বাঁশখালীতে অরক্ষিত বাঁধে অনিশ্চিত জনজীবন
চট্টগ্রামের বাঁশখালীর উপকূলীয় অঞ্চলের শেখেরখীল ইউনিয়নের সরকার বাজার হয়ে ফাঁড়ির মুখে বঙ্গোপসাগরে সংযুক্ত জলকদর খালে অরক্ষিত বেঁড়িবাধের ফলে অনিশ্চিত জনজীবন। শেখেরখীল সরকার বাজার থেকে শেখেরখীল ফাঁড়ির মুখ পর্যন্ত জলকদর খালের বেড়িবাঁধ দীর্ঘদিন যাবত সংস্কারের অভাবে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় দিনাতিপাত করছে স্থানীয় বাসিন্দারা।
বুধবার (১১ মে) সকালে সরেজমিন দেখা গেছে, সরকার বাজার থেকে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় ফাঁড়ির মূখ এলাকা পর্যন্ত জলকদর খালের বাঁধটি অস্থিত্বহীন হয়ে পড়ার বেহাল চিত্র।এতে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে কয়েক হাজার পরিবার। বাঁধসংলগ্ন কয়েক সহস্রাধিক বসতঘর যে কোন মূহুর্তে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে এমন সংকটাপন্ন অবস্থায় দিনাতিপাত করছে তাঁরা।বাঁশখালীর বুক ছিঁড়ে বয়ে যাওয়া জলকদর খাল কখনও আশীর্বাদ আবার কখনও অভিশাপে পরিণত বাঁশখালীর উপকূলীয় অঞ্চলের সর্বস্তরের মানুষের জন্য।
এক সময় যোগাযোগ ও মালামাল পরিবহনের একমাত্র মাধ্যম ওই জলকদর খাল।ওই একদিক দিয়ে চলে যাচ্ছে অবৈধ দখলকারদের দখলে, অন্যদিকে পানির স্রোতে খালে বিলীন হয়ে বাঁধটি। অরক্ষিত ওই বেড়িবাঁধ সংলগ্ন বসবাসরত প্রায় কয়েক সহস্রাধিক পরিবারের জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।প্রতিবছর বর্ষার মৌসুমে জলকদর খালের ভাঙ্গনে ঘরবাড়ি হারিয়ে সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়ে।
বাঁশখালীর গণ্ডামারা, ছনুুয়়া, শেখেরখীল, পুুঁইছড়়ি, সরল, চাম্বল, পুকুরিয়া, সাধনপুর, বাহারছড়া, কাথরিয়া, বাংলাবাজার হয়ে এ জলকদর খালটি বঙ্গোপসাগরে মোহনায় গিয়ে পড়েছে। জলকদর খালের দু,পাশে বাহারছড়া, কাথরিয়া, গন্ডামারা, চাম্বল বাংলাবাজার, পুইছড়ি, শেখেরখীল ও শিলকূূপের জালিয়়াখালী বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে প্রভাবশালীরা অবৈধ দখল করে নানা ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করলেও এখনো পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেই প্রশাসনের। হেঁটে চলাচল করার মতো কোনো সুযোগ নেই ওই বাঁধ দিয়ে। প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও বর্ষা মৌসুমে আমাবস্যা-পূর্ণিমার জোয়ারের স্রোত শুরু হলেই জলকদর খালের ভাঙনে একদিক দিয়ে ফসলি জমি ও হাজার হাজার বসতঘর বিলীন হয়ে যাওয়ার আশংকা করছেন স্থানীয়রা।
তাছাড়া গণ্ডামারা, বড়ঘোনা, শীলকূপ, সরল এলাকায় প্রতিবছর বর্ষার মৌসুমে পানি চলাচলে চরমভাবে বিঘ্ন সৃষ্টি হওয়ায় ভোগান্তিতে পড়ে সাধারণ জনগণ।েএ ভাঙনে জলকদরের ন্যায় শেখেরখীল ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের সরকার হাট, মাহব্বত আলীপাড়া, কাছারীপাড়া, সিকদারপাড়া, বাতারপাড়ার কয়েক সহস্রাধিক পরিবারের মানুষ ঝুঁকিতে বসবাস করছে। অমাবস্যা-পূর্ণিমার জোয়ারের পানির স্রোতে যে কোনো সময় বাঁধ ভেঙে জোয়ারের লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়ার আশংকা করছে স্থানীয় জনসাধারণ। লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়লে ফসিল জমি, পুকুর ও মৎস্য প্রজেক্ট ধ্বংস হয়ে যাবে।এতে বড় ধরনের লোকসানের শিকার হবে কৃষি পরিবারগুলোও। তাই স্থানীয় জনগণ জরুরিভিক্তিতে এ এলাকায় বাঁধ সংস্কারের জন্য ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষের দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
