ঢাকা মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারী, ২০২৫

স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে হাসপাতালে প্রয়োজন 'গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট'


ইভা আক্তার, গবি photo ইভা আক্তার, গবি
প্রকাশিত: ১-১০-২০২৪ দুপুর ১২:০

২৫ সেপ্টেম্বর বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস। অন্যান্য বছরের মতোই সারা বিশ্বে স্বাস্থ্য খাতে ফার্মাসিস্টদের অবদানের সম্মানার্থে এই দিবসটি উদযাপন করা হচ্ছে। বাংলাদেশেও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠানে দিনটি পালন করা হয়। এবারের বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, ",Pharmacists Meeting Global Health Needs" অর্থাৎ ফার্মাসিস্টরা বৈশ্বিক স্বাস্থ্যের প্রয়োজন মেটাচ্ছে। সারা বিশ্বের উন্নত ও স্বল্পোন্নত দেশের স্বাস্থ্য কাঠামোতে ফার্মাসিস্টরা সরাসরি যুক্ত আছেন। প্রতিপাদ্যটি সেই ভূমিকার গুরুত্বকেই তুলে ধরছে।

তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে এখনো স্বাস্থ্য কাঠামোতে ফার্মাসিস্টদের সরাসরি যুক্ত করা হয়নি। এর ফলে সাধারণ জনগণ সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। স্বাস্থ্য কাঠামোতে ফার্মাসিস্টদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মাধ্যম হলো হাসপিটাল ফার্মেসী, ক্লিনিক্যাল ফার্মেসী এবং কমিউনিটি ফার্মেসী, যা বাংলাদেশে প্রায় অনুপস্থিত।  বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় কীভাবে ফার্মাসিস্টদের অন্তর্ভুক্ত করা যায় এবং এর জন্য কী কী বাধা রয়েছে, সেই সঙ্গে এর মাধ্যমে দেশের জনগণ কীভাবে সঠিক সেবা পেতে পারে, তা নিয়ে বিভিন্ন পেশাজীবী, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী ফার্মাসিস্টদের মতামত তুলে ধরেছেন গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগের শিক্ষার্থী ইভা আক্তার।

"বৈষম্যহীন স্বাস্থ্যসেবা খাত বিনির্মানে হসপিটাল ও ক্লিনিক্যাল ফার্মেসীসেবা চালু করা অত্যাবশ্যক"

