একান্ত সাক্ষাৎকারে রূপ বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষক ওয়াহীদা ইসলাম কাকলী
সুন্দর মুখগুলো এই পেশার সবচেয়ে বড় অর্জন
শিক্ষক পরিবারের সন্তান ওয়াহিদা ইসলাম কাকলী। বর্তমানে নিজেও মাইলস্টোন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে শিক্ষকতা করছেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি রুপ বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সৌন্দর্য চর্চার পেশায়। ঢাকার উত্তরায় তার গড়ে তোলা পারফেক্ট বিউটি পার্লারের ৩টি শাখা রয়েছে। প্রায় ১৮ বছর ধরে দক্ষতার সাথে তিনি মানুষের সৌন্দর্য বৃদ্ধির কাজ করছেন। শিক্ষকতা ও সৌন্দর্যচর্চার পেশায় তিনি কিভাবে সফল হয়েছেন, সেই গল্প তুলে ধরা হলো সকালের সময়ের পাঠকের জন্য। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দৈনিক সকালের সময়ের যুগ্ম সম্পাদক- ফয়েজ রেজা।
সকালের সময় : আপনি কিভাবে সুন্দর থাকেন?
ওয়াহিদা ইসলাম কাকলী : আমরা মেয়েরা নিজেদের গুছিয়ে রাখতে অনেক পছন্দ করি। এর জন্য অব্যশ্যই চর্চার প্রয়োজন হয়। আমার মনে হয় একটি পরিবারের মা বা পরিবারের প্রধান সদস্য যদি পরিপাটি থাকেন, তাহলে তার পরিবারের সকল সদস্য একটি নিয়মের মধ্যে চলেন।
সকালের সময় : আপনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেছেন। একজন উদ্যোক্তা হিসেবে অন্য যে কোনো বিষয় নিয়ে কাজ করতে পারতেন। সৌন্দর্য বাড়ানোর কাজটিকে কেন পেশা হিসেবে নিয়েছেন?
ওয়াহিদা ইসলাম কাকলী : শুরুতেই আমি রূপ বিশেষজ্ঞ হয়ে যাই নি। বিয়ের আগে আমি সেনা পরিবারের মেয়ে ছিলাম। ছোটবেলায় আন্টিদের দেখতাম সুন্দর করে সাজতে। যে কোনো অনুষ্ঠান বা পার্টিতে যাওয়ার আগে অনেক বেশি মেকাপ নিয়ে, সুন্দর করে গুছিয়ে শাড়ি পরে তারা যেতেন। সেখান থেকেই সাজের প্রতি আমার একটি ভালোলাগা ছিল। বিয়ের পর যেখানেই যেতাম আমার স্বামী সাজার বিষয়ে উৎসাহ দিতেন। তখন এত বেশি বিউটি পার্লারে যাওয়া হতো যে, পার্লারের প্রতি আমার একটি প্রেম জন্মে যায়। আমি ধীরে ধীরে চিন্তা করলাম, আমি একটি বিউটি পার্লার দিব।
বিয়ের পর আমরা দেশের বাইরে অনেক বেশি বেড়াতে যেতাম। একবার মুম্বাই যাওয়ার পর সেখান থেকে বিউটিফিকেশনের উপর একটি কোর্স করেছিলাম। নিজে ভালো করে সাজার জন্যই কোর্সটি করেছিলাম। বিয়ের পর আমার দুটো সন্তান হওয়ার আগে পর্যন্ত আমি বিউটিশিয়ান হতে চাই নি। সন্তানদের সময় দিতাম তখন। সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করানোর পর প্রতিদিন স্কুলে নিয়ে যেতাম। তখন সে স্কুল থেকেই বলা হলো শিক্ষক হিসেবে জয়েন করার জন্য। এরপর শিক্ষক হিসেবে স্কুলে যোগ দিলাম। এরপর স্কুলের অন্যান্য সহকর্মীরা বলতে থাকলো, তুমি যেহেতু বিউটিফিকেশনের উপর পড়াশোনা করেছ, একটি বিউটি পার্লার দিচ্ছ না কেন? সহকর্মীদের উৎসাহ থেকেই আমার বিউটি পার্লার শুরু করা।
শুরুর থেকেই বিউটি পার্লারের প্রতিটি পণ্য ও সেবা ভালো দেওয়ার কারণে সবাই নিয়মিত আসতে শুরু করলো পার্লারে।
উত্তরা মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক আমি। উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজ অনেক পরিচিত। সেখানে অনেক স্টুডেন্ট, অনেক শিক্ষক। আমার স্কুলের সহকর্মী ও শিক্ষার্থীরাই নিয়মিত বিউটি পার্লারে সেবা নিতে আসতে শুরু করে। এভাবেই ব্যবসাটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলো।
সকালের সময় : একটি সময় সাধারণ মানুষের ধারণা ছিল, যারা শিক্ষিত, তাদের জন্য বিউটি পার্লারের ব্যবসায় নয়। আপনি সেই ধারণাটি বদলে দিয়েছেন। ভালো একটি পেশায় থাকার পরেও আপনি বিউটিফিকেশনের ব্যবসায় এসেছেন এবং এখন পর্যন্ত সফল বলা যায়। এটি কিভাবে সম্ভব হলো?
