এই শহরে কবিতা বেঁচে আছে কবি মিল্টন সফিদের হাতে
একালে কবিতা লেখার জন্য সম্ভবত কেউ ঢাকায় আসে না। যেমনটি আসতো গত শতাব্দীর ষাটের দশকে, সত্তর বা আশির দশকে। কবি আল মাহমুদ ট্রাংকের ভেতরে পুটলি পাটলার সাথে কয়েকটি কবিতার খাতা নিয়ে যে ঢাকায় থিতু হয়েছিলেন, সে ঢাকাতেই জন্ম ও বেড়ে ওঠা কবি মিল্টন সফির।
এটি সেই সময়ের কথা, যখন ঢাকায় নব্য ধনীদের সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছিল এবং ঢাকায় মানুষজন সাধারণ আসত অথবা বসবাস করত শুধুমাত্র অর্থ উপার্জনের জন্য। ঢাকায় নতুন কর্পোরেট সেক্টর বিকশিত হতে শুরু করেছিল। টাকার গন্ধে মানুষ বুদ হতে শুরু করেছিল সেই সময়।
ঢাকায় বড়লোক হওয়া অথবা অর্থ উপার্জনের নেশায় বুদ না হয়ে কবিতায় বুদ হওয়া কিশোরদের একজন কবি মিল্টন সফি। ক্লাসে পড়ার ফাঁকে ফাঁকে গড়ে তুলেছেন বিভিন্ন বই পড়ার অভ্যাস। বই পড়ার অভ্যাসটি শেষ পর্যন্ত গড়িয়েছে সাহিত্য চর্চার অভ্যাসে। আর এই অভ্যাস তাঁকে টেনে নিয়েছে তরুন এবং প্রতিভাবান সাহিত্যিকদের সারিতে।
'নিভৃতে নির্বাসনে' 'কালোপুরুষ' 'একটি স্বপ্নস্নাত নারীর জন্যে পার্থনা' মিল্টন সফির লেখা পাঠক প্রিয় বই। মিল্টন কি বিষয়ে লেখেন? যারা মিল্টনের একনিষ্ঠ পাঠক, তাদের কাছে নতুন করে উপস্থাপনের বিষয় নয়। যারা মিল্টনের লেখার সাথে পরিচিত নন, তাদের জন্য উল্লেখ করছি, মিল্টনের একটি লেখায় থাকে শত জীবনের গল্প। জীবনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা আরেকটি জীবনের কথা।
মিল্টনকে নিয়ে এত কথা লেখার একমাত্র কারণ এটি নয় যে, মিল্টন একজন ভালো লেখক। মিল্টন তরুণ এবং সম্ভাবনাময়, এটিও এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। মিল্টনকে লেখার প্রধান কারণ- তাঁর নিজের জীবনেও কিছু গল্প আছে। যেসব গল্প তাঁর লেখার গল্পগুলো থেকে আলাদা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শেষে কর্মজীবন শুরু করার জন্য চাকুরী প্রাত্থী হিসেবে ডাক পেয়েছিলেন ড্রেস ম্যান থেকে। প্রথম ইন্টারভিয়্যুতে প্রশ্নকর্তা মেজর আশফাক আহমেদ জানতে চাইলেন- ভবিষ্যতে আপনি কি হতে চান?
উত্তরে মিল্টন বলেছিলেন- কবি হতে চাই।
কবি হওয়ার জন্য জন্মেছেন যে যুবক, তাঁকে কবি হতে সহযোগিতা করার জন্য, কবিতা লিখতে জীবিকা উপার্জনের জন্য এই শহরে মেজর আশফাক আহমেদ এরমতো কিছু মানুষ হয়তো আছে। কিন্তু একজন উদীয়মান কবিকে চাকুরি দেওয়ার মতো প্রতিষ্ঠান নেই একটিও।
যার কবিতার মধ্যে আছে শত জীবনের শক্তি, কবি হওয়ার পথে তাঁকে রোধিবে কে?
