ঢাকা মঙ্গলবার, ১ জুলাই, ২০২৫

রোমাঞ্চকর মারায়ন তং পাহাড়ের চূড়ায় : রিপন দাশ


ডেস্ক রিপোর্ট  photo ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশিত: ১৪-৯-২০২২ দুপুর ১১:৫৭

ভ্রমণ করা আমার শখ। একটু সময় পেলেই ঘুরতে চলে যাই কোন এক অজানাতে। আমার শখপূরনের অংশিদার করতে মাঝে-মধ্যে সাথে করে নিয়ে যাই অফিস কলিগদের। বিগত দুইবছর অতিমারীর কারনে আমরা কোথ্ওা যেতে পারিনি। তাই অফিস কলিগ মেহেদী ভাই বলার সাথে সাথে শুরু করলাম ভ্রমণ পরিকল্পনা। সিদ্ধান্ত হল ১৮ ও ১৯ আগস্ট ছুটির দিনে সবাই মিলে যাব মারায়ন তং পাহাড়ে। শুরু হয়ে গেল আমাদের দিন গোনা। যতই দিন যাচ্ছে আমরা সবাই মানসিক ভাবে উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছিলাম। এক ধরনের রোমাঞ্চ কাজ করছিল সবার শরীরে। অবশেষে এসে গেল সেই মহেন্দ্রক্ষণ।

আগের দিন রাতে গুছিয়ে রাখা ব্যাগ নিয়ে রওনা হলাম শাহ আমানত ব্রীজ বাস স্ট্যান্ডে। সেখানে গিয়ে দেখি একে একে টিমের সবাই আসা শুরু করল। জনপ্রতি ২৬০টাকা করে টিকেট কেটে বাসে উঠে দেখলাম, আমাদের রাজীব ভাই এখনো এসে পৌঁছায়নি। উনাকে ফোন করে জানলাম উনি হোটেল চৌঁরাঙ্গীতে সকালের নাস্তা করছে। অবশ্য উনি চৌঁরাঙ্গীতে ছিল নাকি বাসায় ছিল সে সত্য উদঘাটনের জন্য ইন্টারপোলকে দ্বায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

অবশেষে হন্ত-দন্ত হয়ে এলেন আমাদের রাজীব ভাই। তারপর  সকাল ৮টায় শুরু হল আমাদের চকরিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা। যাত্রা পথে গাড়ীতেই সেরে নিলাম আমাদের সকালের নাস্তা। অবশেষে দুপুর বেলা ১১টায় এসে পৌঁছালাম চকরিয়া বাস স্ট্যান্ডে। ইতিমধ্যে ২ বার কল করে ফেলল আমাদের গাইড উক্যাসিং মারমা। 
চকরিয়ায় বাস থেকে নেমে আমরা চলে গেলাম “ধান সিঁড়ি রেস্টুরেন্টে”। সেখান থেকে হালকা নাস্তা সেরে আমরা চলে গেলাম চকরিয়া পৌর বাস স্ট্যান্ডে। সেখান থেকে ১,৫৫০টাকা দিয়ে একটি চাঁন্দের গাড়ী (জীপ গাড়ী) ভাড়া করে আমরা রওনা দিলাম আলীকদম আবাসিক (শীলবুনিয়া পাড়া)। আলিকদমের চড়াই-উৎরাই পথ। এই উপরে উঠছে, পরক্ষণে রোলার কোস্টারের মতো নিচে। আমাদের জীপ চলছে সাপের মতো শরীর-মাথা এঁকে-বেঁকে। এর মধ্যে র্সূযমামা আমদের সাথে শুরু করে দিল তার লুকোচুরি খেলা।  একটু করে দেখা দিয়ে আবার কোথায় মুখ লুকিয়ে ফেলে। একবার ডানে হারায় তো একবার বামে। এরইমধ্যে হঠাৎ যাত্রাবিরতি। জাতীয় পরিচয়পত্রসহ নামতে হলো ইয়াংছা চেকপোস্টে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয় ‘সওয়াল-জবাব’ শেষে দুপাশে পাহাড়ের কোলঘেঁষে পেজা তুলোর মতো মেঘের ওড়াউড়ি দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছে গেলাম শীলবুনিয়া পাড়ায়। সেখানে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন মং মারমা। 

