ম্যানেজে চলে বাল্কহেড!

*অবৈধ নৌযান অন্তত ৭০ হাজার
*দেড় বছরে দুর্ঘটনার শিকার ২৪৬টি
*নিহত ৩৭৭ জন, নিখোঁজ ১০৪ জন
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ও নৌ-পরিবহন অধিদপ্তর নামক দুটি সংস্থা ছাড়াও নৌ-পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করেই প্রভাবশালীদের সিন্ডিকেটে চলছে বাল্কহেড। বিপদজনক এই বাল্কহেডকে নিয়ন্ত্রনে নানান মহল থেকে চাপ আসলে রাতে বাল্কহেড না চালানোর নির্দেশ দেয় সংশ্লিষ্ট বিভাগ। এতেও বন্ধ নেই দুর্ঘটনা। নৌ খাতের মালিক ও শ্রমিক নেতারা বাল্কহেডের বেপরোয়া গতিসহ অদক্ষ চালক দিয়ে বাল্কহেড পরিচালনার নানান অভিযোগ করলেও বিআইডব্লিউটিএর সংশ্লিষ্ট বিভাগ এবিষয়টি একেবারেই আমলে নিচ্ছে না বলে জানান তারা।
লঞ্চ মালিক শ্রমিকদের অভিযোগ, নদীপথে চলাচল করা অবৈধ নৌযানগুলো দুর্ঘটনায় পড়লে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দায় এড়িয়ে যান অনুমোদনহীন আখ্যা দিয়ে। এসব দুর্ঘটনায় স্বজনদের আহাজারি থামাতে দুয়েকটি তদন্ত কমিটি হলেও কোনোটির বিচার হয়েছে এমন নজির খুব কম দেখেছে মানুষ। অভিযোগ করে তারা বলেন, এসব অবৈধ মালিকরা আইনের মধ্যে থেকেই আইনের একটি বড় সুবিধা নিয়ে থাকেন সংশ্লিষ্ট কর্তা ব্যক্তিদের যোগসাজস্যে। তাহলো যখনেই এসব অবৈধ নৌযান দুর্ঘটনা ঘটায় তখন মেরিন কোর্টে একটি মামলা করে নৌ-নিট্রা কর্তৃপক্ষ। অপরদিকে দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের উস্কানি দিয়ে মালিকপক্ষই আরেকটি মামলা করান ফৌজদারি কোর্টে। একই সাথে দুই আদালতে মামলা চলমান থাকায় মামলার রায় প্রকাশে বিলম্ব হয় আদালতের। এদিকে লম্বা সময় চলে যাওয়ায় একসময় বাদী পক্ষ ক্লান্ত হয়ে আর খবর নেননা এসব মামলার।
সবশেষ শনিবার সন্ধ্যায় মুন্সিগঞ্জের পদ্মা শাখা নদীতে বালুবাহী বাল্কহেডের ধাক্কায় অন্তত ৪০ যাত্রী নিয়ে ট্রলার ডুবে যায়। এ ঘটনায় দুজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। বাল্কহেডটি আটক করে এলাকাবাসী। এ ঘটনার পর (বুধবার) রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত নৌনিট্রা বিভাগ জানায় এবিষয়ে একটি তদন্ত কমিটির প্রস্তাবনা উঠেছে।
এর আগে চলতি মাসের ৩ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের রক্তি নদীতে বাল্কহেডের ধাক্কায় নৌকা ডুবে নিখোঁজ দুই শ্রমিকের মরদেহ উদ্ধার করে স্থনীয়রা। উপজেলার আনোয়ারপুর এলাকার নদী থেকে মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় কি ব্যবস্থা নিয়েছে কর্তৃপক্ষ তারও কোনো দৃশ্যমান ফল দেখেনি এলাকাবাসি।
নদী সংশ্লিষ্টরা জানায়, বালুবাহী নৌযানের পর্যাপ্ত নিরাপত্তাবাতি থাকে না। বালু পরিপূর্ণ অবস্থায় এসব নৌযানের শুধু সামনের কিছু অংশ ও পেছনের অংশ পানির ওপরে থাকে। তাই বাল্কহেডের সঙ্গে যাত্রীবাহী নৌযানের ধাক্কা লাগার ঘটনা ঘটে প্রায়ই।লঞ্চমালিক সমিতির মহাসচিব বলেন, ‘সর্ষের মধ্যেই ভূত আছে। বাল্কহেড চলাচল মনিটর করার দায়িত্ব যাদের, তাদের ম্যানেজ করেই রাতে অবৈধভাবে চলছে বাল্কহেড। রাতে যাত্রীবাহী নৌযান আমরা খুব কষ্টে চালাই। কারণ নদীতে বাল্কহেড এক ভয়ঙ্কর যন্ত্রের নাম। তিনি অভিযোগ করে বলেন, যাত্রীবাহী নৌযানে দুর্ঘটনা ঘটেছে শুধু বাল্কহেডের কারণে।
অপরদিকে নৌ দুর্ঘটনা এড়াতে বালুবাহী নৌযান (বাল্কহেড) চলাচল নিয়ন্ত্রণসহ সব ধরনের অবৈধ নৌযানের বিরুদ্ধে অভিযান শুরুর দাবি জানিয়েছে নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি। এজন্য সারা দেশে অবিলম্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।
চলতি বছরের ৭ আগস্ট সংবাদ মাধ্যমে সংগঠনের সভাপতি হাজি মোহাম্মদ শহীদ মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে’র পাঠানো এক বিবৃতিতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়সহ নৌপরিবহন অধিদপ্তর, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), নৌপুলিশ ও কোস্টগার্ডের প্রতি এ দাবি জানানো হয়।বিবৃতিতে বলা হয়, বাল্কহেডের কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়মিত নৌ দুর্ঘটনা ও যাত্রীবাহী নৌযান ডুবে প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত বাল্কহেড চলাচল নিষিদ্ধ হলেও প্রশাসনের নাকের ডগায় রাতে শত শত বাল্কহেড চলাচল করছে।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বরাত দিয়ে নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতারা বলেন, নিবন্ধিত নৌযানের সংখ্যা ১৫ হাজার হলেও সারা দেশে বিভিন্ন ধরনের অন্তত ৮৫ হাজার নৌযান রয়েছে। অবৈধ নৌযানের মধ্যে অন্তত ছয় হাজার রয়েছে বাল্কহেড।নিবন্ধিত ১৫ হাজার নৌযানের মধ্যে নিয়মিত বার্ষিক সার্ভে (ফিটনেস পরীক্ষা) করা হয় মাত্র আট হাজারের। নিয়ন্ত্রক সংস্থা নৌপরিবহন অধিদপ্তর ও বিআইডব্লিউটিএর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জ্ঞাতসারে অবশিষ্ট সাত হাজার ত্রুটিপূর্ণ নৌযান অবাধে চলাচল করছে। কর্তৃপক্ষ সেগুলোর বিরুদ্ধে অদৃশ্য কারণে ব্যবস্থা না নেওয়ায় অহরহ দুর্ঘটনা ঘটছে।