সরজমিন ভাঙন এলাকা পরিদর্শনকালে স্থানীয় ব্যবসায়ী নজির আহমদ, আহমদ মিয়া, আবু সৈয়দ, আবদুর রহমান, সৈয়দ নুর, আবদুর রশিদ, ইসহাক ,মোহাম্মদ আলী, আমিন সওদাগর, জাফর উল্লাহ, আবু ছালেকসহ অনেকে জানান, জোয়ার আসলে স্থানীয় জনগন শংকায় থাকে কখন বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকে এ আশংকায় উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসরত মানুষগুলোর ঘুম হারাম হয়ে যায়।
ব্যবসায়ী আবদুর রশিদ জানান, সরকার হাট এলাকা থেকে শেখেরখীল ফাঁড়ির মুখ পর্যন্ত খালের বাঁধটি জরুরিভিত্তিতে সংস্কার করা না হলে বর্ষা মৌসুমে প্রতি বছরের মতো এবছরও মানুষের দুর্ভোগের অন্ত থাকবে না। দোকানপাট, বরফ মিল ও বসতঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। এতে গৃহহারা হয়ে পড়বে শেখেরখীলের কয়েক সহস্রাধিক পরিবার। বড় ধরনের লোকসানে পড়বে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো।
শেখেরখীল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইয়াছিন বলেন, জলকদর খালের শেখেরখীল এলাকায় বাঁধ সংস্কারের জন্য নানা ভাবে আবেদন করা হয়েছে।এই এলাকার বাঁধ সংস্কার না হলে বর্ষায় অনেক বেশি কষ্ট পাবে জনগণ এমনকি চলাচল ও করতে পারবেনা।তাছাড়া শেখেরখীল সরকার বাজার থেকে ফাঁড়ির মূখ পর্যন্ত জলকদর খালটি বঙ্গোপসাগরের শঙ্খের মোহনায় সংযুক্ত,ওই খালের বেড়িবাঁধের প্রায় অংশ নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।বর্ষার মৌসুমে আমাবস্যা-পূর্ণিমার প্রবল জোয়ারের স্রোত শুরু হলেই থলিয়ে যাবে পুরো এলাকা।শত শত একর ফসলি জমি জোয়ারের পানিতে ডুবে গেলে কয়েকশ পরিবার গৃহ হারা হয়ে পড়ারপাশাপাশি লক্ষ লক্ষ টাকার ক্ষয়ক্ষতিতে পড়বে স্থানীয় চাষি পরিবারের সদস্যরা।তাই সরকার বাজার থেকে ফাঁড়ির মূখ পর্যন্ত জলকদর খালের বেড়িবাঁধ সংস্থার করার জন্যে সরকার কাছে দাবি জানান স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার ট্রলার গুলো ওই এলাকা বরফ গুলো থেকে বরফ সংগ্রহ করতে আসে ওই এলাকায়।বাঁধটি দ্রুত সংস্কার করা না হলে বরফ মিল গুলো যে কোন সময় নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে।ওই এলাকায় বিসমিল্লাহ আইস ফ্যাক্টরী,শাহ আমানত আইস ফ্যাক্টরী,বাইতুশ শরফ আইস ফ্যাক্টরী,কুতুবদিয়া আইস ফ্যাক্টরী, শেখেরখীল আইস ফ্যাক্টরী,বাংলাদেশ আইস ফ্যাক্টরী সহ অন্তত ২০/২৫ টি বরফ মিল রয়েছে,আইস ফ্যাক্টরীতে আব্দুশ শুক্কুর, রিদওয়ান,ইসমাইল কোম্পানি ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বলেন,শেখেরখীলের জলকদর খাল সংলগ্ন সরকার বাজার থেকে ফাঁড়ির মূখ পর্যন্ত এলাকায় বিভিন্ন দোকান পার্ট সহ অনেক বরফ মিল আছে,বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার ফিশিং বোট গুলো প্রতিনিয়ত বরফ সংগ্রহের জন্যে ছুটে আসে এই বরফ মিল গুলোতে।কিন্তু খালের বাঁধ নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়ার ফলে বরফ মিল সহ দোকান পার্ট গুলো নদীতে বিলীন হয়ে সর্বস্ব হারাবে মালিক পক্ষ।তাই বাঁধটি দ্রুত সংস্কার করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সহ অসহায় মানুষের ঘর বাড়ি ও ফসলি জমি রক্ষা করার জন্যে সরকারের কাছে তারা জোর দাবি জানান।
বর্তমান সরকারের দেশব্যাপী চলমান উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি বাঁশখালীর শেখেরখীল ইউনিয়নের সরকার বাজার থেকে ফাঁড়ির মূখ পর্যন্ত জলকদর খালের বেড়িবাঁধে।আমাবস্যা-পূর্ণিমার জোয়ারের স্রোত শুরু হলেই নির্ঘুমে রাত পোহাতে হয় উপকূলের শেখেরখীলের স্থানীয় পরিবার গুলোকে।লোকসানের অন্ত থাকে না তাদের।তাছাড়া বর্ষার মৌসুমে গ্রামীন সড়ক গুলো পানিতে ডুবে থাকায় প্রধান সড়কের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে উপকূলীয় অঞ্চলের।
