প্রচন্ড গরমে একটু শীতল পরশ
চন্দনাইশে শীতল পাটি বুনে অনেকে স্বাবলম্বী
চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলায় অন্যান্য হস্তশিল্পের পাশাপাশি শীতল পাটি শিল্পের যথেষ্ট কদর রয়েছে। আর এ পেশায় থেকে অনেকে স্বাবলম্বী হয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে সুখে-শান্তিতে দিন কাটাচ্ছে অনেক পরিবার। উপজেলার সাতবাড়িয়া, পৌরসভার হরিনাথপাড়া, হারলা গ্রামের মাস্টার পাড়ার প্রাথ শতাধিক পরিবার এ শিল্পের সাথে জড়িত রয়েছে। তাদের তৈরি এ শীতল পাটি পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রামসহ সারাদেশে বাজারজাত করা হচ্ছে।
পৌরসভার হরিনাথ পাড়ার মিলন নাথ বলেন, দুদিনে একটি পাটি বোনা যায়। কখনো আবার আরো বেশি সময় লাগে। সে পাটি বিক্রি করে তাদের সুন্দরভাবে সংসার চলে।
কুটিরশিল্প হিসেবে শীতল পাটি বুনন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে চন্দনাইশে। সংসারের নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজকর্ম সেরে মেয়েরা অবসর সময়ে শীতল পাটি বুনে অর্থ উপার্জন করছে। বিশেষ করে গৃহিণীরা রান্নাবান্নাসহ পরিবারের যাবতীয় কাজ শেষ করে মন দেন পাটি বুননে। তাদের সাথে যোগ দেয় পরিবারের পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও।
একটা সময় ছিল যখন গ্রামের বাড়ীতে অতিথি এলে বসতে দেয়া হতো পাটিতে। গৃহকর্তার বসার জন্য ছিল বিশেষ ধরনের পাটি। হিন্দু সম্প্রদায়ের বিয়ের অন্যতম অনুসঙ্গ শীতল পাটি। গরম কালে শীতল পাটির কদর একটু বেশি।
বৈশাখ-জৈষ্ঠের দুপুরে এ পাটি দেহ ও মনে শীতলতা আনে। রপ্তানী পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি না পেলেও শৌখিন ব্যবসায়ী বেড়াতে আসা অতিথিদের মাধ্যমে শীতল পাটি যাচ্ছে কলকাতা, মধ্যপ্রাচ্য, ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশে। অনেকে আবার নকশা করা শীতল পাটি দেয়ালে টাঙিয়ে রাখেন ঘরের শোভা বাড়াতে। কালের বিবর্তনে চন্দনাইশের এ পাটিশিল্প আজ হারিয়ে যাচ্ছে। সুখ নেই পাটি কারকদের মনে। রাত-দিন পরিশ্রম করেও দুই বেলা দু’মুটো আহার যোগাতে পারছে না তারা।
জানা যায়, উপজেলার এসব গ্রামে এখন বাণিজ্যিকভাবে শীতল পাটি বুনার কাজ চলছে। শীতল পাটি বুনে পুরুষের পাশাপাশি অনেক মহিলাও টাকা রোজগার করে সংসারের হাল ধরেছে।
পাটি বুননকারী বেশ কয়েকজন মহিলার সাথে আলাপকালে জানা যায়, তারা পরিবারের যাবতীয় কাজ শেষ করে দুপুরে যে অবসর পান তখনই পাটি বুনার কাজে মনযোগ দেন। এভাবে প্রতিদিন ৩/৪ ঘন্টা পাটি বুনার কাজে তারা সময় কাটান।বাণিজ্যিকভাবে পাটি বুননকারীরা ইচ্ছা করলেও দিনেও একটি পানি বুনতে পারেন।
নাথপাড়ার স্বপ্না নাথ বললেন, ঘরে তেমন কজের চাপ না থাকলে দুইদিনে একটি পাটি তৈরি করা যায়। পাটি বুননে পুরুষের চেয়ে বেশি আয় করা সম্ভব মেয়েদের।
রত্না নাথ বলেন, শীত মৌসুমে বেতন বাগান থেকে বয়স্ক বেতগুলো কেটে বাকল ছাড়ানো হয়। সে বাকল রোদে শুকানোর পর পানিতে ভিজিয়ে বাকল থেকে পাটির ঝং তোলা হয়। যা দিয়ে তৈরি হয় শীতল পাটি। উপরের ঝং দিয়ে শীতল পাটি,নিচের ঝং দিয়ে সাদা পাটি বা বুকর পাটি বুননো হয়। বাজারে এক মুটি পাটির বাকল ২শ থেকে আড়াইশ টাকা। এক মুটি বেত দিয়ে ১টি শীতল পাটি ও ২টি সাদা পাটি বানানো যায়।
পাটি ব্যবসায়ী বাবুল নাথ জানান, বর্তমানে বেত, রঙের দাম বেশি হওয়ায় তারা এ ব্যবসায় খুব একটা লাভবান হতে পারছেন না। পাশাপাশি পাটি তৈরিতে যে সময় অতিবাহিত হয়, সে হিসেবে লাভটা কম। তাছাড়া পাটির জন্য যে বেত প্রয়োজন, তা এলাকায় পাওয়া যায় না। পার্শ্ববর্তী উপজেলার পটিয়ার গৈড়লা, সাতকানিয়া, বাঁশখালী, আনোয়ারা থেকে বেশি দামে এ বেত সংগ্রহ করতে হয়।
চন্দনাইশের পাটি শিল্প দক্ষিণ চট্টগ্রামের একটি ঐতিহ্যবাহী শিল্প হিসেবে পরিচিত। এ শিল্পে জড়িতদের মতে শত বছর আগে থেকে তাদের পূর্ব পুরুষেরা এ পেশার সাথে জড়িত হয়ে পড়ে। পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য তারা এ পেশায় রয়েছে। তাদের মতে শীতল পাটি, সাদা পাটি, বুকের পাটিসহ বিভিন্ন রং-বেরং এর পাটি তৈরি করে থাকে। যা দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং বেতের উপর নির্ভর করে ১ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয় বলে জানালেন তারা। ক্ষেত্রবিশেষে ২ থেকে ৩শ টাকায়ও পাটি বিক্রি হয়। তবে পাটির সাইজ অনুযায়ী এ দর নির্ধারণ করা হয়। শুকনো মৌসুমে তথা গ্রীষ্মকালে পাটি ব্যবসা খুব ভালো হয়। তারা এ চাহিদা মিটানোর জন্য অনেক সময় ব্যবসায় সঠিকভাবে অর্থ যোগান দিতে পারে না। সরকারিভাবে তেমন সাহায্য সহযোগিতা পায়না বলে তারা জানান। বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে তারা খুব কষ্টে এ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানান।
পাটি ব্যবসায়ী সুজন নাথ বলেন, বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে এ ব্যবসা ভালো জমে। বিশেষ করে লালদীঘির বলীখেলা, গরুর লড়াই সহ বিভিন্ন বাজারে এ পাটির কদর ও চাহিদা প্রচুর। সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এদের তৈরি পাটি বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব হবে বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞ মহল। এ শিল্প বিকাশের জন্য তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন বলে মনে করেছেন তারা।
এমএসএম / জামান