গত ২০-০৮-২০২৪ তারিখে স্বাস্থ্যসেবা খাত সংস্কারের লক্ষ্যে বর্তমান অন্তবর্তী সরকার ১৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি ঘোষণা করেছে। এই কমিটিতে সকলেই ডাক্তার, যা দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, জুলাই ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত ড. মো. ইউনুসের নেতৃত্বাধীন সরকারও পূর্ববর্তী সরকারের মতোই স্বাস্থ্যসেবা খাতে ডাক্তারদের একচেটিয়া আধিপত্য বজায় রেখেছে। ফলে স্বাস্থ্যসেবা বলতে শুধু ডাক্তারদেরই বোঝানো হচ্ছে, যেখানে অন্য পেশার মানুষের জন্য কোনো স্থান নেই। অথচ সারা বিশ্বে স্বাস্থ্যসেবা মানেই ডাক্তার, ফার্মাসিস্ট, নার্স ও হেলথ টেকনোলজিস্টদের সমন্বিত একটি টিম।
বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় বর্তমানে চারটি অধিদপ্তর নিয়ে গঠিত, যথা: ১) স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তর, ২) পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, ৩) ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর এবং ৪) স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এ ছাড়া ফার্মেসী কাউন্সিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা, যা বাংলাদেশে ফার্মেসী শিক্ষা ও ফার্মেসী পেশার চর্চা নিয়ন্ত্রণ করে। যদিও ডাক্তার, নার্স এবং স্বাস্থ্য প্রযুক্তিবিদরা বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা কাঠামোতে সরব উপস্থিতি বজায় রেখেছে, তবে ফার্মাসিস্টদের অবস্থান একেবারেই নেই। ফলে দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা মারাত্মক দুর্বল হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় ফার্মাসিস্টদের অন্তর্ভুক্তি অত্যন্ত জরুরি।
বাংলাদেশে সাধারণ মানুষ "ফার্মেসী" বলতে ওষুধের দোকানকেই বোঝে, ফার্মাসিস্ট পেশাকে নয়। এটাই ফার্মাসিস্টদের সামনে একটি বড় বাঁধা। এই ভুল ধারণা থেকে উত্তরণের উপায় কী? জনগণের মনে ফার্মাসিস্ট পেশাকে সঠিকভাবে স্থাপন করতে না পারলে, পেশা হিসেবে ফার্মেসীর গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ থাকবে। যখন কোনো মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগে ভর্তি হয়, তখন অনেক সাধারণ মানুষ হতাশা প্রকাশ করে, বলে— "এত ভালো রেজাল্ট করেও ও ফার্মেসীতে ভর্তি হলো! ওষুধের দোকানে কাজ করবে?" তবে এখন বহু সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসী বিভাগ খোলার ফলে সমাজের বিভিন্ন স্তরে এই বিষয়ে একটি গণসচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে।
ফার্মেসী কোর্সের সিলেবাস কি হসপিটাল ফার্মেসী চালু করার জন্য উপযুক্ত? এই বিষয়ে বিতর্ক থেকে যাচ্ছে—৩ বছর, ৪ বছর, ৫ বছর নাকি ৬ বছর মেয়াদী কোর্স প্রয়োজন? হসপিটাল ফার্মেসী চালু করতে হলে দেশের ফার্মেসী বিভাগের বর্তমান কোর্স-কারিকুলাম ঢেলে সাজানো অত্যাবশ্যক। এখন পর্যন্ত আমাদের ফার্মেসী শিক্ষা ব্যবস্থা ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি-নির্ভর। তবে, আমাদের অনেক সিনিয়র, সমসাময়িক ও জুনিয়র ফার্মাসিস্ট বিদেশে সফলভাবে হসপিটাল ফার্মাসিস্ট হিসেবে কাজ করছেন। তাঁদের অভিজ্ঞতা আমাদের কাজে লাগাতে হবে। এ ছাড়া আমাদের ফার্মেসীর অবস্থান জীববিজ্ঞান, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের মধ্যে কোথায়, তা নিয়েও আমাদের স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। ফার্মেসী একটি অনন্য বিষয় এবং পেশা হিসেবেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। হেলথ সায়েন্স বা মেডিকেল সায়েন্সের সঙ্গে ফার্মেসীর তুলনা করা চলে না। এ কারণে, পেশাগত সাবজেক্ট হিসেবে ফার্মেসীকে পুরোপুরি স্বীকৃতি দিতে হলে পাঁচ বছরের পেশাগত ডিগ্রি নিয়ে কোনো ধরনের আপস করা যাবে না।
ওষুধ উৎপাদন থেকে শুরু করে রিটেইল ফার্মেসী এবং হসপিটাল ফার্মেসীতে ফার্মাসিস্টদের উপস্থিতি জরুরি, এবং এর গুরুত্ব বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) গাইডলাইনেও স্পষ্ট। WHO অনুযায়ী, একজন গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টের ৫৫% কমিউনিটি ফার্মেসীতে, ৩০% হসপিটাল ফার্মেসীতে, ৫% সরকারি প্রতিষ্ঠানে, ৫% শিক্ষা ব্যবস্থায়, এবং বাকি ৫% ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে কাজ করার কথা। তবে বাংলাদেশে প্রায় ৯৫% ফার্মাসিস্ট কেবলমাত্র ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, যা স্বাস্থ্যসেবার একটি বড় ঘাটতি সৃষ্টি করছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে হাসপাতালের সংখ্যা প্রায় ৬৫৪টি এবং এসব হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা প্রায় ৫১,৩১৬টি। এত বিশাল সংখ্যক হাসপাতালে ডাক্তার, নার্স এবং স্বাস্থ্য প্রযুক্তিবিদদের উপস্থিতি থাকলেও, গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টের সংখ্যা শূন্য। অথচ স্বাস্থ্যসেবা খাতে ডাক্তার, নার্স এবং স্বাস্থ্য প্রযুক্তিবিদদের কাজ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি ফার্মাসিস্টদের ভূমিকা অত্যাবশ্যক। বিশেষ করে, সঠিকভাবে ওষুধ সংরক্ষণ, রোগীর জন্য সঠিক ওষুধ ও ডোজ নির্ধারণ, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া প্রতিরোধ, ফার্মাকোভিজিলেন্স কার্যক্রম পরিচালনা—এসব ক্ষেত্রে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের উপস্থিতি অপরিহার্য। ২০১৬ সালের জাতীয় ওষুধনীতি এবং ২০২৩ সালের ওষুধ ও কসমেটিক আইনেও পর্যায়ক্রমে সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের তত্ত্বাবধানে আন্তঃবিভাগ এবং বহির্বিভাগে হসপিটাল ফার্মেসী চালু করার সুপারিশ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের বর্তমান স্বাস্থ্যসেবার বিপর্যস্ত অবস্থা আরও একটি চিত্র ফুটিয়ে তোলে—আমরা প্রায় ১৬০টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করি, অথচ আমাদের রোগীরা উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যান। এই বৈপরীত্য বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার ভঙ্গুর অবস্থার দৃষ্টান্ত। এর প্রধান কারণ হলো ফার্মাসিস্টদের স্বাস্থ্যসেবা খাতে অনুপস্থিতি। তাই দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করে, হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত সংখ্যক ফার্মাসিস্ট নিয়োগের মাধ্যমে হসপিটাল ও ক্লিনিক্যাল ফার্মেসীর ব্যবস্থা অতি দ্রুত চালু করা উচিত।