ঘূর্ণিঝড় অশানি'র খবর শুনে চরম উৎকণ্ঠাতে নির্ঘুমে রাত যাপন করছে ওই এলাকায় বসবাসরত জনসাধারণ।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁশখালীর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী প্রকাশন চাকমা বলেন,বাঁশখালীর উপকূলীয় অঞ্চলের ছনুয়া,শেখেরখীল,গণ্ডামারা,সরল, খানখানাবাদ সহ বাঁশখালীর অভ্যান্তরীন জলকদর খালের দু,পাশে ৬০ কিমি এবং সাঙ্গু নদীর ৪.৭০ কিলোমিটার বাঁধ সংস্কারের জন্য প্রপোজল পাঠানো হয়েছে।আর বাঁশখালীতে স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণে ২৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে চলমান বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজের প্রায় ৯৪℅ কাজ আমরা শেষ করেছি,এই বছরের মধ্যে আমরা ওই বরাদ্দের কাজ পুরোপুরি শেষ করতে পারবো।তবে খানখানাবাদের কদমরসুল প্রেমাশিয়া কিছু অংশ বেড়িবাঁধ ফোল্ডারের বাইরে ছিল তার জন্য বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। আশা রাখি এসব কাজ করতে পারলে বাঁশখালীর জনগণকে দুর্যোগে কোন সমস্যা হবে না বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।
বাঁশখালী উপজেলায় পোল্ডার নং ৬৪/১এ, ৬৪/১বি, ৬৪/১সি এবং ৬৪/২এ এর আওতায় সর্বমোট ১৪২.০০ কিমি বাঁধ রয়েছে। যার মধ্যে ৩৬.০০ কিমি উপকূলীয় বাঁধ এবং অবশিষ্ট ১০৬.০০ কিমি আভ্যন্তরীন বাঁধ। উপকূলীয় বাঁধের মধ্যে ৯.৬ কিমি চলমান প্রকল্পের আওতায় সুরক্ষিত করা হচ্ছে। বর্তমান অগ্রগতি ৯৪.৫%। প্রকল্পটি জুন/২০২২ এ সমাপ্ত হবে। অবশিষ্ট অংশের মধ্যে কারিগরি কমিটি ও সম্ভাব্যতা সমীক্ষার সুপারিশের আলোকে অতিঝুঁকিপূর্ণ বাঁধসমূহ চিহ্নিত করে নতুন প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পটি বর্তমানে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। প্রকল্পের আওতায় ৯.২৭ কিমি উপকূলীয় বাঁধ পুনরাকৃতিকরণ ও ঢাল সংরক্ষণ, ৭.১৩ কিমি নদী তীর প্রতিরক্ষা, ২১.৯৪ কিমি আভ্যন্তরীন বাঁধ পুনর্বাসন, ১৬.০০ কিমি জলকদর খাল সহ ৮০.৩৩৬ কিমি খাল পুনঃখনন, প্রেমাসিয়া বাজারের উজানে সাঙ্গু নদীর লুপকাট, ৫ টি স্লুইস গেইট পুনঃনির্মাণ,২টি ইনলেট-আউটলেট নির্মাণ, সাংগু নদীর তৈলারদ্বীপ ব্রীজের ডাউন্সট্রিমে ৯.৬১৫ কিমি ড্রেজিং কাজও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।এই প্রকল্পটি অনুমোদন ও বাস্তবায়ন হলে বাঁশখালী উপজেলায় কৃষি ক্ষেত্রে, লবন চাষ,বসতঘর রক্ষায় এবং বিশেষ করে সাইক্লোনের সময় উপকূলবাসীর দুশ্চিন্তার অবসান হবে।
বাঁশখালীতে উপকুলে স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মানের ব্যাপারে বাঁশখালীর সাংসদ আলহাজ্ব মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী বলেন,আমি প্রথম বারে সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর আমার প্রথম দাবী ছিল বাঁশখালীর উপকুলে স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা,মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমার দাবী রেখেছে।বর্তমানে স্থায়ী বাধেঁর কাজ শেষ পর্যায়ে। উপকুলে আবারো নতুন করে শুরু হয়েছে বসতি ও নানা ধরনের সবজি, ধান ও মৎস্য চাষ।এতে উপকৃত হচ্ছে আমার নির্বাচনী এলাকার জনসাধারণ।তাছাড়া সরকার বাঁশখালীর হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত যেই মেরিন ড্রাইভ করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে তা শীঘ্রই বাস্তবায়ন হলে বাঁশখালীর উপকুল হবে শিল্প সমৃদ্ধ ও পর্যটন স্পষ্ট।
এমএসএম / জামান