ঢাকা বুধবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৫

আশুলিয়ায় অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে ভিক্ষাবৃত্তি


সফি সুমন, আশুলিয়া photo সফি সুমন, আশুলিয়া
প্রকাশিত: ২৬-১১-২০২৫ দুপুর ১:৪১

আশুলিয়ার ব্যস্ত রাস্তায় অসহায় করুণভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ গুলোকে দেখলে প্রথম দেখায় দয়া ও মায়া জাগে। কিন্তু একটু গভীর নজর ফেললেই বোঝা যায়, এদের অনেকেই এখন আর দুঃখে ভিক্ষা করে না; ভিক্ষাই তাদের লাভজনক পেশা।
একসময় ভিক্ষাবৃত্তি ছিল সমাজের অতিদরিদ্র, মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হওয়া মানুষের শেষ আশ্রয়। কিন্তু আশুলিয়ার সাম্প্রতিক চিত্র বলছে দারিদ্র্য নয়, সহজ আয় আর দ্রুত লাভই এখন এই পেশার মূল চালিকাশক্তি। এ যেন ভিক্ষা নয় শ্রেফ ‘স্ট্রিট বিজনেস’!

আশুলিয়ার ইপিজেড, বাইপাইল, নবীনগর, কলমা, আশুলিয়া বাজার, বিরুলিয়া, কাঠগড়া, চৌরাস্তা, জামগড়া ও নয়ারহাট এলাকায় সকাল বিকাল দেখা যায় অত্যন্ত কৌশলে ভিক্ষা সংগ্রহ করা নতুন প্রজন্মের ভিক্ষুক। তাদের আচরণে নেই লজ্জা, নেই সংকোচ বরং আত্মবিশ্বাস, ব্যবসায়িক দক্ষতা এবং লক্ষ্যভিত্তিক পরিকল্পনা।
কেউ গাড়ির উইন্ডশিল্ডে টোকা দিয়ে “মিনিটে টাকা” আদায় করে। কেউ অভিনয় করে শারীরিক অক্ষমতার। কেউ মেকআপ করে ‘অতি করুণ’ সাজে ক্যামেরা-রেডি চরিত্র তৈরি করে। কেউ বাচ্চা কোলে নিয়ে দিনের আয়ে দ্বিগুণ তোলেন। কেউ বাসের ভেতর এসে ‘প্রস্তুত স্ক্রিপ্ট’ পড়ে শোনায়। এদের চলাফেরা, চাহনি, হাত বাড়ানোর ধরন সবকিছুতেই রয়েছে পেশাদারিত্বের ছাপ।

স্থানীয় দোকানিদের ভাষায়, “ভাই, এই ভিক্ষুকরা দিনে যত রোজগার করে, আশেপাশের গার্মেন্টস শ্রমিকও মাসে তত বেতন পায় না। অনেকে সকাল ও বিকাল মিলিয়ে মাত্র ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা ভিক্ষা করে ১,২০০ থেকে ১,৮০০ টাকা কামায়। উৎসবের মৌসুমে তো কথাই নেই। দৈনিক নিম্নতম ৭ থেকে ১২ হাজার টাকারও বেশি। নরমাল প্রতিমাসে ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা কামানো অস্বাভাবিক কিছুই নয়।”
এ আয় কোনো শ্রমিক, রিকশাচালক বা পথশ্রমজীবীর দ্বিগুণেরও বেশি। ফলে এই ‘সহজ পেশা’তে মানুষ যুক্ত হচ্ছে দ্রুত, এবং এটাই আশুলিয়ার ভিক্ষাবৃত্তি বাড়ার মূল কারণ। মানুষ এ ধরনের লোক দেখে মনে করে তিনি নিশ্চয়ই অসহায়, ক্ষুধার্ত ও নিরুপায়। মানবিক দয়া থেকে এগিয়ে দেয় দান সদকা। কিন্তু দুঃখজনক সত্য; দাতা কখনো জানতেই পারে না, তার সেই পবিত্র দান অনেক সময় পৌঁছে যায় ‘ভিক্ষুক’ পরিচয়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকা একদল প্রতারক চক্রের হাতে। অসহায়ত্বের মুখোশ পরে যারা প্রতিদিন মানুষের বিশ্বাসকে পুঁজি করে লাভের ব্যবসা চালায়, তাদের অভিনয়ের আড়ালে হারিয়ে যায় প্রকৃত দরিদ্র ক্ষুধার্ত মানুষের সত্যিকারের কান্না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রকৃত অসহায় এক বৃদ্ধা বলেন, “আমার সত্যিই কেউ নাই। বয়স হয়েছে, কাজ করতে পারি না। কিন্তু লোকজন আমাকে সন্দেহের চোখে দেখে। কারণ প্রতারক ভিক্ষুকরা এত বেড়ে গেছে যে, আমাদের মতো সত্যিকারের অসহায়ও আজ বিশ্বাস হারিয়েছে মানুষের চোখে।”
মমতাজ বেগম নামে একজন দান সদগাকারী নারী পথচারী জানান, “হাসপাতালে বাচ্চা না’কি তার বাবা মা ভর্তি আছে বলে কেঁদেকেটে টাকা চাইল এক মহিলা। মায়া করে দিলাম। সপ্তাহখানেক পর দেখি অন্য জায়গায় একই গল্প বলছে। তখন বুঝলাম আমাদের দয়া আর বিশ্বাসকে ওরা ব্যবসার পুঁজি বানিয়ে নিয়েছে।”