অধ্যাপক ড. মো. শাহ এমরান,
ফার্মাসিউটিক্যাল কেমেস্ট্রি বিভাগ, ফার্মেসী অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


"ভুল ওষুধ নিয়ন্ত্রণে দরকার হসপিটাল ফার্মাসিস্ট"

উন্নত বিশ্বের হাসপাতালগুলোতে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা বহির্বিভাগ, জরুরি বিভাগসহ সব বিভাগে, এমনকি ওয়ার্ডেও চিকিৎসক ও নার্সদের সাথে সমন্বয় করে সফলতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। অথচ, ১৯৬৫ সালে ফার্মেসী শিক্ষা চালু হওয়ার পরেও, আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রকৃত অর্থে গ্র্যাজুয়েট হসপিটাল ফার্মাসিস্টের কার্যক্রম শুরু হয়নি। এর ফলে দেশের রোগীরা ওষুধ পেলেও ভুল ব্যবহার, সঠিক ডোজের অভাবসহ নানা সমস্যায় পড়ছেন। এমনকি, ভুল ওষুধ সেবনের কারণে অতীতে মৃত্যুর মতো বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
২০১৬ সালের ওষুধ নীতিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ওষুধের উৎপাদন, নিয়ন্ত্রণ এবং সরবরাহের প্রতিটি ক্ষেত্রে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োজিত থাকতে হবে। হাসপাতালগুলোতে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে এবং ওষুধ প্রশাসনে ফার্মাসিস্টদের দিয়ে তদারকির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ২০১৮ সালের বাংলাদেশ গেজেটে পরিষ্কারভাবে তিনটি স্থানে—মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতালগুলোতে—গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টের পদ সৃষ্টির বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।
হসপিটাল ফার্মাসিস্টদের মূল দায়িত্ব হলো রোগীর জন্য নিরাপদ ওষুধ নিশ্চিত করা, ওষুধের নিরাপদ ব্যবহার ও তার তদারকি করা। ফার্মাসিস্টদের তত্ত্বাবধানে থাকলে ওষুধ ব্যবহারের সঠিকতা যেমন নিশ্চিত হবে, তেমনি সরকারের ওষুধের খরচ ও অপচয়ও কমবে। জনগণ সঠিক নিয়মে ওষুধ পাবে, এবং ওষুধের মানও বজায় থাকবে। ভুল ওষুধের কারণে মৃত্যুর মতো বিপজ্জনক ঘটনা থেকে অনেক রোগী রক্ষা পাবে।
ডাক্তারদের কাজেও গতি আসবে, কারণ ফার্মাসিস্টরা ওষুধ সংক্রান্ত দায়িত্ব পালন করলে চিকিৎসকদের কিছুটা কাজের চাপ কমে যাবে। তাই, নীতি নির্ধারকদের প্রতি আহ্বান, ডিজিটাল বাংলাদেশের চিকিৎসা সেবাকে উন্নত বিশ্বের মতো আধুনিক ও সফল করতে, দ্রুত হাসপাতালগুলোতে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন।

