোথায় গিয়ে থামবে আমরা কেউ জানি না। ভয়ের আরেকটা কারণ হচ্ছে, হামলাটা ঘটেছে এমন এক সময়ে, যখন নির্বাচন নিয়ে ইতিমধ্যে বড় উত্তেজনা আছে, দলগুলোর মধ্যে অবিশ্বাস আছে, আর কে নির্বাচন ঠেকাতে চায় এই সন্দেহ বাতাসে ভাসছে। ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এর ভোট হবে, তফসিল হয়েছে, আর দেশ এক টান টান রাজনৈতিক পর্বে ঢুকেছে। এই টান টান সময়ের প্রথম বড় আঘাত যদি এমন হয়, তাহলে সামনে আরও খারাপ ঘটনাও অস্বাভাবিক নয়।
এই পরিস্থিতি সরল দাবি হচ্ছে, এই ঘটনা তদন্তের নামে লম্বা সময়ের নাটক বানালে চলবে না। এখানে কেবল অপরাধী ধরার প্রশ্ন না, এখানে রাষ্ট্রের সক্ষমতা দেখানোর প্রশ্ন। সরকারকে এখনই সঠিক কাজগুলো করতে হবে।হাদির ঘটনায় তদন্তের অগ্রগতি নিয়মিতভাবে জানাতে হবে, যেন গুজব জায়গা না পায়। নির্বাচনী মাঠে প্রার্থী এবং রাজনৈতিক কর্মীদের নিরাপত্তা নিয়ে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নিতে হবে, কাগজে না, রাস্তায়। আগামী দিনে উত্তেজনা বাড়া ঠেকাতে সরকারকে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কিংবা অনানুষ্ঠানিকভাবে উচ্চপর্যায়ের যোগাযোগ খুলতে হবে, ন্যূনতম সংযমে সবাইকে একমত করাতে হবে এবং সামনে যাই উসকানি আসুক না কেন, নির্বাচনী পরিবেশ শান্ত রাখার জন্য সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। সবচেয়ে জরুরি বিষয় হচ্ছে, সরকারকে নিরপেক্ষতার অভিনয় নয়, নিরপেক্ষতার কাজ করতে হবে। কারও আবেগকে প্রশ্রয় দিলে সেটাই পরে রাষ্ট্রের ওপর ফিরে আসে।২৪- এ জীবন দিয়ে দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করার লড়াই করেছে এরা। কিন্তু এখনও তারা শকুনদের নজর এড়াতে পারেনি। দুই বছর হতে না হতেই এই শকুনেরা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে, মানচিত্রকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে। তারা মনে করেছে, এক ওসমান হাদিকে হত্যা করে দেশের মানচিত্রকে আবার কুক্ষিগত করবে। কিন্তু এই তরুণ প্রজন্ম ও প্রত্যেক স্বাধীনতাকামী-বিপ্লবী এক-একজন ওসমান হাদি। এক আবু সাঈদ, লক্ষ আবু সাঈদে পরিণত হয়েছিল। একইভাবে এক ওসমান হাদি, লক্ষ ওসমান হাদিতে পরিণত হবে। পরিশেষে বলবো, চলে যাওয়া এই গণতন্ত্রকামি ওসমান হাদি পরপারে যেন ভালো থাকেন।
লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক, যুক্তরাজ্য
Aminur / Aminur
ওসমান হাদির বিদায় ও তরুণ প্রজন্মের স্বপ্ন
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কাগজে নয়, বাস্তবে চাই
ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে দক্ষিণ এশিয়া
রক্তে কেনা বিজয়ের চেতনায় উদ্ভাসিত হোক হৃদয়
গণতান্ত্রিক যাত্রার ওপর সচেতন আঘাত
গুলির শব্দের মধ্যে তফসিল ঘোষণা,এ কোন গণতন্ত্রের প্রতিচ্ছবি?
নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা, যখন লড়াই হয় অহিংস ও গণতান্ত্রিক!
দলবদলের রাজনীতিতে আদর্শ প্রশ্নবিদ্ধ
গাজায় যুদ্ধ বিরতি নাকি পশ্চিমাদের যুদ্ধের কৌশল
পুতিনের ভারত সফরে কী বার্তা পেল বিশ্ব
নৈতিক ও অস্তিত্বগত সংকটে বিশ্ব
পরিশুদ্ধ রাজনীতির পরিবেশ ফিরিয়ে আনা খুবই জরুরি