গোপনে অনুসন্ধানে জানা যায়, ভিক্ষুকদের মধ্যে অনেকেই স্বচ্ছন্দ জীবনযাপন করে। ফুটপাতের চরিত্র শুধু অভিনয়। অনেক পেশাগত ভিক্ষুক সুন্দর ভাড়া বাসায় থাকে। কেউ কেউ ভিক্ষাবৃত্তি করে আশুলিয়া এলাকায় নিজেই হয়েছেন বাড়ির মালিক। কেউ আবার স্মার্টফোন ব্যবহার করে লাইভ করে ‘সহানুভূতি ব্যবসা’ পরিচালনা করে।

সাভার ও আশুলিয়ার নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক সালাহউদ্দিন খান নঈম বলেন, “এখন ভিক্ষাবৃত্তি শুধু দারিদ্র্যের ফল নয়; এটি অনেক এলাকায় লাভজনক পেশায় পরিণত হয়েছে। দিনে ১,৫০০ থেকে ২,০০০ টাকা পর্যন্ত রোজগার করে এমন “পেশাদার ভিক্ষুক” আছে। তাই সমাধান শুধু দয়া নয়, প্রতারক চক্র ভাঙা এবং প্রকৃত দরিদ্রদের সঠিক জায়গায় সহায়তা পৌঁছানো জরুরি”।

পেশাদার এই ভিক্ষুকেরা মলিন কাপড় ও চেহারায় অসাহায়ত্বের ভান ধরে রাস্তায় বের হয়। অন্য সময় তারা দিব্যি সুস্থ ও ভালো পোশাক, চেহারার মলিনতার ভাবলেশ পর্যন্ত পাওয়া যায় না। যেন দিন রাত দুই সংস্করণ। একটিতে করুণা বিক্রি, আরেকটিতে ভোগের জীবন। ভিক্ষাকে পেশা বানানোর সবচেয়ে বড় সুযোগ এটাতে কোনো পরিশ্রম লাগে না। মানুষ পরিশ্রম করে রোজগার করতে চায় না এমন অভিযোগ সমাজে নতুন নয়। কিন্তু আশুলিয়া দেখছে এর বাস্তব রূপ। গার্মেন্টস শ্রমিক দিনে ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা কাজ করে, রিকশাচালক ঘাম ঝরিয়ে রোদে পুড়ে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা পায় আর ভিক্ষুক মাত্র কয়েক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে হাজার বারো’শ টাকার বেশি আয় করে। এ অসম বাস্তবতা সমাজে এক নতুন প্রবণতা তৈরি করেছে। কাজের চেয়ে ভিক্ষাকেই অনেকে এখন ‘লাভজনক’ মনে করছে। প্রকৃত অসহায়ের কষ্ট ঢেকে যায় আধুনিক এই পেশাদার ভিক্ষুকদের অভিনয়ের আড়ালে। ফলে সমাজে করুণা হারিয়ে যাচ্ছে, সহানুভূতিও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।