মো. হারুন- অর রশিদ,
সভাপতি, বাংলদেশে ফার্মাসিস্ট ফোরাম। 

"বাংলাদেশে উপেক্ষিত এবং পিছিয়ে হসপিটাল ফার্মেসী"

১৯৭১ সালে হাজার বছরের সংগ্রামী বাঙালি জাতি পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীনতা অর্জন করলেও, আজ এত বছর পরও বাংলাদেশের ফার্মেসি ব্যবস্থায় সুশৃঙ্খল পরিবর্তন আসেনি। এখনো দেশের কোনো ডাক্তার যখন ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন, ফার্মেসিতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে একজন সেলসম্যান বা এমন কেউ ওষুধ বিতরণ করছে, যার ফার্মেসীতে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রিই নেই। অথচ উন্নত দেশগুলোতে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট ছাড়া ওষুধ বিতরণ করা তো দূরের কথা, তা কল্পনারও বাইরে। সেখানে ডাক্তারদের প্রেসক্রাইবড ওষুধ কোনো ফার্মাসিস্টের কাউন্সেলিং ছাড়া রোগীদের দেওয়া হয় না।
উন্নত বিশ্বে, যখন ডাক্তার রোগ নির্ণয় করেন এবং সেই রোগের জন্য নির্দিষ্ট ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন, তখন ওষুধের ডোজ ও রোগের সামঞ্জস্য একজন গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টও দেখেন। অথচ আমাদের দেশে এ কাজ শুধুমাত্র ডাক্তাররাই করে থাকেন, যা মূলত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) নির্দেশিকার পরিপন্থী। উন্নত দেশগুলোতে ডাক্তার ওষুধ বা তার ডোজ সঠিকভাবে সংযুক্ত করার জন্য ওই হাসপাতাল বা ক্লিনিকে কর্মরত গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টের সঙ্গে আলোচনা করে থাকেন। এটি চিকিৎসক ও ফার্মাসিস্টের মধ্যে রোগীর স্বার্থে তৈরি হওয়া এক প্রকার মিথোজীবী সম্পর্ক। যেসব উন্নত দেশে পেশাজীবী ফার্মাসিস্টদের সঠিক মূল্যায়ন করা হয় এবং রোগীর সঠিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হয়, সেখানে হসপিটাল ফার্মেসি, ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি এবং কমিউনিটি ফার্মেসিতে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টের লিখিত নির্দেশ ছাড়া কোনো ওষুধ সরবরাহ করা হয় না। সাধারণত ফার্মাসিস্টের রিকুইজিশন ছাড়া কোনো ওষুধ আসে না এবং সেখানে অনুমোদনহীন ও মানহীন ওষুধ সরবরাহের সুযোগ নেই। ফার্মাসিস্টের রিকুইজিশনে আসা ওষুধগুলো একজন গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টের তত্ত্বাবধানে ফার্মেসি সহকারীরা সঠিক স্থানে রাখেন।
উদাহরণস্বরূপ, থার্মোলেবেলড ওষুধ (যেমন ইনসুলিন, ভ্যাকসিন) নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় (২-৮℃) সংরক্ষণ করা, হিট সেনসিটিভ ও ওপথালমিক ওষুধ সরাসরি আলো থেকে দূরে রাখা, এবং অ্যান্টিবায়োটিক ও কেমোথেরাপির ওষুধগুলো Lock & Key সিস্টেমে রাখা—এসব কাজের দায়িত্ব শুধুমাত্র একজন পেশাজীবী ফার্মাসিস্টের। WHO এর নিয়ম অনুযায়ী এসব নিয়ম উন্নত দেশগুলোতে কঠোরভাবে মনিটর করা হয় এবং এর ব্যত্যয় ঘটলে দায়িত্বপ্রাপ্ত ফার্মাসিস্ট ইনচার্জের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