গাড়ী থেকে সবাই নেমে ঢুকে পরলাম “একটু জিরোয় রেষ্টুরেন্টে”। সুন্দর পরিবেশ, অনেক সাজানো গোছানো। ইচ্ছে করছিল এখানেই ক্যাম্পিং করি। যে যার মত ফ্রেশ হতে লাগল। ইতিমধ্যে মং মারমা দাদার হুকুম, খাবার রেডি সবাই খেতে বসেন। দুপুরের খাবারটা খেয়েই আমরা মারায়ন তং যাত্রা শুরু করব, ঠিক তখনি বাধ সাধলেন সূর্যমামা। উপরে তাকিয়ে দেখি, প্রচন্ড রেগে আছেন উনি। একেবারে মধ্যগগন থেকে চোখ রাঙিয়ে আছে আমাদের দিকে। কড়া রোদের শাসানি উপেক্ষা করেই আমাদের পৌঁছাতে হবে চূড়ায়। কেউ সাহস করল না, অগত্যা অপেক্ষা মামার রাগ কমার জন্য। ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেল আমাদের ফটো সেশন। মাইকেল, বাপ্পি, তারিক, আকবর, হিমুরা মাচাং ঘরে, মোবারক ভাই টাট্টু ঘোড়ায় আর আমি, অভিজিত, মুজিব ভাইয়ের ফটোসেশন চলছে হোমমেইড হ্যামকে। 
হঠাৎ মং মারমা দাদার আগমন। জিজ্ঞেস করলেন- রাতে কি কি খাব? উনাকে খাবার মেন্যু বলে হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিলাম। উনি টাকাটা নিয়ে চলে গেলেন বাজারে।

উপরে তাকিয়ে দেখি সূর্যমামার রাগ কিছুটা কমেছে। আমাদের রাজিব রাহুলের সাথে সূর্যমামার ভাল সর্ম্পক তাইতো তার কানে কানে ফিসফিস করে বলল-“এবার তোরা পাহাড়ে উঠে যারে পাগলা”।পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে আটকে থাকা প্রকৃতির নৈসর্গিক রূপ দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছেতে থাকলাম মারায়ন তং জাদির চূড়ায়। মারায়ন তং জাদিতে দাঁড়িয়ে এমন সুখ পাওয়া কেবলই রোমাঞ্চকর নয়; বরং সেখানে চ্যালেঞ্জটাই মুখ্য। এই পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে আমাদের হাঁটতে হয়েছিল প্রায় চার থেকে পাঁচ কিলোমিটার পাহাড়ি রাস্তা। গুনতে হয়েছে সর্বমোট ৫টি ট্রেইল, যার মধ্যে সবচেয়ে খাড়া ট্রেইলটা ৭২ ডিগ্রি কোণে ভূমি থেকে চূড়ার দিকে চলে গিয়েছে। যেখানে কোথাও এক ফুটের জন্য রাস্তা নিচের দিকে নামেনি! ট্রেইলের শুরু থেকে একদম চূড়া পর্যন্তপুরোটাই খাড়া ইটের রাস্তা।
এখান থেকে যত দূর দৃষ্টি যায় শুধু পাহাড় আর পাহাড়। সেসব পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দেয় বাঁশের তৈরী জুমঘর। মারায়ন তং জাদির ঠিক নিচেই মারমাদের বসবাস। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে আটকে থাকা মুরংদের ঘরগুলো দেখতে অসাধারন। মাটি থেকে সামান্য ওপরে এদের মাচাং ঘর। এসব ঘরের নিচে থাকে গরু, ছাগল, শূকর ও মুরগি। কখনো গবাদি পশুর পাশাপাশি প্রয়োজনীয় জ্বালানি কাঠও দেখলাম রাখা আছে স্তুপ করে।

খাড়া পথ বেয়ে একটি পাহাড় দেখলাম উপরের অংশ সমতল এবং এটাই আমাদের ক্যাম্পিং সাইট। মারায়ন তংয়ের চূড়া ছুঁতে প্রায় বিকেল। চূড়ায় উঠেই প্রথমেই চোখে পড়ে বিশাল একটি জাদি আর বটবৃক্ষ। চূড়ার মুখোমুখি চিম্বুক রেঞ্জের পাহাড়েরা। চিম্বুক আর মিরিঞ্জার বুকের উপর দিয়ে বয়ে গেছে মাতামুহুরি। চারদিকের পাহাড়ের সৌর্ন্দয উপভোগ করতে করতে মনে পড়ে গেল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই কবিতা “অনেকদিন থেকেই আমার একটা পাহাড় কেনার শখ। 
কিন্তু পাহাড় কে বিক্রি করে তা আমি জানি না।
যদি তার দেখা পেতাম, দামের জন্য আটকাতো না।
 আমার নিজস্ব একটা নদী আছে, সেটা দিয়ে দিতাম পাহাড়টার বদলে”।

