ঢাকা সোমবার, ২৫ আগস্ট, ২০২৫

ভাষার মাসে তারুণ্যের প্রত্যাশা


ইউছুব ওসমান, জবি  photo ইউছুব ওসমান, জবি
প্রকাশিত: ১৫-২-২০২২ দুপুর ১১:৩৮

হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যমণ্ডিত এবং সমৃদ্ধ একটি ভাষা আমাদের বাংলা ভাষা। পৃথিবী রবে যতদিন, বাংলা ভাষাও রবে ততদিন। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। বছর ঘুরে ফেব্রুয়ারি এলেই আমরা পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করি সব ভাষা শহীদদের, সেইসব ভাষা-সংগ্রামীদের যাদের বুকের তাজা রক্তে ৫২’তে রঞ্জিত হয়েছিল ঢাকার পিচঢালা রাজপথ। 'রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই' এ আন্দোলন শুধু ভাষার জন্য আন্দোলন ছিলো না, ছিলো প্রতিটি বাঙালির অস্তিত্বের আন্দোলন। ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির কাছে আত্মত্যাগ, শ্রদ্ধা ও অহংকারের মাস। বাঙালী জাতির কাছে বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে প্রেরণার মাস ফেব্রুয়ারি। মহান এ ভাষার মাসে বাংলা ভাষাকে নিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া তরুণ শিক্ষার্থীদের ভাবনা, মতামত ও প্রত্যাশা তুলে ধরেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাস সাংবাদিক ইউছুব ওসমান।


বাংলা ভাষা চর্চায় অনীহা নয়

'শহীদের রক্তে কেনা ফেব্রুয়ারির অমর একুশ;
ঝাঁঝালো কন্ঠে সুর তুলেছিলো মাতৃবুলি।
তাতেই শত্রুরা বুকে ছুঁড়েছিল গুলি,
খোকা আমার লুটিয়ে গেল ছিন্ন রাজপথে।
হাজার পথিক মাড়িয়ে গেল খোকার রক্তে ভেজা বুকে,
বুকপকেটের ধূসর চিঠি রাঙ্গিয়াছে রক্তবর্ণে।
৫২-র, শহীদের রক্তে কেনা মাতৃভাষা,
বাংলা আমার মাতৃনীড়ের স্বাধীনতা।'

ফেব্রুয়ারি মাসটি যেমন শ্রদ্ধার, তেমনি অহংকারের। এতো ভক্তি, শ্রদ্ধা ও অজস্র ভালোবাসার প্রাপ্য  এই দেশ-মাতার  বীর-দামাল ছেলেরা। যাদের নিরলস প্রচেষ্টা ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। মায়ের থেকে যে প্রথম ভাষা শিখে প্রত্যেক শিশু কথা বলা শুরু করে, তাই মাতৃভাষা। বাংলা আমাদের প্রাণের ভাষা৷ এই ভাষাতেই প্রত্যেক বাঙালি নিজের অনুভূতিগুলোকে প্রকাশ করতে পারে কোনো বাঁধা ছাড়াই। যাঁরা এই ভাষার জন্যে লড়ে নিজের প্রাণ বলিদান দিয়েছেন, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার দাবিদার তাঁরাই। 

কিন্তু বর্তমান বাঙালি সমাজে মানুষজন প্রতিনিয়তই পাশ্চাত্যের আদলে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যর্থ চেষ্টায় নিজেকে ডুবিয়ে রাখছে। বাংলার সাথে ইংরেজি, হিন্দির মিশ্রণে কোনো বীরত্ব নেই। বরং সঠিক সুন্দরভাবে বাংলা ভাষা চর্চাই আমাদের আদর্শ জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। যা আমাদের ভাষার মর্যাদা আরও বাড়িয়ে দিবে বিশ্বজুড়ে। তারুণ্যের অঙ্গীকার হোক, এই বাংলা ভাষাকে বুকে ধারণ করে, লালন করে ভাষার সুস্থচর্চা করা।

মুন্নি আক্তার প্রিয়া

 

