ঢাকা বৃহষ্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

প্রকৌশলী ও কাউন্সিলরের কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ

‘মরণ ফাঁদ’ পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোড


আব্দুল লতিফ রানা photo আব্দুল লতিফ রানা
প্রকাশিত: ৩১-৮-২০২৪ বিকাল ৭:১

রাজধানীর পুরাণ ঢাকার চকবাজার, মৌলভীবাজার, বেগমবাজার আবুল হাসনাত রোড ও নাজিমউদ্দিন রোর্ডের বাসিন্দারা জিম্মি হয়ে পড়েছেন, স্থানীয় কাউন্সিলর ও নির্বাহী প্রকৌশলী মিঠুন চন্দ্র শীলের কাছে। এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে স্থানীয় কয়েকজন ভুক্তভোগী সুত্রে। নির্বাহী প্রকৌশলী মিঠুন চন্দ্র শীল ডিএসসিসির অঞ্চল-৩-এর দায়িত্বে রয়েছেন।

জানা গেছে, স্থানীয় কাউন্সিলর ও নির্বাহী প্রকৌশরী ও কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা মিলে পুরো এলাকা চাঁদাবাজির অভয় অরণ্য গড়ে তুলেছেন। এতে করে ঐতিহাসিক নাজিমউদ্দিন রোড বছরের বর বছর যানবাহন ও মানুষের চলাচল বন্ধ রয়েছে।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নাজিমউদ্দিন রোডে ওয়াসার পানি নিষ্কাশনের জন্য কয়েক বছর আগে রাস্তার গভীরে বড় বড় পাইপ স্থাপন করা হয়। তখন পাইপ স্থাপনের জন্য প্রায় এক বছর রাস্তা খোঁড়াখুড়ি করে যানবাহন চলাচল ও সাধারণ মানুষের পায়ে হাটার রাস্তাও বন্ধ থাকে। আর সেই পাইপ স্থাপনের ফলে এলাকায় জলাবদ্ধতা দুর হয়। পরে ওই পাইপ তুলে পুনরায় অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার জন্য একই কাজের টেন্ডার আহব্বান করা হয়। উক্ত টেন্ডারে এম আলী এন্টারপ্রাইজসহ কয়েকটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান কাজ পায়। পরে সেখানে ঠিকাদারগণ কাজ শুরু করতে ভেকু দিয়ে রাস্তার মাটি কেটে রাখে। এতে পুরান ঢাকার সাধারণ মানুষের চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। 

এদিকে ওই কাজের একজন ঠিকাদারের সহযোগী অভিযোগ করে বলেন, স্থানীয় প্রভাবশালী শাহীন ও মহিউদ্দিন বিভিন্ন অজুহাতে কাজে বাঁধা দিচ্ছেন। মাঝে মধ্যে চাঁদাও দাবি করছেন। তাদেরকে কিছু চাঁদা দেওয়াও হচ্ছে, তারপরও তারা কর্মচারী, লেবারদের এসে মাথায় ইট দিয়ে ফাটিয়ে দেওয়াসহ নানা প্রকার হুমকি দিচ্ছেন। এতে করে কাজের সমস্যা হচ্ছে। নির্মাণ কাজে বাঁধা না দিলে কাজটি দ্রুত শেষ করা যেত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

এ বিষয় উক্ত শাহীনের মুঠো ফোনে যোগাযোগ করা হলে, তিনি চাঁদাবাজির কথা অস্বীকার করে বলেন, আমি ঠিকাদারদের কাজে সহযোগিতা করছি। তবে তারা নানা অনিয়ম করছেন। এজন্য প্রতিবাদ করা হয়েছে। আর কাউকে কোন প্রকার হুমকি বা কাজে বাঁধা দেওয়া হয়নি। তাই আমার বিরুদ্ধে যারা অভিযোগ করেছেন, তারা মিথ্যা অভিযোগ করেছেন।                                                                                                                                                                                                                                                                পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডে মাক্কুশা মাজার, চকবাজার, বেগম বাজার ও আবুল হাসনাত রোডের বাসিন্দারা জানান, ডিএসসিসি’র দুর্নীতিবাজ নির্বাহী প্রকৌশলী সাবেক মেয়র তাপসের কথিত মামা পরিচয়দানকারী ও স্থানীয় চাঁদাবাজদের কারণে এই রাস্তা বেহাল দশায় পরিণত হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ফার্নিচার ব্যবসায়ী জানান, নাজিমউদ্দিন রোডে পাইপ বসানোর নামে রাস্তা কাটাকাটির কারণে রিকশাসহ সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। এভাবে মাসের পর মাস রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ থাকলে ব্যবসায়ীদের পথে বসতে হবে। নাজিমউদ্দিন রোডের ৪২টি ফার্নিচারের দোকানে কোনো বেচাকেনা নেই। ফলে তারা পরিবার পরিজন নিয়ে মহাবিপদে পড়েছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, নাজিম উদ্দিন রোড পুরোটাই এখন মাটি খুঁড়ে রাখা হয়েছে। সড়কের অর্ধেকজুড়ে ফেলে রাখা হয়েছে পাইপ। এতে যান চলাচল তো দুরের কথা পায়েও হাটতে পারছেন না এলাকার বাসিন্দারা। 

