দীর্ঘ ৮ মাসেও সন্ধান পায়নি কারা কর্তৃকক্ষ
ফ্যাসিস্ট সরকারে প্রতাপশালী জেলার মাহবুবের লাপাত্তা

ধনকুপের মালিক আওয়ামী লীগ সরকার আমলের প্রতাপশারী কারা কর্মকর্তা মাহাবুব আলম ওরফে মিলন লাপাত্তা। স্বৈরাচারী সরকার ও বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের শেষ মূহুর্তে তিনি গা-ঢাকা দিয়েছেন তিনি। তাকে তার কর্মস্থলে যোগদানের জন্য কর্তৃপক্ষ একাধিকবার কৈফিয়ত চেয়ে পত্র প্রেরণ করা হলেও তিনি কর্মস্থলে যোগাদান করেননি বলে কারা অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে।
ঢাকা কারা অধিদপ্তরের সহকারি কারা মহাপরিদর্শক মো. জান্নাত-উল ফরহাদ সকালের সময়কে জানান, ঢাকা কারাগারের সাবেক জেলার মাহবুব আলম কুমিল্লায় তার কর্মস্থলে কাজে যোগ দেওয়ার জন্য নোটিশ করা হয়েছি। কিন্তু তিনি এখনো কাজে যোগদান করেননি। এজন্য তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
অত্যান্ত প্রতাপশালী আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছর গুরুত্বপূর্ণ কারাগারে কর্মরত ছিলেন মাহবুব আলম আর তার চাকরিজীবনের বেশি সময় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কাটিয়েছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রভাব খাটিয়ে কারাবিধিকে বৃদ্ধাঙ্গলী দেখিয়ে নিয়ম ভেঙে টানা সাত বছর জেলার হিসেবে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের দায়িত্ব পালন করেছেন। আর এই কারাগারে বন্দিদের মাঝে মাদক, নারী পাচার থেকে শুরু করে নানা সুবিধা দিয়ে কোটিপতি বনে গেছেন। আর এই অবৈধ উপায়ের আয়কৃত অর্থ বিদেশে পাচার করাসহ ইটালিতে বাড়ি করারও অভিযোগ উঠেছে।
শুধু তাই নয়, মাহবুব আলম দুর্নীতি অনিয়ম অপেন সিক্রেট ছিল। তার বিরুদ্ধে যেন কোন প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় দুর্নীতি অনিয়মের সংবাদ প্রচার করা না হয়, তার জন্য তিনি কতিপয় ব্যক্তিদের মাসোয়ারা দিতেন। আর তারা আওয়ামী লীগ সকারের ছাত্র সংগঠনের বিভিন্ন পদ পদবী ব্যবহার করে মাহবুব আলমের নানা অপকর্ম আড়াল করতেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রভাবশালী এই জেলার মাহাবুব আলম ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে গত বছরের ১২ মে কুমিল্লা কারাগারে বদলি করা হয়। কিন্তু তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘কাছের লোক’ এবং আস্তাভাজন পরিচয়ে কারা অধিদপ্তরে প্রভাব খাটাতেন। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগের দিন অথাৎ গত বছরের ৪ জুলাই পারিবারিক কারণ দেখিয়ে তিনি পাঁচ দিনের ছুটি নেন। কিন্তু তার পর থেকে এখনো তিনি কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছেন। তবে তার সেই ৫দিন ছুটির মেয়াদ শেষে তিনি স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে ই-মেইলের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দপ্তরে তিন মাসের ছুটির আবেদন পাঠিয়ে দেন। আর সেই ছুটির মেয়াদও গত বছরের ৮ নভেম্বর শেষ হয়েছে। জেলার মাহবুবুল ইসলাম কর্মস্থলে উপস্থিত বা এখনো কারা অধিদপ্তরে কোন প্রকার যোগাযোগ করেননি বলে জানা গেছে।
কারা অধিদপ্তরের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, জেলার মাহাবুব আলম বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ৪ আগস্ট থেকেই কুমিল্লা কারাগার থেকে লাপাত্তা হন। একাধিকবার তার কাছে কৈফিয়ত চেয়ে তার স্থায়ী ঠিকানায় চিঠিও দিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সেই চিঠির পরও উধর্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোন প্রকার যোগাযোগ করেননি।