একুশ মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখায়

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি? না,পারিনা। মা, মাতৃভাষা আর মাতৃভূমি -এই তিন সত্ত্বাই আমার পরিচয়। মা আমাকে পৃথিবীর মুখ দেখিয়েছিলেন, মাতৃভাষা আমায় নিজেকে প্রকাশ করার সুযোগ দিয়েছে; আর মাতৃভুমি আমাকে দিয়েছে একটা স্বাধীন ও সার্বভৌম আশ্রয়স্থল। যেখানে দাঁড়িয়ে আজ আমি আমার মুক্ত চেতনাকে বিকশিত করি। তাইতো একুশ আমার গর্ব, আমার অহংকার, আমার গৌরবময় সত্তা।

১৯৫২সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে ভাষার অধিকার আদায় করেছিলো বাঙালি তরুণরা। একবিংশ শতাব্দীর এ যুগেও একুশ যেনো তরুণদের শেখায় আত্মমর্যাদাবোধ, মাথা নত না করা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, যাবতীয় গোঁড়ামি আর সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে শুভবোধের অঙ্গীকার। একুশের চেতনা বুকে ধারণ করে এগিয়ে যাক নতুন প্রজন্ম।

ফারহানা খানম

 

জাগ্রত হোক মার্তৃভাষার চেতনা

আদি বাঙ্গালির সাংস্কৃতিক ও আর্থ-সামাজিক জীবন এবং ক্রমবিকাশের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে বাঙ্গালির শৌর্য-বীর্য যেন ধপ করে জ্বলে উঠার মাস এ ফেব্রুয়ারী। কিন্তু বর্তমানে স্মার্টনেস আর ট্রেন্ডের নামে অপসংস্কৃতি চর্চা, বাংলা ভাষাকে বিকৃতি, হেয় প্রতিপন্ন করা আর জুতা পায়ে শহীদ মিনারে উঠা, রাতে মাদকের আসর বসানো, ময়লার ভাগাড়ে পরিণত করাই এখন বাস্তবতা। যা শুধু ভাষা শহীদদের অপমান করাই নয়, জাতি হিসেবেও আমাদের জন্য লজ্জাজনক বিষয়।

সংবিধানে স্বীকৃত বাংলা রাষ্ট্রভাষা তথা জাতীয় ভাষা হওয়া সত্ত্বেও জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে এর প্রয়োগ ও প্রচলন নেই। সেখানে মহাদাপটে রাজত্ব করছে ইংরেজি, সেই সঙ্গে রাজত্ব করছে বিজাতীয়  সংস্কৃতি। তাই উচ্চশিক্ষা ও পারিপার্শ্বিক প্রায় সকল ক্ষেত্রেই বাংলার উপস্থিতি সংকুচিত হয়েছে। ঔপনিবেশিক শাসনের ভূত এখনও আমাদের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ভুবনে দাপটে শাসন চালিয়ে যাচ্ছে। মাতৃভাষা-রাষ্ট্রভাষা বাংলা মাথা হেঁট করে ক্রমে পিছু হঠছে। একুশের চেতনা আমাদের চেতনা থেকে নির্বাসিত।  এ অবস্থার পরিবর্তন নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে হবে বলে আমার মনে হয় না। দরকার একটি সচেতন জাগরণ এবং বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন। সৎ, নিঃস্বার্থ তারুণ্যের গণজাগরণই পরিবর্তনের সূচনা ঘটাতে পারে বলে আমার বিশ্বাস। শুধু ভাষার মাস নয়, আত্মপ্রত্যয়ে উজ্জীবিত হওয়ারও মাস, বাঙালির গর্ব-অহংকারেরও মাস। তাই শুধুমাত্র ভাষার মাসেই ভাষাকে সম্মান জানিয়ে আমাদের থেমে থাকা যাবে না। বাংলা হোক আমাদের হৃদয়ের সুর, আমাদের রীতি-নীতি, সংস্কৃতি সর্বোপরি আমাদের মুখে প্রাণ ফিরে  পাক প্রাণের এই মাতৃভাষা।

মোঃ মেহেদী হাসান

 