পুরান ঢাকার চারটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকা হচ্ছে চকবাজার, বেগম বাজার, মৌলভীবাজার ও ইমামগঞ্জে যাতায়াতের অন্যতম প্রধান রাস্তা উর্দু রোড ও নাজিমুদ্দিন রোড। সিটি করপোরেশনের খোঁড়াখুঁড়ি, নাজিমউদ্দিন রোডের যানবাহন এখন হোসেনি দালান ও বকশিবাজার রাস্তায় চলাচল করছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, গত প্রায় আট মাস ধরে নাজিম উদ্দিন রোডে খোঁড়াখুঁড়ি করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এমনিতেই সারাবছর চকবাজার, বেগম বাজার, মৌলভীবাজার ও ইমামগঞ্জে যানজট লেগে থাকে। এখন সিটি করপোরেশনের অব্যবস্থাপনায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে বিরাজ করছে একধরনের স্থবিরতা। কবে এই রোডে যান চলাচল শুরু হবে, তাও জানেন না তারা। সাবেক কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে থেকে চাঁনখারপুল পর্যন্ত বিস্তৃত নাজিমউদ্দিন রোড।পুরো রাস্তাজুড়ে চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। পাইপ বসানো হলেও এখন  সেখানে বালু ভলাট করা হয়নি। এতে সড়কের যান চলাচল বন্ধ আছে। এসব এলাকায় গাড়ি ঢুকতে ও বের হতে পারছে না। 

রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও পাইপ বসানোর কাজ করছেন ‘এম আলী এন্টারপ্রাইজ’ নামক একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। এই কোম্পানীর প্রধান প্রকৌশলী নবীন হোসেনের এর মুঠো ফোনে বার বার কল করা হলেও তিনি তা ফোনটি রিসিভ করেননি। নাজিমউদ্দিন রোড ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অঞ্চল-৩-এর আওতাধীন। এই অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ে কয়েকদিন ঘুরেও তাকে অফিসে পাওয়া যায়নি। পরে তার মুঠো ফোনে একাধিকবার ফোন করেও তাকে পাওয়া যায়নি। আর স্থানীয় কাউন্সিলরের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি’র  নগরভবনে অনুসন্ধান চালিয়ে জানা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সদ্যবিদায়ী মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের কথিত দুই মামা ফারুক ও মাসুদ সেরনিয়াবাদ করপোরেশনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সবই নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাপসের ধানমণ্ডির বাসায় বসে ইজারা, টেন্ডারসহ সব কার্যক্রমের ঠিকাদার নিয়োগ দিতেন। এ কাজের সব তথ্য সিটি করপোরেশন থেকে সরবরাহ করতেন মেয়রের ব্যক্তিগত সচিব (এপিএস) নাসিরুল হাসান সজীব। তারাই ঠিকাদার নির্দিষ্ট করতেন। এদের মধ্যে যেসব ঠিকাদার কমিশন বেশি দিতেন তাদের কাজ দেওয়া হতো।
অপরদিকে ডিএসসিসি’র কয়েক হাজার কোটি টাকা মেয়র রেখেছেন নিজের মালিকানাধীন ব্যাংকে। বিদায়ী মেয়র ব্যারিস্টার তাপসের মালিকানাধীন মধুমতি ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালক। তিনি দক্ষিণ সিটির এফডিআর, বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থ, ট্রেড লাইসেন্স, হোল্ডিং ট্যাক্সসহ অন্যান্য ফি মধুমতি ব্যাংকে স্থানান্তর করেন। শুধু এ ব্যাংকেই করপোরেশনের স্থায়ী আমানত ৫শ’ কোটি টাকার বেশি জমা রয়েছে। এ ছাড়া চার খাল সংস্কার প্রকল্পের ৮৭৬ কোটি, শাহবাগ শিশু পার্কের উন্নয়নকাজের ৬০৩ কোটিসহ কয়েকটি প্রকল্পের প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা এ ব্যাংকে জমা রয়েছে।
ডিএসসিসির আইন, ২০০৯ অনুযায়ী, মেয়র লাভজনক কোনো প্রতিষ্ঠানের পদে থাকতে পারবেন না। আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে মধুমতি ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর ২০২০ সালের ১২ মে মধুমতি ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করে ডিএসসিসি। সিটি করপোরেশনের আর্থিক ফান্ড, ট্রেড লাইসেন্স, হোল্ডিং ট্যাক্সসহ সব ধরনের লেনদেন মধুমতি ব্যাংকে স্থানান্তর করে সংস্থাটি। এর মধ্যে ডিএসসিসির স্থায়ী আমানত ৫০০ কোটি টাকা এফডিআর হিসেবে মধুমতি ব্যাংকে স্থানান্তর করেন। আর হোল্ডিং ট্যাক্সের টাকাও সংগ্রহ করে ব্যাংকটি। নতুন করে চলতি অর্থবছরে ট্রেড লাইসেন্স ও নবায়ন ফি সংগ্রহের দায়িত্ব পায় ব্যাংকটি। হোল্ডিং ট্যাক্স ও ট্রেড লাইসেন্সের টাকা চুক্তি অনুযায়ী ৭ দিন জমা থাকার কথা থাকলেও পরে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ১৫ দিন ধার্য করে। সেটিও মানছে না মধুমতি ব্যাংক। ট্রেড লাইসেন্স ও ট্যাক্সের জমা করা এ টাকা নির্দিষ্ট সময় ব্যাংকটি নিজস্ব কাজে ব্যবহার করে। এর লভ্যাংশ সিটি করপোরেশন পায় না। সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা আসে মধুমতি ব্যাংকে। এ ছাড়া ব্যাংকটির একটি বুথ করপোরেশনের আট তলায় রয়েছে। এ বুথের জন্য রুম ছেড়ে দিলেও আর্থিক কোনো চুক্তি হয়নি। মেয়রের মৌখিক নির্দেশে নগর ভবনে বুথ বসিয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে ব্যাংকটি। দক্ষিণ সিটির সব টেন্ডার ও ইজারার গডফাদার ছিলেন ফারুক ও মাসুদ সেরনিয়াবাদ নামে মেয়রের দুই আত্মীয়। এবিষয়ে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

T.A.S / T.A.S