ওয়াহিদা ইসলাম কাকলী : আমি যখন বিউটি পার্লার এর ব্যবসা শুরু করি, অনেকেই একটু বাঁকা চোখে দেখতেন। তারা বিভিন্ন মন্তব্য করতেন। তখন শিক্ষিত মেয়েরা বিউটি পার্লার এর ব্যবসা করতেন না। আমি পড়াশোনা শেষ করার পর, একটি শিক্ষিত ও স্বচ্ছল পরিবারের সদস্য হওয়ার পরেও যখন বিউটি পার্লার এর ব্যবসা শুরু করি, তখন আমার বাবাও আমাকে এ পেশায় আসবে বাধা দিয়েছেন। তিনি বলতেন- কেনো তুমি বিউটি পার্লার এর ব্যবসা করতে চাচ্ছ? তোমার বরের কি ব্যবসার পরিস্থিতি খারাপ নাকি? কেন তোমাকে শিক্ষকতার পাশাপাশি পার্লারের ব্যবসা করতে হবে? শিক্ষকতা ছেড়ে দিও না, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু মেক-আপের বিষয়টি আমার কাছে ভালো লাগত। নিজে সুন্দর করে সাজব, অন্যকে সাজাব এসব ভাবতেও ভালো লাগত। বর্তমানে এ বিউটিফিকেশন নিয়ে যারা কাজ করেন, প্রায় প্রত্যেকের সাথে আমার পরিচয় আছে। এখন অনেকে বিভিন্ন দেশ থেকে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করে দেশে এসে সৌন্দর্য চর্চার ব্যবসা করছেন। বিউটি সেলুন করছে। অনেক ব্লগার আছেন, যারা রূপচর্চার বিভিন্ন বিষয় ধরে ব্লগ লিখছেন, ভিডিও তৈরি করছেন। আজকের দিনে এটি অনেক আনন্দের পেশা। এই সময়ে আমার মনে হয়, কোনো অভিভাবক তার সন্তানদের বলবেন না, বিউটি পার্লার করা যাবে না। আমার মনে হয়, অন্য অনেক পেশার মতো রূপচর্চার পেশাটিও এখন অনেক সম্মানের।
সকালের সময় : বিউটি পার্লারে যারা আসেন, তারা সাধারণত মনে একটু আনন্দ নিয়ে আসেন। আবার সাজ শেষ করে যখন ফিরে যান তখন আরেকটু সুন্দরভাব নিয়ে নিয়ে যান। সুন্দরমুখগুলো যখন দেখেন, তখন আপনার কেমন আনন্দ অনুভূতি হয়?
ওয়াহিদা ইসলাম কাকলী : সুন্দরমুখগুলো এই পেশার সবচেয়ে বড় অর্জন। মেয়েরা বিউটি পার্লারে এসে বলে, আপু আমাকে ভূত বানিয়ে দেওয়া যাবে না। আমার হাজব্যান্ড বারবার বলে দিয়েছেন অতিরিক্ত মেকাপ না নেওয়ার জন্য। সিম্পল লুক যেনো থাকে। বেশিরভাগ মেয়েদের কথা এমন। এখন আমরা এত উন্নত মানের উপকরণ ব্যবহার করছি, যাতে চেহারার আসল সৌন্দর্যটি প্রকাশ করা যায়। নিজের আসল সৌন্দর্যটি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করি আমরা। মেকাপ শেষে মেয়েরা যখন দেখে নিজেকে অনেক বেশি সুন্দর লাগছে, যখন তারা একটি ধন্যবাদ দেয়, তখন অনেক বড় কিছু মনে হয়। এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।
সকালের সময় : অনেকে অনেক কষ্ট করে উদ্যোক্তা হন। আপনার বেলায় এটি ব্যতিক্রম। আপনার কথা শুনে বুঝতে পারছি আপনি সাজতে সাজতে উদ্যোক্তা হয়ে গিয়েছেন। সারাদেশে অনেক নারী আছেন, যারা উদ্যোক্তা হতে চান। নতুন যারা উদ্যোক্তা হতে চান, তাদের জন্য আপনি কি করতে পারেন?