সর্বস্তরে হোক বাংলা ভাষার প্রচলন

বাঙালি জাতির দিন বদলের সূচনা হয়েছিল শহীদ সালাম, বরকত, জব্বারের হাত ধরেই। বাঙালিরাই ইতিহাসের প্রথম জাতি যারা ভাষার জন্য আন্দোলন করেছে, জীবন দিয়েছে। আজ সেই বাংলা ভাষাকে আমরা ভুলতে বসেছি। কথায় কথায় বাংলার সাথে ইংরেজির মিশ্রণ ঘটাচ্ছি। অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের ইংরেজি শিক্ষাতে জোর দিচ্ছে। দেশে গড়ে উঠা ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীরা বাংলা ভাষায় নাকি কথা বলতে জানে না, বাংলা বলতে নাকি তাদের কষ্ট হয়; যা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক। আমাদের সন্তানদের এ অভ্যাস থেকে বের করে বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জন্ম দিতে হবে। চিঠি-আমন্ত্রণপত্র, তরুণ প্রজন্মের ক্ষুদে বার্তা সহ সকল ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রতি জোর দিতে হবে। শুদ্ধ বাংলাভাষা চর্চা ও বাংলার ঐতিহ্য রক্ষায় সচেতনতামূলক কাজ করতে হবে এবং বাংলা ভাষার ব্যবহার সর্বত্র নিশ্চিত করতে হবে।

ইরতাজ আরা

 

অপপ্রয়োগের কবলে বাংলা ভাষা

ভাষা সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। পৃথিবীর প্রতিটি জাতির মতো বাঙ্গালিও নিজস্ব ভাষা লালন করছে হাজার বছর ধরে, জীবন উৎসর্গ করেও।অথচ এতো ত্যাগ তিতিক্ষাময় “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা বাংলা” আজ হুমকির মুখে। প্রযুক্তির এই যুগে অপসংস্কৃতির প্রভাব আধুনিক প্রজন্মকে যেভাবে গ্রাস করছে তাতে করে বাংলা ভাষারও অপপ্রয়োগ চোখে পড়ছে।
বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হরহামেশাই তারা বাংলিশ ব্যবহার করছে, হিন্দি-ইংলিশ চর্চাও বেড়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। এতে করে বাংলা ভাষা ভবিষ্যৎ ভয়ঙ্কর! হয়তো একসময় এ প্রজন্ম সহজে বাংলা লিখতে পারবে না, স্বাচ্ছন্দ্যে বলতেও পারবে না। তাই এখনি এটি প্রতিহত করা খুবই জরুরি। বিশেষ করে পারিবারিক শিক্ষাতে বাচ্চাদের দেশপ্রেম ও ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জাগাতে হবে। ব্যাপক সাহিত্য চর্চায় বাংলা ভাষার ইতিহাস ঐতিহ্য তুলে ধরতে হবে।

আরিফুজ্জামান রঞ্জু

 

আঞ্চলিক ভাষাকে রক্ষা করি

বাংলা ভাষার একটা বড় বৈশিষ্ট্যই হলো বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন রকম আঞ্চলিক ভাষার প্রচলন। যাদের রয়েছে নিজস্ব শব্দকোষ ও রীতি। যা বাংলা ভাষাকে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন শব্দ দিয়ে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করছে। শুধু কথায় নয় প্রাচীনযুগ থেকে আঞ্চলিক ভাষা কবিতা গান, সাহিত্য বা নাটকের সংলাপে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কিন্তু বর্তমানে দেখা যায়, অনেকেই আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে স্বাচ্ছন্দবোধ তো করেনই না, বরং হীনমন্যতায় ভোগেন। আমাদের মনে রাখা উচিত আঞ্চলিকতা মানে সংকীর্ণতা বা অনাধুনিকতা নয়, এটা আমাদের ঐতিহ্য। তাই ভাষার এই বৈচিত্রতা টিকিয়ে রাখতে হলে আমাদের ব্যক্তি, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের প্রত্যেককে এগিয়ে আসতে হবে।

মরিয়ম আক্তার 

শাফিন / শাফিন