আরেক সূত্র জানায়, গৈণঅভ্যুত্থানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী পালিয়ে যাওয়ার পর দেশের কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগার, নরসিংদীসহ চার কারাগারের তত্ত্বাবধায়ককে (জেল সুপার) বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে সরকার। আর গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর তাদের অবসর-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সরকারি চাকরি বিধি আইনের ৪৫ ধারা অনুযায়ী, জনস্বার্থে তাদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর বিধান রয়েছে। আর গণঅভ্যুত্থানের পর এই চারজন ছাড়া কারা অধিদপ্তরের কারও বিরুদ্ধে কোন প্রকার ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। জেলার মাহাবুব আলম গত ২০০৩ সালের ৫ আগস্ট ডেপুটি জেলার হিসেবে যোগ দেন। তার প্রথম কর্মস্থল ছিল পিরোজপুর কারাগার। এরপর ২০০৫ সালের নভেম্বরে বদলি হয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আসেন। এরপর ১/১১-এর সময় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গ্রেফারের পর সংসদ ভবন এলাকায় যে ভবনে বন্দি ছিলেন, সেখানকার ডেপুটি জেলার হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন মাহাবুব। আর সেই সুবাদে তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিতি পান। গত ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে সহকর্মী ও কারা কর্মকর্তাদের কাছে হাসিনার খুব কাছের মানুষ হিসেবে পরিচয় বহন করতেন।
গত ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর পদোন্নতি ছাড়াই তাকে জেলারের দায়িত্ব দেওয়া হয়। আর সেই বছরের ফেব্রুয়ারিতে জেলার হিসেবে (চলতি দায়িত্ব) মুন্সীগঞ্জ কারাগারে যোগ দেন তিনি। আবার একই বছরের অক্টোবরে নারায়ণগঞ্জ কারাগারের দায়িত্ব পান। সেখানে প্রায় ১১ মাসের মাথায় ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার হিসেবে যোগ দেন। গত ২০১২ সালের জুলাইয়ে জেলার পদে স্থায়ী হন তিনি। তিন বছর ৩ মাস ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর গত ২০১৪ সালের আগস্টে বদলি হন, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে। তার দুই বছর পাঁচ মাস পর পুনরায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার হয়ে আসেন মাহাবুব আলম।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কারা কর্মকর্তা জানান, গুরুত্বপূর্ণ কারাগারে দুই বছরের বেশি কোনো জেলরের দায়িত্ব পালনের সুযোগ না থাকলেও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলর মাহবুব আলম ব্যতিক্রম ছিলেন। তিনি ২০১০ সাল থেকে কোন না কোনভাবে ঢাকা কারাগারে ছিলেন। কারা কর্মকর্তাদের বদলি নিয়ে বাণিজ্য এবং বন্দি ও ম্যাটদের কাছ থেকে নিয়মিত উৎকোচ নেওয়ার বিষয়টি অপেন সিক্রেট ছিল। কারাগারে ভালো সেলে থাকার সুযোগ দিয়ে প্রতি বন্দির কাছ থেকে মাসে ৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিতেন। আবার কোন সেলে কী ধরনের খাবার যাবে, তাও তিনি নির্ধারণ করে দিতেন। সব মিলিয়ে কারাগারের অঘোষিত ‘রাজা’ বনে যান এই মাহবুব আলম।
ভুক্তভোগিদের কাছ জানা গেছে, জেলার মাহবুব আলম নিজেকে আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ সমর্থক বলে দাবি করলেও তা বিরুদ্ধে বন্দি রাজনৈতকি নেতাদের মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে সহযোগিতা করতেন। আর জেলারের দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জামায়াতের সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামীর সঙ্গেও কোলাকুলির করার প্রমাণ রয়েছে। আবার নতুন কোনো বন্দি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যাওয়ার