নওগাঁর পত্নীতলায় চীনামাটির স্তরের আড়ালেই থাকতে পারে উন্নত খনিজসম্পদ : ভূতত্ত্ব জরিপ অধিদপ্তর
নওগাঁর পত্নীতলায় ধামইরহাট-পত্নীতলা আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে আমবাটি নামক স্থানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর উৎকৃষ্টমানের চীনামাটি ও রুপার সন্ধান পাওয়া গেলেও অদ্যাবধি তা উত্তোলনের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে থাকার কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে এই খনির নিদর্শনগুলো।
অনুসন্ধান ও এলাকার প্রবীণদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত টানা দীর্ঘ ১০ বছর ভূতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের একটি শক্তিশালী অনুসন্ধানী দল উক্ত স্থানে জরিপ পরিচালনা, জায়গা নির্ধারণ ও খননকার্য পরিচালনা করে। ভূপৃষ্ঠ থেকে অন্তত ২ হাজার ফুট গভীরে শত শত স্টিলের পাইপ বসিয়ে তারা এ খননকার্য পরিচালনা করে। এ জরিপ ও খনন কার্যক্রম সে সময় স্থানীয় জনসাধারণের মাঝে ব্যাপক সাড়া জাগায়। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিরোধ চরমভাবে দানা বেঁধে উঠতে শুরু করলে ও যুদ্ধ শুরু হলে ক্রমান্বয়ে প্রকল্পটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো সরকারের আমলেই এই খনির প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়নি। দেশের খনিজ মানচিত্রে এ খনিটি একটি বিন্দু হয়ে আছে মাত্র।
খনি এলাকার জমির মালিক আব্দুর রহমান (৬৫) বলেন, আমরা গভীর রাতে বিকট আওয়াজের শব্দ পেতাম। আমরা তখন ছোট ছিলাম। কেউ যেন খনির আশপাশে আসতে না পারে সেজন্য বিদেশিরা দারোয়ান পাহারায় রাখত। এলাকার কোনো লোককেই সেখানে ঢুকতে দেয়া হতো না। তারা কী তুলে নিয়ে যেত ,এটা কেউ যেন দেখতে না পারে সেজন্য সবকিছু তারা লুকিয়ে নিয়ে চলে যেত। তারপর হঠাৎ একদিন তারা সবকিছু রেখে চলে গেল।
খনি এলাকার বাসিন্দা আলী মোল্লা (১০৫) জানান, উল্লিখিত সময়ে খনিজের স্থানটি খননকার্য চলাকালে শতাধিক দেশি-বিদেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত ছিলেন। খনন কার্যক্রমের সময় নিচ থেকে কালো ধরনের দুর্গন্ধযুক্ত মাটির মতো এক ধরনের পদার্থ উঠে আসত। কর্মকর্তারা রাতের আঁধারে এসব পদার্থ ত্রিপল দিয়ে ঢেকে জীপগাড়িতে করে কোথায় যেন নিয়ে যেতেন। খননকৃত এলাকাটি কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা ছিল। এ কার্যক্রম চলাকালে তাদের নিজস্ব জেনারেটরের আলোয় পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোও আলোকিত হয়ে উঠেছিল। এছাড়া খনিকে কেন্দ্র করে আমবাটি মোড়ে একটি বাজারও গড়ে উঠেছিল, যা অদ্যাবধি চলমান আছে। এ জরিপ টিমটি প্রায় ১০ বছর এ কার্যক্রম চালায়। ১৯৬৮ সালের শেষের দিকে খননকারীরা কূপের স্থানটি বন্ধ করে দিয়ে চলে যায়। এরপর থেকেই পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে খনির স্থানটি।
স্থানীয়রা জানান, বর্তমান স্মৃতি পিলারগুলো আবাদি জমির মাঝখানে হওয়ায় চাষাবাদ ব্যাহত হয়। এ কারণে জমির মালিকরা কয়েকবার ভাঙার চেষ্টা করেন। তবে পিলারগুলো অনেক শক্ত হওযায় তারা ব্যর্থ হয়েছেন। তাদের আশংকা, এ স্মৃতিচিহ্নগুলো একদিন হারিয়ে যাবে।
এলাকার প্রবীণ শিক্ষাবিদ কাজী নজরুল ইসলাম (৮০) জানান, আমার বাড়ি ডাকবাংলোর পাশেই। খনির খননকাজ চলাকালে ডাকবাংলোতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা পরিবারসহ বসবাস করতেন। তাদের বেশিরভাগই ছিলেন বিদেশি।
তিনি আরো জানান, উল্লিখিত স্থানটিসহ একই ইউপির চকনিরখিন মোড় ও গাহন মৌজার ২টি স্থানেও একই সময় জরিপ ও খননকার্য চালানো হয়। তবে তার কোনো স্মৃতিচিহ্ন বর্তমানে খুঁজে পাওয়া যায় না। বরেন্দ্র এলাকার অজপাড়াগাঁয়ে এ খনিটির অবস্থান হওয়ায় প্রচারমাধ্যম ও ভূতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের নজরে এটি সেভাবে গুরুত্ব পায়নি বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তবে পত্নীতলার এই উৎকৃষ্ট মানের চীনামাটি উত্তোলন করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজে লাগানো যেতে পারে বলে তিনি মত দেন।
বাংলাদেশ ভূতত্ত্ব অধিদপ্তরের পরিচালক আলী আকবর বলেন, আমি উত্তরবঙ্গ নিয়ে অনেক কাজ করেছি। ওই এলাকায় শুধু ওই স্থানে নয়, অনেক স্থানেই খনিজসম্পদ রয়েছে। ওই স্থলে চীনামাটি আছে এটা নিশ্চিত। তবে শুধু চীনামাটিই নয়, সেখানে কয়লা, লোহাসহ আরো উন্নতমানের সম্পদ আমরা পেতে পারি।
কেন খনিজসম্পদ উত্তোলনে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না, এম প্রশ্নের জবাবে আলী আকবর বলেন, যেখানে সহজে সুবিধা ও লাভজনক আমরা হতে পারছি এমন জায়গাগুলোতে আমাদের উত্তোলন অব্যাহত আছে। যেমন আমরা এখন পার্বতীপুর থেকে উত্তোলন করছি।যখন অন্য জায়গাগুলোতে উত্তোলন শেষ হবে বা তা গভীরে চলে যাবে, অসুবিধা বা আশা অনুযায়ী লাভজনক হতে পারব না, তখন আমরা কাজ শুরু করব। এমন নয় যে অযত্ন-অববহেলা করা হচ্ছে। আমাদের নোটবুকে লিপিবদ্ধ আছে। ভবিষ্যতে সেখানে আবারো হস্তক্ষেপ হবে।
এমন খনিজসম্পদ এলাকা তৎকালীন বেড়া দিয়ে সংরক্ষণ করা হলেও বর্তমানে তা রয়েছে অসংরক্ষিত। এ প্রসঙ্গে পরিচালক বলেন, আমাদের চিহ্নিতকরণ ও পিলার বসানো আছে। এ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই।
এ ব্যাপারে পত্নীতলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. রাশেদুল ইসলাম বলেন, আমি এখানে নতুন যোগদান করেছি। এ ব্যাপারে আমার কিছু জানা নেই।
পত্নীতলা উপজেলা নির্বাহী অফিসার ছুটিতে থাকায় তার মোবাইলে যোগযোগ করার চেষ্টা করা হলেও রিসিভ না করায় কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এমএসএম / জামান