ফারজানা বাতেন
ভর্তার স্বাদ ও সাতকাহন
আধুনিক বাংলায় ভর্তা শব্দটি শুধুমাত্র খাবার বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। সংস্কৃত 'ভৰ্ত্তা' থেকে আগত ভর্তা শব্দের অর্থ স্বামী। ভর্তা শব্দটি খুব একটা ব্যবহৃত না হলেও এর অপভ্রংশ রূপ 'ভাতার' লোকজ বাংলায় বহুল ব্যবহৃত হয়। বাংলায় কোনো কিছু পিষে ফেলাকে ভর্তা বলা হয়।
সকল প্রকার ‘বাঙালি ভর্তা' হাতে কিংবা বিভিন্ন উপায়ে পিষে তৈরি করা হয়ে থাকে। ভর্তা মানে দলাই- মলাই। চিপে চিড়েচ্যাপ্টা করে ফেলা। ভর্তার সঙ্গে বাঙালি জাতির সুদূর ঐতিহ্যগত সম্পর্ক। ঠিক কবে থেকে বাঙালি জাতি ভর্তা খেতে শুরু করেছে তার কোনো নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস রচিত হয়নি। ধারণা করা যায়, হাজার বছর ধরেই বাঙালি ভর্তা খেয়ে আসছে। বিশেষ করে, শুঁটকি ভর্তা।
আগে মাছে-ভাতে বাঙালির শুঁটকির ভর্তা খাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। কারণ- মাছ শুকিয়ে শুঁটকি করা ছাড়া মৎস সংরক্ষণের অন্য কোনো উপায় ছিলো না। তার সঙ্গে কৃষিভিত্তিক সমাজে স্বাভাবিকভাবেই যুক্ত হয়েছিল আলু ভর্তা, বেগুন ভর্তা ইত্যাদি সব্জিভিত্তিক ভর্তা। শুনলে আশ্চর্য হবেন, এখন মাংস ভর্তাও খাওয়া হয়।
ভর্তার নানারকম আধুনিক সংস্করণও হয়েছে। এমন কিছু নেই যা ভর্তা হয় না। যেমন মিষ্টি কুমড়ার ছিলকা, পটলের ছিলকা এমনকি লাউয়ের পাতা, বিচি এসবের ভর্তা। মাছের ভর্তা, শুঁটকির ভর্তা তো বিখ্যাতই। তবে সবজি, পাতা-লতা, ফলমূলের ভর্তা—পটল, বেগুন, ঢেঁড়স, বরবটি, শিম, কপি, কচু এখন
তরকারির চেয়ে ভর্তা করে খেতেই পছন্দ করে অনেক মানুষ। ভর্তার সুবিধা হচ্ছে তাতে সময় কম লাগে। সেদ্ধ করে নিয়ে কাঁচামরিচ, শুকনোমরিচ, পেঁয়াজ আর একটু সরিষার তেল মেখে নিলেই হয়। স্বল্প সময়ে স্বল্প ব্যয়ে সুস্বাদু খাবার।
একসময় ভর্তা ছিল একটু নিম্ন আয়ের লোকজনেরই খাবার। বাংলাদেশের গরিব জনপদে ভর্তা ছিল ঠেকে কাজ চালানো। ঘরে কিছু না থাকলে যা কিছু আছে তা ডলে একটু ভর্তা বানিয়ে নেয়া হতো। এখন ভর্তা পাচ্ছে ঐতিহ্যের মর্যাদা। দেশের নামিদামি রেস্টুরেন্টেও এখন বহুপদের ভর্তা রাখা হয়।
হুমায়ূন আহমেদ ভর্তা সম্পর্কে লিখেছেন, “বেশিরভাগ ছোট মাছের জন্মই হয়েছে ভর্তা হবার জন্য। এতদিন শুনে এসেছি ভাতে-মাছে বাঙালি, এখন থেকে ভর্তা-ভাতে বাঙালি।”
ভর্তা শুধু যে ভাতের সঙ্গে খাওয়া হয় এমন নয়। বাংলাদেশে শীত মৌসুমে পিঠার দোকানগুলিতে বিশেষ করে চিতই পিঠার দোকানে বাহারি পদের ভর্তার সমাহার লক্ষ্য করা যায়।
Sunny / Sunny