ওয়াহিদা ইসলাম কাকলী : সম্প্রতি আমি তৃণমূল নারী উদ্যোক্তা সোসাইটি বিউটিশিয়ার ফোরামের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছি। এখানে কাজ করে আমি অনেক বেশি আনন্দ পাচ্ছি। তৃণমূলের বিউটিশিয়ানদের সাথে কাজ করে দেখেছি, তারা কত কষ্ট করে এবং কত প্রতিবন্ধকতা জয় করে উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করছেন। তৃণমূলের বিউটিশিয়ানদের জীবনের গল্পগুলো অনেক বেশি কষ্টদায়ক। আগ্রহ থাকার পরেও অনেকে প্রশিক্ষণ ও অর্থের অভাবে ব্যবসা শুরু করতে পারেন না। সেজন্য আমরা তৃণমূলের কাছে গিয়ে বিনা খরচে প্রশিক্ষণ দেওয়ার চেষ্টা করছি। তারা যাতে ভালো পণ্য চিনতে পারে, পণ্যটি কিভাবে ব্যবহার করবে, তারা যেন সেবা সম্পর্কে জানতে পারে, ব্যবসায় লাভ করতে পারে ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। এসএমই ফাউন্ডেশন ও বিভিন্ন ব্যাংক নারীদের যে অর্থঋণ বা সুবিধা দিচ্ছে, সেসব বিষয়ে তাদের পরামর্শ দিচ্ছি।
সকালের সময় : আপনি নিজে যখন সেজে কোথাও যান, সৌন্দর্যের প্রশংসা যখন পান, তখন আপনার কেমন ভালো লাগে।
ওয়াহিদা ইসলাম কাকলী : খুবই ভালো লাগে। অনেকে বয়স বুঝতে পারে না। এটি অনেক ভালো লাগে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যখন যাই, আমরা চাই আমাদের একটু বেশি সুন্দর দেখা যাক। আমরা চাই সন্তানদের চোখে তা মা সবচেয়ে সুন্দর মা হোক। সন্তানরাও চায়, তার মা একটু সুন্দর পরিপাটি থাকুক। ঘরের বউ সবচেয়ে সুন্দর বউ হোক। আমরা কিন্তু এই সৌন্দর্য বাড়ানোর কাজটি করি। নিজে যদি সুন্দর না থাকি, অন্যদের সুন্দর রাখব কিভাবে? আমি প্রতিদিন নিজের হাতে বউ সাজাই। বউ সাজাতে আমার খুব ভালো লাগে। সাজানোর সময় বউদের ছোট ছোট টিপস দেই। আমার মনে হয় একজন বড় বোনের জায়গা থেকে বা একজন মায়ের জায়গা থেকে এসব পরামর্শ আমি দেই।
সকালের সময় : আপনি বলছিলেন বউ সাজাতে পছন্দ করেন। আপনি নিজে যখন বউ সেজেছিলেন, তখন আপনার কেমন অনুভূতি হয়েছিল?
ওয়াহিদা ইসলাম কাকলী : সেটি খুব মজার অনুভূতি। আমার বিয়ে হয়েছিল চট্টগ্রামে। সেখানে লুসি বিউটি পার্লার অনেক প্রাচীন বিউটি পার্লার। বাংলাদেশের তৃতীয় বিউটি পার্লার এটি। সেখানে আমি বউ সেজেছিলাম। এখন আমরা পেমেন্ট দেখে সিনিয়র হ্যান্ডস বা জুনিয়র হ্যান্ডস এর মাধ্যমে মেকাপ দেই। তখন বিষয়টি এমন ছিল না। তখন বিউটিশিয়ান নিজের পছন্দ অনুযায়ী কাকে সাজাবেন, তা নির্ধারণ করতেন। আমার মনে আছে সেদিন ১২ জন বউ ছিল পার্লারে, ১৯৯৬ সালের ১৬ ডিসেম্বরে। আমি তাদের মধ্যে খুব সৌভাগ্যবান ছিলাম, পার্লারের প্রধান বিউটিশিয়ান লুসি দুজন বউ নির্ধারণ করলেন, নিজে সাজানোর জন্য। তারমধ্যে একজন ছিলাম আমি। তিনি কি ভেবে পছন্দ করেছিলেন আমি জানি না। তবে বিষয়টি আমাকে খুব আনন্দ দিয়েছিল।
সকালের সময় : এখন পর্যন্ত আপনি কতজন বউ সাজিয়েছেন?
ওয়াহিদা ইসলাম কাকলী : অনেক বছর ধরে বউ সাজাচ্ছি। প্রায় সতের আঠার বছর ধরে বউ সাজাচ্ছি। শুরুর দিকে অনেক বেশি বউ সাজাতাম। এমনও হয়েছে এক একটি শুক্রবারে আট থেকে দশজন বউ সাজিয়েছি। এখন অনেক বেশি বউ সাজাতে হয় না। অনেক বেশি বিউটি পার্লার হয়েছে এখন। অনেক বিউটি ব্লগার হয়েছেন। তারা অনেক বউ সাজাচ্ছেন।
সকালের সময় : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
ওয়াহিদা ইসলাম কাকলী : আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ। সুন্দর একটি বিষয় ধরে কথা বলার জন্য। সকালের সময়ের সকল পাঠকের প্রতি শুভেচ্ছা।
এমএসএম / এমএসএম