হসপিটাল ফার্মাসিস্টরা রোগীদের সঠিকভাবে বোঝানোর জন্য প্রতিটি ওষুধের লেবেলিং করেন—কখন ও কী পরিমাণে ওষুধ খেতে হবে, ওষুধের ধরন, পরিমাণ ও ডোজ সম্পর্কে রোগীদের পরিষ্কার ধারণা দেন। প্রতিটি ওষুধ রোগীদের কী অনুপাতে দেওয়া হচ্ছে তা কম্পিউটারে হিসাব করে ডাটা তৈরি করা হয় এবং সেই অনুপাতে মাসিক রোগীর রেকর্ড ও বিতরণ করা ওষুধের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। এছাড়াও, ওষুধ বিতরণের ক্ষেত্রে "First In, First Out (FIFO)" এবং "Last In, First Out (LIFO)" নিয়ম নিশ্চিত করার দায়িত্বও হসপিটাল ফার্মাসিস্টদের। কিন্তু বাংলাদেশে এ প্র্যাকটিসগুলো প্রায়ই উপেক্ষিত হয়। এখানকার অনেক বড় বড় সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের ফার্মেসীতে এখনো তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা ওষুধ অর্ডার করছেন, যারা ওষুধ সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখেন না।
বাংলাদেশের ফার্মেসী শিক্ষাব্যবস্থাও অনেকাংশে শিল্প-কেন্দ্রিক। বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসী কোর্স ৪ বছরের, যেখানে অন্যান্য দেশে এই কোর্সের মেয়াদ ৫ বছর। উদাহরণস্বরূপ, "ইউনিভার্সিটি অব কুয়েত"-এ ফার্মেসীর শিক্ষার্থীরা ফার্ম-ডি ডিগ্রির প্রথম বছর ইন্টার্নি করে, যেখানে তারা চিকিৎসকদের সঙ্গে কাজ করে বিভিন্ন বিভাগের রোগের ওষুধ এবং ডোজ সম্পর্কে প্রায়োগিক জ্ঞান অর্জন করে। এতে তারা ওষুধের ডোজ ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বাস্তব ধারণা অর্জন করে।
উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে "থেরাপিউটিক্স অ্যান্ড পেশেন্ট কেয়ার" নামে একটি বিষয় রয়েছে, যা অত্যন্ত কার্যকর ও ফলপ্রসূ। বাংলাদেশের ফার্মেসি শিক্ষাব্যবস্থায় এই যুগোপযোগী বিষয়টি যুক্ত করা সময়ের দাবি, না হলে আমাদের তরুণ ফার্মাসিস্টরা অনেক মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও গ্লোবাল ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকবে। বাংলাদেশে হসপিটাল ফার্মেসী প্র্যাকটিস চালু করতে এর কোনো বিকল্প নেই।
এখানে ইন্টার্নি সাধারণত ১০-১৫ দিনের হয়, তাও আবার শুধুমাত্র ইন্ডাস্ট্রির মেশিনারিজ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের জন্য, যা শুধু বাংলাদেশেই ব্যতিক্রম! এই কারণেই মেডিকেল সেক্টরের সাথে ফার্মাসিস্টরা রোগী সেবায় ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকার পরও সাধারণ জনগণ তা জানে না। সকল প্রতিবন্ধকতা ও অন্ধকার কাটিয়ে, উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশের জনগণকেও একজন পেশাজীবী ফার্মাসিস্টের মাধ্যমে সঠিক ওষুধ সেবা দেওয়ার প্রত্যাশা করছি।

মো ইউছুফ আল আমিন,
ক্যাপ্টেন(ফার্মাসিষ্ট), কুয়েত আর্মি হেডকোয়ার্টারস ক্লিনিক, কুয়েত।

"চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নতিতে হসপিটাল ফার্মাসিস্টের ভূমিকা"