আজ বুজতে পারলাম কেন কবি একটা পাহাড়ের মালিক হবার জন্য এত তীব্র ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। ইতিমধ্যে রাশেদ তার ব্যাগ থেকে ড্রোন বের করে ভিডিও করা শুরু করল। আমরাও যে যার যার মত করে ছবি তোলা নিয়ে ব্যস্তহয়ে পরলাম। এসব করতে করতেই  দিগন্তজুড়ে নীল-কমলার আভা ছড়িয়ে আমাদের বিদায় বলে হল সূর্যমামার প্রস্থান। 

পাহাড়ের বুকে নেমে এল অন্ধকার। বিন্দুমাত্র আলোর নাম-নিশানা নেই। আকাশের দিকে তাকিয়েই অবাক হয়ে গেলাম! চোখে ধরা দিচ্ছে সুবিন্যস্ত ছায়াপথ। আর তারাগুলোর দিকে তাকালেই মনে হচ্ছে আমরা যেন মহাশূন্যে আছি! সেই লাখো তারার নিচে আমরা আমাদের সাথে নিয়ে যাওয়া তাঁবু গুলো সেট করলাম। 
এর মধ্যে চলে এলেন মং মারমা দাদা। উনার হাতে দুইটা বড় পাহাড়ী মোরগ আর বারবিকিউ করার জন্য মেরিনেট করা বয়লার মুরগীর মাংস। 

রাত ১টার দিকে খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমরা চলে আসলাম ঘুমাতে। বাপ্পি, হিমু, তারিক ও আকবর চলে গেল এ তাঁবুতে। আমি ও মেহেদী ভাই ঘুমালোম আরেক তাবুঁতে। অন্যদিকে আলাদা মজা নেওয়ার জন্য অভিজিত, রাশেদ ও মাইকেল ঘুমাতে চলে গেল ঝুমের মাচাং ঘরে। সারাদিনের ট্রেকিং ক্লান্তি, সেইসঙ্গে রাতভর আড্ডা-গল্পের পর তাঁবুর ভেতর শরীর পড়তেই ঘুম।

ঘুম ভাংঙ্গতেই দেখি নানা রঙের মেঘ আকাশের কোলে বসে আমাদের ভেংচি কাটছে। ভিডিওতে দেখি পাজি মেঘ মাতামুহুরির উপর দিয়ে গাভীর মতো চরে বেড়ায়। কিন্তু আজ সে আমাদের সাথে প্রতারনা করল। প্রকৃতির পরিহাস বোঝা বড়ই মুশকিল। মেঘ ছুঁতে না পারার বেদনা সবার মধ্যেই কম-বেশি ছড়ালো। তবুও চললো তুমুল ছবি তোলাতুলি। ফিরে গিয়েই ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম রঙিন হয়ে উঠবে সবার।

হঠাৎ কেন যেন ভাগ্যদেবী আমাদের উপর সুপ্রসন্ন হল। তিনি বৃষ্টি হয়ে নেমে আসলেন মারায়ন তংয়ের চূড়ায়। আমরা সবাই দৌঁড়ে নিচে নেমে তাঁবুতে আশ্রয় নিলাম। বাইরে তুমুল বৃষ্টি। কিছুক্ষন পর বৃষ্টি চলে গিয়ে আর চারপাশে শুধুই মেঘ। আগে সব সময় ভিজেছি ঘামে, নইলে বৃষ্টিতে। কিন্তু মেঘের মধ্যে দিয়ে ভিজতে ভিজতে পেলাম স্বর্গিয় অনুভতি।

এক ফাঁকে মুজিব ভাই জানাল একটু পর নামতে হবে। নিচে গিয়ে খাবার শেষ করে বের হতে হবে আলীর গুহা অভিযানে। তাঁবু গুটিয়ে, ব্যাগ কাঁধে নিয়ে হুল্লোড় করে নেমে আসলাম নিচে “একটু জিরোয় রেস্টুরেন্টে”। সবাই গোসল সেরে ফ্রেস হয়ে খিচুড়ি ও ডিম খেয়ে রওনা দিলাম আলীর গুহা অভিযানে। আর সাথে নিয়ে গেলাম মারায়ন তং পাহাড় চূড়ায় রোমাঞ্চকর এক রাতের অভিজ্ঞতা।

যাওয়া: বাসে ঢাকা বা চট্টগ্রাম থেকে আপনাকে নামতে হবে চকরিয়া । চকরিয়া থেকে জীপে আলীকদমের আবাসিক রাস্তার মাথায়। সেখান থেকে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই মারায়ন তং যাবার রাস্তা দেখিয়ে দিবে। সেখান থেকে হেঁটে মারায়ন তং পাহাড় চূড়ায় পৌঁছতে ২ ঘণ্টার মতো সময় লাগবে।

 

এমএসএম / এমএসএম