পর তাকে গরু-ছাগলের মতো ‘বিক্রি’ করেন মাহবুব। সকালে কেস টেবিলে গিয়ে তিনি ম্যাট, রাইটার এবং দালাল বন্দি ও রক্ষীদের মাধ্যমে বেচাকেনা শুরু করতেন। যদি কোনো বন্দি ৯০ সেলে যেতে চাইলে তাকে মাসে গুনতে হয় পাঁচ হাজার টাকা। আর ১০ সেলে যেতে চাইলে সাত হাজার, ৭ সেলে ১৫ হাজার, ২০ সেলে চার হাজার, ২৭ সেলে পাঁচ হাজার এবং ৬ সেলে যেতে হলে সাত হাজার টাকা দিতে হতো। এতে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা আয় করতো। আর সেই টাকা দুর্নীতিবাজ কতিপয় কর্মকর্তাদের মাঝে ভাগবাটোয়ারা করে নিতেন। আর সেই ভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জেলার মাহবুুব আলম পেতেন। আবার যেসব বন্দির টাকা দেওয়ার সামর্থ থাকতো না, তাদের সবচেয়ে কষ্টের সেল পদ্মা, মেঘনা, মনিহার, সুরমা ও যমুনায় পাঠানো হতো।
অপর এক সূত্র জানায়, জেলার মাহবুব তার অনুসারীদের দিয়ে কারাগারের ভেতরে মাদকদ্রব্য বিক্রি করতেন। নারী ও শিশু নির্যাতন মামলায় শ্যামপুরের কমিশনার রোডের একজন আসামি গ্রেফতার হয়ে কারাগারে যান। তাকে তিন মাসের বেশি সময় মনিহার সেলে রাখা হয়েছে। আর মতিহার সেল হচ্ছে, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সবচেয়ে কষ্টের সেল। তার বাবা ছেলের কষ্টের কথা শুনে দালালের মাধ্যমে একটু ভাল জায়গায় রাখার চেষ্টা করেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে দালাল খুঁজতে ছিলেন। তার দুই দিন পর মনির নামে এক দালাল পেয়ে যান। তাকে ১০ হাজার টাকা দিলে তিনি জেলার মাহবুব আলমের মাধ্যমে তার ছেলেকে এক মাসের জন্য হাসপাতালে থাকার ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রুতি দেন। বিশ্বাসের ওপর তাকে দশ হাজার টাাক দেন। এরপর পরদিন তার ছেলেকে দেখতে গিয়ে জানতে পারেন, তাকে সত্যিই কারা হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
আবার রাজধানীর পুরান ঢাকার লালবাগ এলাকার সাত্তার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ছিলেন। তিনি জামিনে এসে জানান, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মনিহার-২ সেলে বন্দি ছিলেন তিনি। সেখানে কষ্টের অন্ত ছিল না। তবে ম্যাটকে টাকা দিলে কিছুটা শান্তি পাওয়া যেত। সেই সেলটিতে ধারণক্ষমতার ১০-১২ গুণ বেশি বন্দি রাখা হতো। ফলে রাতের বেলায় কেউ ঘুমাতে পারতো না। সেই সেলে ম্যাটের হাতে টাকা টাকা গুঁজে দিলে তাকে ভাল জায়গা ছাড়াও ভালো থালা, বাটি ও কম্বল দেয়া হতো। তিনি বলেছেন, কারাগার তো নয়, এ যেন দোজখ। কারো কপালে যেন ওই সেল না জোটে। তিনি একদিন সেখানে গোসলও করতে পারিনি। গোসলের জন্যও টাকা নেওয়া হতো। এ ব্যাপারে জেলার মাহাবুব আলমের মোবাইল নম্বরে ফোন করা হলের তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
এমএসএম / এমএসএম

প্রধান প্রকৌশলীর পিএস মুজিবরের মাসিক অবৈধ আয় লাখ টাকা!

অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ সামাদ ভূঁইয়া দম্পতি বিরুদ্ধে

যাদের কথা হয়না বলা

অভাবির পেটের ভাড়া ৩০ হাজার টাকা

ফ্যাসিস্ট সরকারে প্রতাপশালী জেলার মাহবুবের লাপাত্তা

অবৈধ সম্পদের পাহাড় নিয়ে ওসমান গণির রাম রাজত্ব কায়েম

মিরপুরের ত্রাস তানজিব গ্রেফতার, জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য

১৭ বছর পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তা আমিনুল

বিতর্কিত প্রধান শিক্ষিকা নার্গিস আক্তারের বিরুদ্ধে আবারো তদন্ত কমিটি গঠন

প্রিমিয়ার গ্রুপের ইকবাল গেছে পালিয়ে, দুর্নীতির দুর্গ আছে দাঁড়িয়ে

অর্থ শাখায় চাকরি করেই শত কোটি টাকার মালিক মাহবুবুর রহমান

ঈদ সামনে রেখে জাল নোট তৈরির কারিগর ব্যস্ত