আমাদের দেশে ফার্মাসিস্ট বলতে সাধারণত অনেকে বোঝেন ইন্ডাস্ট্রি, কোয়ালিটি কন্ট্রোল, প্রোডাকশন বা ফার্মেসী দোকানের সঙ্গে জড়িত পেশাজীবী। অনেকেই প্রশ্ন করেন, “ফার্মেসী পড়ে কি করবে? ওষুধের দোকান দিবে?” এ-গ্রেড বা গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের প্রকৃত ভূমিকা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা খুবই সীমিত। অথচ একজন ফার্মাসিস্ট চার থেকে পাঁচ বছরের অনার্স সম্পন্ন করে ওষুধ এবং তার সঠিক ব্যবহারের উপর বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেন।
ডাক্তারদের কাজ মূলত রোগ নির্ণয় করা। রোগীকে কী ওষুধ দিতে হবে, কতটুকু পরিমাণে খেতে হবে (উচ্চতা ও ওজন বিবেচনায়), খাবারের আগে না পরে খেতে হবে এবং ওষুধ কীভাবে কাজ করবে, এসব বিষয় একজন ফার্মাসিস্টের অধীনে থাকে। উন্নত দেশগুলোতে ফার্মাসিস্টরা প্রেসক্রিপশনও করতে পারেন, যা আমাদের দেশে এখনো কল্পনার বাইরে। প্রতিবছর অনেক ফার্মাসিস্ট গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেও বেকার থাকে, কারণ তারা বুঝতে পারে না কীভাবে তারা সমাজে অবদান রাখতে পারে।
যদি প্রতিটি হাসপাতালে একজন করে হসপিটাল ফার্মাসিস্ট নিযুক্ত করা হয়, তাহলে ফার্মাসিস্টদের কাজের সুযোগ বাড়বে এবং মানুষও বুঝতে পারবে ফার্মাসিস্টদের প্রকৃত অবদান কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের "ফুড ফর দ্য হাংরি" এনজিওর অধীনে তিনটি হাসপাতাল রয়েছে, যেখানে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা হসপিটাল ফার্মাসিস্ট হিসেবে কাজ করছেন। সেখানে ডাক্তাররা প্রেসক্রিপশন দেওয়ার পর ফার্মাসিস্টরা সেই প্রেসক্রিপশন বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত করেন যে, রোগ অনুযায়ী ওষুধের রেশনাল ব্যবহার হচ্ছে কিনা, ওষুধের সাথে ওষুধের মিথস্ক্রিয়া আছে কিনা, কিংবা রোগীর অন্য কোনো রোগের সঙ্গে নতুন ওষুধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে কিনা।
ফার্মাসিস্টরা রেশনাল ড্রাগ ইউজ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা ফার্মেসি অ্যান্ড থেরাপিউটিক কমিটিতেও বিশাল ভূমিকা পালন করেন, যেমন—অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স সম্পর্কে জানা, অ্যান্টিবায়োটিক সঠিকভাবে কবে এবং কীভাবে ব্যবহার করতে হবে, এবং কখন ব্যবহার করা যাবে না—এসব বিষয়ে ফার্মাসিস্টরাই সবচেয়ে ভালো পরামর্শ দিতে পারেন।
ডাক্তাররা কখনো কখনো বিভিন্ন কারণে প্রেসক্রিপশনে ভুল করতে পারেন, তা হতে পারে জ্ঞানের অভাব, কাজের চাপ, নিয়মিত মনিটরিংয়ের অভাব বা ফার্মাসিস্টের দ্বারা প্রেসক্রিপশন মূল্যায়ন না হওয়ার কারণে। শুধুমাত্র ডাক্তারদের ওপর ভরসা করায় অনেক রোগী ভুল চিকিৎসা নিচ্ছেন, যা হয়তো অনেকের অজানা। ফার্মাসিস্টরা প্রেসক্রিপশন রিভিউ করার মাধ্যমে রোগীদের সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারেন।
তাই প্রতিটি হাসপাতালে একজন করে হসপিটাল ফার্মাসিস্ট থাকা অত্যন্ত জরুরি। যেহেতু আমাদের দেশ এখন বিভিন্ন খাতে সংস্কারের পথে এগিয়ে যাচ্ছে, তাই হসপিটাল ফার্মাসিস্ট নিয়োগের বিষয়েও গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কারণ ফার্মাসিস্টরা সবসময়ই মানুষের কল্যাণে কাজ করেন।

