দুঃসময়ের খেলা ও রাজনীতি
বর্তমান পৃথিবী দুলছে ফুটবলে। কাতারের স্টেডিয়াম থেকে ফুটবল পৃথিবীতে ছড়াচ্ছে এতটাই উচ্ছ্বাস, আনন্দের ঢেউ, বাংলাদেশে মেসিকে মনে হচ্ছে পাশের বাড়ির কেউ। শুধু বর্তমানের খেলোয়াড় নয়, ফুটবলের কিংবদন্তী পেলে, ম্যারাডোনাদের নাম বারবার দোল খেয়ে জেগে উঠছে বিশ্ববাসীর মনে। রাত জেগে সেই খেলা দেখছে বাংলাদেশের মানুষ। খেলা দেখে আনন্দে ভাসছে দর্শক, উচ্ছ্বাসে হাসছে, আবেগে আপ্লুত হচ্ছে। এই খেলা খেলছে বিশ্বের যে ৩২টি দেশ, সেখানে নেই আমার সোনার বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ কেন বিশ্বকাপ ফুটবল খেলতে পারছে না? প্রশ্নটিও এখন আর তুলছে না কেউ। কবে খেলবে? সেই অনুমান বা সম্ভবনার স্বপ্ন দেখানোর দ্রষ্টা নেই দেশে। তবে সারাদেশের সাধারণ মানুষ শুনছে একটি শব্দ- 'খেলা হবে'।
মাঠের যে কোনো সাধারণ খেলা মানুষকে আনন্দ দেয়। মাঠের খেলোয়াড় মাঠে খেলে। খেলোয়াড় বলে লাথি দেয়। সেই লাথি বলে লাগে। কারো গায়ে লাগে। পায়ে লাগে। রিপ্লেতে লাথি দেওয়া এবং খাওয়ার দৃশ্য দেখে দর্শকের মনে কষ্ট অনুভব হয়। পরক্ষণেই ভক্তরা দুঃখ ভুলে খেলার আনন্দে ভাসে। জীবনের সাধারণ দুঃখ ভোলানোর শক্তি আছে এই খেলার।
বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা যে খেলার ডাক দিচ্ছেন, সে খেলার অতীত অনেক ভয়ঙ্কর। ভবিষ্যতের শঙ্কাও তাই বেশি। শঙ্কাময় এই খেলাকে বিএনপি বলছে - 'গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম'। অথচ গণতন্ত্রকে বহুবার হত্যা করেছে বিএনপি। তাদের কাছে বাংলাদেশে গণতন্ত্র এখন মৃত হাতির মতো।
আওয়ামী লীগ বলছে 'গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত'র কথা। অতীতে গণতন্ত্র প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার মতো অনেক অভিযোগ এসেছে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগ যথাযথভাবে খণ্ডন করা হয়নি। সাধারণ মানুষের চোখ তাই গণতন্ত্রের মরা হাতির উপরে নেই। দেশের মানুষ আপাতত রাজনীতির খেলার চেয়ে বিশ্বকাপ ফুটবল খেলার আনন্দটি বেশি উপভোগ করতে চায়।
অল্প কিছুদিন আগে উন্নয়নের মহাসড়কে ছিল বাংলাদেশ! দেশটি যে এখন ভালো নেই, দেশের মানুষ যে এখন কষ্টে আছেন, তা স্বীকার করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এতেও দমেনি আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের 'খেলার নেশা'। যে খেলা দেশের জন্যেও ভয়ঙ্কর।
বড্ড বিপাকে আছে দেশের অর্থনীতি। মাত্র ২ বছর আগে উন্নয়নের মহাসড়কে উঠা দেশটির চাকা এখন থমকে। গলির মোড়ের মুদি দোকানদার অথবা একজন সাধারণ ক্রেতা, সকলেই আজ দ্রব্যমূল্যের উোত্তাপের কথা স্বীকার করছেন। স্বাভাবিক জীবনে আয়-ব্যয়ের সমন্বয়ে তারা যে ভালো নেই, তা প্রকাশ করছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সাধারণ মানুষের কষ্ট অনুভব করার সময় নেই রাজনীতিবিদদের। তারা মেতেছেন খেলার নেশায়, উন্মাদনায়।