সাভার উপজেলা সমাজ কল্যাণ কর্মকর্তা মোঃ শহিদুজ্জামান বলেন, “সাভার বা আশুলিয়ায় এখনো পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক ‘ভিক্ষুক নিরোধ অভিযান’ পরিচালিত হয়নি। এ ধরনের অভিযান মূলত রাজধানী ঢাকা মহানগর এলাকায় সীমিত পরিসরে হয়, কিন্তু শিল্পাঞ্চল ঘনবসতিপূর্ণ আশুলিয়া এলাকায় তা কোনোদিন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এর একটি প্রধান কারণ হলো এখানে ভিক্ষাবৃত্তির ধরন জটিল ও সংগঠিত। আমাদের ধারণা, আশুলিয়ার বহু স্পটে এখন দারিদ্র্য নয়, বরং লাভজনক পেশা হিসেবেই ভিক্ষাবৃত্তি চলছে। এখানে মানুষের চলাচল বেশি হওয়ায় আয়ও বেশি। সাভার আশুলিয়ায় যে পেশাদার ভিক্ষুক বেড়েছে, এ অভিযোগ নিয়মিতই আমরা পাচ্ছি। আমরা সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিতে প্রস্তুত, কিন্তু অভিযান পরিচালনা, পথচারী অপসারণ, সিন্ডিকেট চিহ্নিত করা, এসব দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে নির্বাহী প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর পড়ে। প্রতারণামূলক ভিক্ষাবৃত্তির বিষয় আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করব।”

অভিনয়কারীদের কারণে বাস্তব কষ্টের মানুষরাই সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত। প্রশাসন ও সমাজ দু’জনেই যেন নীরব দর্শক। প্রতিদিন শত শত আধুনিক পেশাজীবী ভিক্ষুকদের দখলে সাভার ও আশুলিয়া। এখানে নেই কোনো অভিযান, নেই নজরদারি বা পুনর্বাসনের নজির। একদিকে সহজ লাভে মানুষ ঢুকছে ভিক্ষাবৃত্তিতে, অন্যদিকে প্রশাসন ব্যস্ত অন্য খাতে। এ নীরবতা আগামীতে আরও বড় সামাজিক সমস্যা তৈরি করতে পারে। আশুলিয়ার ভিক্ষাবৃত্তি এখন দারিদ্র্যের চিহ্ন নয়, আরামপ্রিয়তার বাজার। আজকের ভিক্ষুক আর আগের মতো ক্ষুধার্ত মানুষ নয়। অনেকেই এখন পেশাদার। অনেকেই অভিনয় করে। অনেকেই লভ্যাংশ দেখে। অনেকেই এই ‘সহজ পেশা’তে প্রবেশ করতে অন্যদেরও উৎসাহিত করে। সমাজের জন্য এটি বিপদ। কারণ ভিক্ষা যখন পেশা হয়ে ওঠে, পরিশ্রম তখন গুরুত্ব হারায়, আর সমাজ তখন নিজেদের শ্রম ও নৈতিকতা হারায়।

এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) মোবাইলফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কল রিসিভ না করায় তার বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।

এমএসএম / এমএসএম

চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনীর উদ্বোধন

আশুলিয়ায় অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে ভিক্ষাবৃত্তি

‎কুতুব‌দিয়ায় মা-‌ছে‌লেসহ তিনজন অগ্নীদগ্ধ ৩

রাণীনগরে আমন ধনের বাম্পার ফলন ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় হতাশ কৃষকরা

মধুখালি উপজেলা প্রশাসনের মাসিক সভা অনুষ্ঠিত

মনোহরগঞ্জে প্রাণিসম্পদ সপ্তাহ - ২০২৫ উপলক্ষে প্রাণিসম্পদ প্রদর্শনী উদ্বোধ ও আলোচনা সভা

নেত্রকোনার কেন্দুয়ায় সরকারি ৩১টি গাছ কেটে নেওয়ার ঘটনায় বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে মামলা

রাঙ্গামাটিতে তিন দিনের ডিজিটাল মিডিয়া বিষয়ক প্রশিক্ষণ শুরু

কুমিল্লায় বিআরটিএর মোবাইল কোর্ট অভিযান

ময়মনসিংহ বিভাগের ‘শ্রেষ্ঠ জেলা প্রশাসক’ নির্বাচিত হলেন শেরপুরের ডিসি তরফদার মাহমুদুর রহমান

তানোরে সার পাচারকালে ৬০ বস্তা সার জব্দ

মাদকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আওয়াজ তুলতে হবে, মোহনগঞ্জে মাদকের আস্তানা উৎখাতে মশাল মিছিল ও বিক্ষোভ

আত্রাইয়ে জাতীয় প্রাণিসম্পদ প্রদর্শনী সপ্তাহ উদ্বোধন ও উৎসাহী খামারীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