ঢাকা সোমবার, ২৫ আগস্ট, ২০২৫

ইতিহাস ও স্থাপত্যশিল্পে অনন্য ঐতিহাসিক বজরা শাহী মসজিদ


মো. ইমন photo মো. ইমন
প্রকাশিত: ২৩-৬-২০২১ দুপুর ১২:১৬

ভারত উপমহাদেশে মুঘলরা অনন্য স্থাপত্য শৈলী দান করেছে। এসময়ে নির্মিত অনেক স্থাপত্য নিদর্শন ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। তাজমহল মুঘল স্থাপত্যের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। অন্যান্য বিশ্ব ঐতিহ্যের মধ্যে রয়েছে হুমায়ুনের মাজার, ফতেহপুর সিক্রি, লালকেল্লা, আগ্রা দুর্গ ও লাহোর দুর্গ। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তানের অনেক অঞ্চল যেমন আগ্রা, আওরঙ্গবাদ, দিল্লি, ঢাকা, ফতেহপুর সিক্রি, জয়পুর, লাহোর, কাবুল, শেখপুরে মুঘল স্থাপত্যের নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে মুঘলদের অবদান রয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবস্থায় অনেক ক্ষুদ্র রাজ্য পরস্পর নিকটে আসে। পারস্যের শিল্প ও সংস্কৃতি ভারতীয় শিল্প ও সংস্কৃতির সাথে যুক্ত হয়।

সেই মোঘল সাম্রাজ্যের এক ঐতিহাসিক অনন্য নিদর্শন নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার বজরা গ্রামের 'বজরা শাহী মসজিদ'। আঠারশ শতাব্দীতে অর্থ্যাৎ প্রায় তিনশ বছর আগে এটি নির্মিত হয় যা আজও দৃষ্টিনন্দন। নোয়াখালীসহ পুরো বাংলাদেশে ইসলাম ধর্ম প্রচারে রয়েছে এ মসজিদের ঐতিহাসিক অবদান।

১২তম মুঘল সম্রাট মুহাম্মদ শাহের রাজত্বকালে ১৭৪১-৪২ খ্রিস্টাব্দে মসজিদটি নির্মাণ করেন জমিদার আমান উল্লাহ। এরপর ব্রিটিশ ভারতে ১৯১১ থেকে ১৯২৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে বজরা জমিদার খান বাহাদুর আলী আহমদ ও খান বাহাদুর মুজির উদ্দিন আহমদ মসজিদটি মেরামত করেছিলেন এবং সিরামিকের মোজাইক দিয়ে সাজিয়েছিলেন।

বজরা শাহী মসজিদের ঐতিহ্য রক্ষা এবং দুর্লভ নিদর্শন সংরক্ষণের জন্য ১৯৯৮ সালের শেষে যুক্ত হয় বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ। মসজিদটি বর্তমানে ভালো অবস্থায় সংরক্ষিত এবং এটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সুরক্ষিত স্থানগুলোর তালিকাতেও রয়েছে। আমাদের দেশের অন্যান্য দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। এ মসজিদে এলেই দর্শনার্থীদের মন জুড়িয়ে যায়।

বাজরা শাহী মসজিদে প্রবেশের পথ মসজিদের মতোই মোজাইক দিয়ে সাজানো। মসজিদের পূর্ব দিকে তিনটি দরজা রয়েছে। তিনটি দরজা বরাবর কিবলা দেয়াল রয়েছে যার অভ্যন্তরে তিনটি মিহরাব রয়েছে। মাঝের মিহরাবটি অন্য দুটির থেকে অপেক্ষাকৃত বড়। এছাড়া উত্তরে ও দক্ষিণে একটি করে মোট পাঁচটি দরজা রয়েছে মসজিদে।

এ মসজিদের অভ্যন্তরে বহু-শিখরের খিলান দিয়ে তিনটি ভাগে ভাগ করা। মসজিদের অভ্যন্তরীণ দুটি কক্ষ আছে যা বহুখাঁজবিশিষ্ট আড়াআড়ি খিলান দিয়ে তিন ভাগে বিভক্ত। ছাদের উপর তিনটি কন্দাকৃতির গম্বুজ আছে যা অষ্টকোণাকার। এগুলো শীর্ষ পদ্ম ও কলস চূড়া দিয়ে সাজানো। মসজিদটি আয়তাকার, উত্তর দক্ষিণে লম্বা। বাইরের চার কোণায় অষ্টভুজাকৃতির বুরুজ রয়েছে। দরজা বাইরের দিকে অভিক্ষিপ্ত এবং দরজার উভয় পাশে সরু মিনার রয়েছে।

বজরা শাহী মসজিদ নির্মাণের পর থেকে ছিদ্দিকি পরিবার ইমামতির দায়িত্ব পালন করে আসছে। ইসলামের প্রথম খলীফা হযরত আবু বক্কর ছিদ্দিকি (রা.) এর বংশধর ও মক্কা শরীফের বাসিন্দা হযরত মাওলানা শাহ্ সুফি আবু ছিদ্দিকি ১৭৪১ থেকে ১৭৯৬ সাল পর্যন্ত প্রথম ইমামের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৭৯৬ সালে তার মৃত্যু হলে তার ছেলে হযরত মাওলানা ইসমাইল ছিদ্দিকি ১৮৪৭ সাল পর্যন্ত ইমামতি করেন। মাওলানা ইসমাইল ছিদ্দিকির মৃত্যুর পর তার ছেলে হযরত মাওলানা মির্জা আবুল খায়ের ছিদ্দিকি ১৮৯০ সাল পর্যন্ত ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মির্জা আবুল খায়ের ছিদ্দিকির মৃত্যুর পর তার ছেলে আলহাজ্ব হযরত আলী করিম ছিদ্দিকি ১৮৯০ থেকে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত ইমাম ছিলেন। ১৯২৭ সালে আলী করিম ছিদ্দিকির মৃত্যুর পর ইমাম হিসেবে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন তার ছেলে আলহাজ্ব হযরত মাওলানা গোলাম মাওলা ছিদ্দিকি। মাওলানা গোলাম মাওলা ছিদ্দিকির মৃত্যুর পর থেকে ১৯৭২ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তার ছেলে মাওলানা আব্দুল্লাহ ছিদ্দিকি। ১৯৯৫ সালে মাওলানা আব্দুল্লাহ ছিদ্দিকির মৃত্যুর পর থেকে বর্তমানে মসজিদের সপ্তম ইমাম হিসেবে দায়িত্বে আছেন তার ছেলে মাওলানা ইমাম হাসান ছিদ্দিকি। এছারাও ঐতিহাসিক এই মসজিদকে ঘিরে রয়েছে অনেক জনশ্রুতি। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য ধর্মপ্রাণ মুসলমান এই মসজিদে আসে। তারা দান ও মানত করে যায়। 

এমএসএম / এমএসএম