রূপা দেব,
ফার্মেসী লীড, ফুড ফর দ্যা হাংরী।

"স্বাস্থ্য নিশ্চিতে হসপিটাল ফার্মেসী গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ সংগঠন"

বর্তমান সমাজে চিকিৎসাকেন্দ্র এবং হাসপাতালগুলো একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে এসব প্রতিষ্ঠানের একটি অপরিহার্য অংশ হলো হসপিটাল ফার্মেসি। হসপিটাল ফার্মেসী মূলত হাসপাতালের যাবতীয় ওষুধপত্রের সঠিক ব্যবস্থাপনা, বিতরণ ও মান নিয়ন্ত্রণে জড়িত। এটি পরিচালিত হয় নিয়োগপ্রাপ্ত হসপিটাল ফার্মাসিস্টদের মাধ্যমে, যারা ওষুধের সঠিক স্টক, গুণগত মান যাচাই ও বিতরণ নিশ্চিত করেন। এই কারণে, একজন হসপিটাল ফার্মাসিস্টের উপস্থিতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
হসপিটাল ফার্মাসিস্টরা রোগীদের ওষুধ সংক্রান্ত তথ্য সরবরাহ করেন এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে কম্বিনেশন ডোজ পর্যালোচনা করে ওষুধ ডিসপেন্স করেন। চলমান ওষুধের সাথে সামঞ্জস্য রেখে নতুন ওষুধ প্রেসক্রাইব করা, এবং রোগীর শরীরে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা বিষক্রিয়া যাতে না হয়, সে বিষয়েও তারা সতর্ক থাকেন। ওষুধ সেবনের পর তার কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ করা, এবং হাসপাতালের মেডিসিন চার্ট নিয়মিত পর্যালোচনা করে সঠিক রোগের জন্য সঠিক ওষুধ নিশ্চিত করাও তাদের কাজের অন্তর্ভুক্ত। হসপিটাল ফার্মাসিস্ট রোগীদের বোঝান কোন রুটে এবং কোন ডোজে ওষুধ সেবন করতে হবে, এবং হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পাওয়া পর্যন্ত তাদের পর্যবেক্ষণ ও পরামর্শ প্রদান করে থাকেন। তারা সেবিকা, স্বাস্থ্যকর্মী এবং টেকনিশিয়ানদের সঙ্গে পরামর্শ করে তাদের সহায়তাও করেন। কোনো জটিল রোগের ক্ষেত্রে চিকিৎসক ও ফার্মাসিস্ট যৌথভাবে পরামর্শ করে সঠিক চিকিৎসা প্রয়োগের মাধ্যমে রোগীর উপযোগী ওষুধ নিশ্চিত করেন।
এছাড়াও, ওষুধ নকল নাকি আসল তা নিশ্চিত করা, এবং রোগীর জন্য সর্বোত্তম চিকিৎসা প্রদানের লক্ষ্যে ফার্মাসিস্টের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আজকের দিনগুলিতে, ওষুধ সহজলভ্য হওয়ার পেছনে এবং ওষুধ শিল্পের উন্নয়নের মূলে ফার্মাসিস্টদের অবদান অসীম। ফার্মাসিস্টরা শুধু ওষুধের গবেষণায় নয়, দেশের হাসপাতালগুলোতে কাজ করে উন্নত ও সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও অপরিসীম ভূমিকা পালন করছেন।
হসপিটাল ফার্মাসিস্টদের সঠিকভাবে কাজে লাগানো হলে দেশ ও জাতি উভয়েই ব্যাপকভাবে উপকৃত হবে।

সিদরাত মুনতাহা ঝিলাম
শিক্ষার্থী, ফার্মেসী বিভাগ,
গণ বিশ্ববিদ্যালয়।

এমএসএম / এমএসএম