কবি মিল্টনের ইচ্ছা শক্তির কাছে পরাজিত হলো জীবিকার প্রসঙ্গ।
কর্মজীবন শুরুর আগে মিল্টন যে কয়টি প্রতিষ্ঠানে ইন্টারভিয়্যু দিয়েছেন সব জায়গাতেই বলেছেন কবি হতে চান তিনি। সাক্ষাৎকারের টেবিলে তাই সাহিত্য বিষয়ক আলোচনা জমতো। ব্যবসার লাভ ক্ষতির হিসেবে যার গুরুত্ব একালে খুব কম।
ফলে বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি না করে মিল্টন বেছে নিলেন এমন একটি পেশা যে পেশা তাঁকে লেখক হতে সহযোগিতা করতে পারে। চাকরি জীবনের শুরু করলেন বিজ্ঞাপনী সংস্থা 'নেপচুন' এর কপি রাইটার হিসেবে। কপি রাইটার এর কাজ কি? পণ্যের প্রশংসা করা। এমন প্রশংসা, যা পড়ে মানুষ তার জীবনের জন্য পণ্যটি অপরিহার্য মনে করে। মিল্টন সফল সে পেশায়।
চাকুরির পাশাপাশি সাহিত্য পত্রিকা 'বিচ্ছুরণ' সম্পাদনা করতেন। ফলে নিজের সাহিত্য চর্চার সাথে নবীন প্রবীণ সাহিত্যিকদের সাথে তাঁর যোগাযোগ বাড়তে থাকে। ২০০৪ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত সম্পাদনা করেছেন বিচ্ছুরণ। এরপর কবিতা চর্চার জন্য যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছেন জাতীয় দৈনিক পত্রিকায়। সেটি তখন আর সম্ভব হয়নি।
মাঝখানে চাকুরী ছেড়ে চেষ্টা করেছেন নিজের কিছু করার জন্য। নিজে কিছু করা মানে ব্যবসা জাতীয় কিছু। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ফরচুন ক্রিয়েশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান। কবিরা ব্যবসায় সফল হয় না। একটি লেখার পেছনে একটি রাত অথবা একটি লেখার জন্য বহু রাত জেগে চেষ্টা করার পর ব্যবসায় মনোযোগ দেওয়া সম্ভব নয়। মিল্টনও ব্যর্থ হয়েছেন সেখানে। আবার ফিরে এসেছেন পছন্দের পেশায়। যে পেশায় আছে লেখালেখির আনন্দ। এরপর এমবিএ ডিগ্রি নিয়ে যোগ দিলেন ঢাকা ব্যাংকে।
অল্প জীবনের ক্যারিয়ারে বর্তমানে তিনি গ্লোবাল ইসলামি ব্যাংক এর জনসংযোগ বিভাগের একজন কর্মকর্তা। এই ব্যাংকে তিনি যুক্ত আছে ২০১১ সাল থেকে। এখন তিনি নিয়মিত কবিতা লেখেন তাঁর পাঠকদের জন্য। নিয়মিত স্ক্রিপ্ট লেখেন তাঁর ব্যাংকের গ্রাহকদের জন্য। সহজ ভাষায় লাভ ক্ষতির হিসেব বোঝান সাধারণ মানুষদের।
মিল্টন সফি বাংলাদেশের প্রখ্যাত লেখক নন। মিল্টন সফির লেখা কবিতার বই হাজার হাজার পাঠকর হাত থেকে হাতে হয়তো ঘোরে না। মিল্টন সফিদের লেখা হয়তো পাঠকের মুখে মুখে উচ্চারিত হয় না তবে এই শহরে এখনও কবিতা বেঁচে আছে মিল্টন সফিদর হাতে। কালজয়ী হোক মিল্টন সফির কবিতা।
প্রীতি / প্রীতি