অবৈধ ও আইন অমান্যকারী নৌযান চলাচলের সুযোগ দেওয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও নৌযান মালিককেও উপযুক্ত শাস্তি প্রদানের দাবি জানিয়েছে জাতীয় কমিটি। মুন্সীগঞ্জে পদ্মা নদীতে বাল্কহেডের ধাক্কায় যাত্রীবাহী ট্রলার ডুবে আটজন এবং ১৭ জুলাই রাতে ঢাকার কেরাণীগঞ্জে তৈলপট্টিঘাটে বুড়িগঙ্গা নদীতে বাল্কহেডের ধাক্কায় ওয়াটার বাস ডুবে তিন যাত্রী নিহত হয়।
বিবৃতিতে সনদবিহীন চালককে (মাস্টার ও ড্রাইভার) শাস্তি প্রদানের পাশাপাশি অবৈধ চালক নিয়োগ দেওয়ায় নৌযান মালিককেও আইনের আওতায় আনার দাবি জানানো হয়। একইসঙ্গে জনস্বার্থে জেলা প্রশাসন ও জেলা পুলিশকেও এ কাজে সম্পৃক্ত করার আহ্বান জানানো হয়।
বিগত কয়েক বছরের নৌ-দুর্ঘটনার কেসস্টাডিতে দেখা গেছে সারা দেশের নদীপথে আতঙ্কের নাম বালুবোঝাই নৌযান- বাল্কহেড। পদ্মা, মেঘনা, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যাসহ দেশের বিভিন্ন নদীতে বেপরোয়া চলা বাল্কহেডের ধাক্কায় প্রতিনিয়তই ডুবছে যাত্রীবাহী নৌযান। নদীতেই প্রাণ যাচ্ছে মানুষের। অবৈধ বাল্কহেডের থাকে না ফিটনেস, চলে অদক্ষ চালকের হাতে। এসব দেখার কেউ নেই। শুধু দুর্ঘটনা ঘটলেই নড়েচড়ে বসে নৌ-কর্তৃপক্ষ।
নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় সূর্যাস্তের পর থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত সারা দেশে নৌপথে বাল্কহেড (বালুবাহী নৌযান) চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। ফলে সন্ধ্যা রাতে নৌপথে বাল্কহেড চলাচল বন্ধ থাকার কথা। কিন্তু ১৭ জুলাই রাত ৮টার দিকে রাজধানী ঢাকার সদরঘাটের ওপারে কেরানীগঞ্জে তৈলঘাটের কাছে বুড়িগঙ্গা নদীতে একটি বাল্কহেডের ধাক্কায় যাত্রীবোঝাই একটি ওয়াটার বাস ডুবে যায়। এতে তিনজন নিহত এবং অনেকে আহত হন। এ ঘটনায় বাল্কহেডের মাস্টারসহ ছয়জনকে আটক করেছে নৌ-পুলিশ। তবে প্রশ্ন হলো, রাতে বাল্কহেড চলছিল কীভাবে? তাও খোদ ঢাকা নদীবন্দর এলাকায়?
এ বিষয়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর আরিফ আহমেদ মোস্তফা বলেন, ‘রাতে বালুবাহী নৌযান চলাচল না করার নির্দেশনা এখনো বলবৎ আছে। আমাদের মোবাইল কোর্টও সব সময় পরিচালিত হচ্ছে। নৌপথে নিরাপত্তার জন্য নৌ-পুলিশ এবং কোস্টগার্ড কাজ করে। সন্ধ্যার পরে যেন বাল্কহেড চলাচল না করে সে জন্য ঈদের আগেই আমরা নৌ-পুলিশকে চিঠিও দিয়েছিলাম। নৌ-পুলিশ যদি বিভিন্ন পয়েন্টে আরেকটু খেয়াল রাখে, তা হলে হয়তো একটু থামানো যাবে এসব নৌযান চলাচল। তবে আমরা সবাই কাজ করছি।’
নৌ-পরিবহন অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ২০২২ সালে ৩৬টি নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে আছে যাত্রীবাহী নৌযান ১০টি, মালবাহী নৌযান ১৭টি এবং অন্যান্য নৌযান ছিল ৯টি। তবে দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, ২০২২ সালে সারা দেশে ছোট-বড় নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৯৭টি। এতে নিহত হয়েছেন ৩১৯ জন, আহত হয়েছেন ৭৩ জন এবং নিখোঁজ রয়েছেন ৯২ জন। এ ছাড়া ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ১৬ জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪৯টি। এতে নিহত হয়েছেন ৫৮ জন, আহত হয়েছেন ৭ জন এবং এখনো নিখোঁজ আছেন ১২ জন।
সে হিসাবে বিগত দেড় বছরে ২৪৬টি নৌ-দুর্ঘটনায় ৩৭৭ জন নিহত হয়েছেন। এতে ৮০ জন আহত এবং ১০৪ জন নিখোঁজ রয়েছেন।এ বিষয়ে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মো. সাইদুর রহমান বলেন, ‘নৌ দুর্ঘটনায় জড়িতদের আজ পর্যন্ত কোনো শাস্তি দেয়া হয়নি। নৌপথ নিরাপদ করার সঙ্গে জড়িত বিআইডব্লিউটিএ, নৌ-পরিবহন অধিদপ্তর, নৌ-পুলিশ এবং নৌযান মালিকদের অবহেলার কারণে নৌপথ নিরাপদ হয়নি। এর জন্য সংশ্লিষ্ট সবাই দায়ী।’
নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, অভ্যন্তরীণ নৌপথে চলাচলের জন্য ১৫ ধরনের নৌযানের অনুমতি আছে। অভ্যন্তরীণ রুটে সারা দেশের সব মিলে প্রায় ১৬ হাজার ৯৮০টি অনুমোদিত নৌযান চলাচল করে। এর মধ্যে অনুমোদিত বালুবাহী নৌযান (বাল্কহেড) আছে ৬৩৭৯টি।তবে দেশে কতসংখ্যক অবৈধ নৌযান চলাচল করছে, সে হিসাব নেই নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের কাছে। তবে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানিয়েছেন, সারা দেশে লক্ষাধিক অবৈধ নৌযান আছে।
বাল্কহেডের কড়াল থাবা থেকে রক্ষা পায়নি নদীতে থাকা সেতুও :
বাল্কহেডের ধাক্কায় ১৫ বছরের পুরনো সেতু ভেঙে পড়েছে কুমিল্লায়। চলতি বছরের ২ অক্টোবর রাত ২টার পর জেলার দাউদকান্দি উপজেলার কালাডুমুর নদে এ দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার পর বাল্কহেডের চালক ও তার সহকারীরা সাঁতরে তীরে উঠে যায়।
এমএসএম / এমএসএম