কিছুদিন আগেও আমরা গেয়েছিলাম উন্নয়নের গান। আজকে দেশের অর্থনীতিতে রিজার্ভে পরেছে টান। ঘাটতি পূরণের জন্য সরকার নিয়েছে আইএমএফ এর কাছ থেকে ঋণ। বাংলাদের মানুষ জন্ম থেকেই টানছে ঋণের বোঝা। এই সময়ে পূর্বের ঋণের বোঝা আরও ভারি হয়েছে। বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পের বিলাসী ব্যয় ও আমদানি বিলাসের খরচ এসে পরছে সাধারণ মানুষের কাঁধে। সংসারের খরচ কমাতে কমাতে আর কমানো যায় না অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। শহর ছাড়ার উপক্রম হয়েছে অনেকের। গ্রাম ছেড়ে কর্মসংস্থানের আশায় শহরে আসছেন অনেকেই। এর মধ্যে দেশের বড় দুই দলের 'খেলা হবে' 'খেলা হবে' আবারও আতঙ্কিত করে তুলছে মানুষকে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে বিএনপির গণসমাবেশ ঘিরে পরিবহন ধর্মঘটসহ যে প্রস্তুতি ম্যাচের দৃশ্য দেখা গেছে, তার প্রধান ভুক্তভোগী ছিল সাধারণ জনগণ।
এই সময়ে গোটা দেশ যেন একটি খেলার মাঠ। সেই মাঠে খেলতে চাইছে দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এ খেলায় টের পাওয়া যাচ্ছে দুর্যোগের ঘনঘটা। দেশের সাধারণ মানুষ যে রাজনীতিতে খেলার পুতুল, তা নতুন করে বলার বিষয় নয়। শুধু এটুকু বলা প্রয়োজন, এখন খেলা দেখানোর উপযুক্ত সময় নয়। বাংলাদেশের জন্য এখন বড় দুঃসময়।
আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা ভোটের আগে উন্নত গণতন্ত্র ও সমৃদ্ধ অর্থনীতি উপহার দিতে চান জনগণকে। ভোটে জেতার পর নিজেদের ভোগ বিলাসীতায় অপচয় করেন অর্জিত রাজস্বের অনেকটাই। ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ আয় যতই বাড়ুক, বিদেশী রেমিটেন্স দেশে যতই আসুক, হিসেবে ঘাটতি থাকে। সেই ঘাটতি পূরণে জনকল্যাণমূলক খাতে কমে সরকারের ভর্তুকী। কর বসে নতুন নতুন খাতে। সাম্প্রতিক সময়ে বিদ্যুতে ভর্তুকি কমানো হয়েছে। কিছুদিন আগে ডিজেলে ভর্তুকি কমানো হয়েছিল। বর্তমানে আইএমএফ যেসব শর্ত দিয়েছে সেখানেও আছে ভবিষ্যতে ভর্তুকি সমন্বয়ের কথা। ভর্তুকি সমন্বয়ের কারণে মানুষের জীবন যাত্রার ব্যয় বাড়বে। আয় বাড়বে না। স্বাভাবিকভাবেই দুশ্চিন্তার ভাঁজ সাধারণ মানুষের কপালে।
আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলো যখন ক্ষমতাবক্সের ভেতরে থাকেন, তখন তাদের মুখের কথা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত থাকে। তখন তারা মুখের কথায় গণতন্ত্র ভিজিয়ে, চুকিয়ে মণ্ড বানিয়ে আরও শক্তিশালী মানে বিশ্বের উন্নত দেশের চেয়েও উন্নততর করার চেষ্টা করেন। আর যখন তারা থাকেন ক্ষমতা বক্সের বাইরে, তখন দেশে গণতন্ত্র থাকে না। এই হিসেবে বাংলাদেশে বিগত ৫০ বছর ধরেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত ও সুসংহত ছিলো আবার বাংলাদেশে গত ৫০ বছরের কোনো সময়েই গণতন্ত্র ছিলো না।
একজন মেজর বা জেনারেলে সামরিক পোশাক ও অত্যাধুনিক অস্ত্র সুসজ্জিত পরিবেশে দেশে যখন জাতীয়তাবাদী দল গঠন করেছিলেন, তখনও দেশে গণতন্ত্র ছিলো সুসংহত। একজন জেনারেল যখন শিল্পীর আঁচড়ে বিশ্ববেহায়ার খেতাব পেয়েছিলেন, তিনিও দেশের মানুষকে গণতন্ত্রের স্বাদ চেখে দেখার সুযোগ দিতে চেয়েছেন।
দেশের রাজনীতিবিদদের চাওয়া আর জনগণের চাওয়া এক হয় না কোনো সময়। প্রত্যাশা পূরণের সময় তাই ফারাক থাকে।
বর্তমান সময়ে বিএনপির 'গণতন্ত্র পুণরুদ্ধার' এবং আওয়ামী লীগের 'গণতন্ত্র অব্যাহত' রাখার জন্য যে খেলায় আভাস দিচ্ছে তাতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ নেই। এটি নিছক রাজনৈতিক খেলা এবং এই খেলায় যে আভাস পাওয়া যাচ্ছে, তা দেশের অর্থনীতি ও মানুষের জন্য শুভ ফল আনবে না। যে খেলায় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ নেই, সে খেলা বন্ধ হোক।
লেখক- যুগ্ম সম্পাদক, দৈনিক সকালের সময়
প্রীতি / সুজন