গণপূর্তের ইএম কারখানা বিভাগে নির্বাহী প্রকৌশলী মো: ইউসুফের দুর্নীতির রাজত্ব

দুর্নীতিতে পিছিয়ে নেই এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলীগন

‘এনবিআর’এ স্বৈরাচার সরকারের পালিয়ে থাকা চক্রের চক্রান্ত

প্রাণ ধ্বংসকারী কোম্পানি প্রাণ

বিসিএসআইআরের ৬ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনায় ভাগ বাটোয়ারা

কোতোয়ালীতে অপহৃত ব্যবসায়ীর লাশ উদ্ধার

রেজিস্ট্রি অফিসের প্রভাবশালী নকলনবিশের কাণ্ডঃ মন্ত্রীদের প্রভাবে চাঁদাবাজি ও নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ

বিসিক এর নীরিক্ষা কর্মকর্তা সাবধান আলী হতে সাবধান!

কেরানীগঞ্জ উপজেলার রাজাবাড়ী রোডে অবৈধ এলপিজি বটলিং প্লান্ট এর সন্ধান

গডফাদার মুরাদ জং-এর বোন পরিচয়ে দলিল দাতা-গ্রহীতাদের জিম্মি করার অভিযোগ

গাজীপুরের কাশিমপুরে সরকারি খাস জমি ভূমিদস্যুদের দখলে

বগুড়ায় সাবেক অফিস সহকারীর বিরুদ্ধে 'ফ্যাসিস্ট সিন্ডিকেটের' মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ
