পুলিশের ‘ডোপ টেস্ট’ ক্যাডার-নন ক্যাডারে দ্বৈত নিয়মের অভিযোগ
বাংলাদেশ পুলিশের কনস্টেবল থেকে মহা-পুলিশ পরিদর্শক (আইজিপি) পর্যন্ত মাদকাসক্ত সনাক্ত করনের কথা বলা হলেও এখনো কোন ক্যাডার সার্ভিসের (বিসিএস) সদস্যের ডোপ টেস্টের তথ্য পাওয়া যায়নি। ফলে পুলিশে ‘ডোপ টেস্ট’ নিয়ে নন-ক্যাডার অফিসার ও সদস্যদের মাঝে অসন্তোষ বিরাজ করছে। তারা বলছেন, পুলিশের কনস্টেবল, এএসআই, এসআই ও ইন্সপেক্টরদের তালিকা তৈরী করে ডোপ টেস্ট করা হয়েছে। কিন্তু রহস্যজনকভাবে বিসিএস বা ক্যাডার সার্ভিসের পুলিশ সদস্যদের নাম মাদকাসক্তের তালিকায় আসছে না। ফলে তারা ডোপ টেস্টে এর মত পরিস্থিতির মুখোমুখি করা হচ্ছে না। এজন্য একই বাহিনীতে ‘দ্বৈত নিয়ম’ চালানো হচ্ছে বলে নন-ক্যাডার পুলিশ সদস্যরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
তবে পুলিশ সদরদপ্তর সূত্র জানায়, পুলিশে মাদকাসক্ত সনাক্ত করণের বিষয়টি চলমান রয়েছে। ক্যাডার হউক আর নন-ক্যাডার হউক না কেন, যদি সঠিক তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে তারা মাদকাসক্তের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবেন। এরপর তাদেরকে ‘ডোপ টেস্ট’ করাতে হবে। যদি তার বিরুদ্ধে পজেটিভ রিপোর্ট পাওয়া যায়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কাউকে তালিক্ত ভুক্ত করা ও ‘ডোপ টেস্ট’ করানো হয়েছে বা কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে কিনা, সে তথ্য জানাতে পারেনি সংশ্লিষ্ট সূত্রটি।
ডিএমপির সূত্র জানায়, ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সদস্যদের মাদকমুক্ত রাখতে গত ২০২০ সালে শুরু হয় ‘ডোপ টেস্ট’ বা মাদক শনাক্তকরণ কার্যক্রম। এতে প্রথম বছরেই ১২০ জন পুলিশ সদস্যের শরীরে মাদকের উপস্থিতি পাওয়া যায়। অবশ্য পরের তিন বছরে মাদক গ্রহণ করেন এমন পুলিশ সদস্য শনাক্ত হন মাত্র ১৪ জন। আর ডোপ টেস্ট শুরুর পর গত চার বছরে ১৩৪ জন শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে। আর এই ডোপ টেস্টে শনাক্তের পর শাস্তির মুখোমুখিও হতে হয় সেই পুলিশ সদস্যদের। তবে শনাক্ত কিংবা শাস্তি পাওয়াদের মধ্যে অধিকাংশই কনস্টেবল থেকে পরিদর্শক পদমর্যাদার।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন পুলিশ কনস্টেবল জানান, বাংলাদেশ পুলিশে মাদকসক্ত সনাক্ত করণে ইন্সপেক্টরের উপরের পদের অথাৎ ক্যাডার সার্ভিসের কাউকে ‘ডোপ টেস্টে’র পরীক্ষার আওতায় এখনো আনা হয়নি। এজন্য পুলিশ বাহিনীর কনস্টেবল থেকে ইন্সপেক্টদের মাঝে দাবি ওঠেছে ‘সবার জন্য সমান নিয়ম করতে হবে। আর এই দাবির জন্যই মাদকসক্ত সনাক্ত করণে ‘ডোপ টেস্ট’ পুলিশের ভালো উদ্যোগটি বাঁধা গ্রস্থ করার চেস্টা করা হচ্ছে।
জানা গেছে, পুলিশের কনস্টেবল থেকে পরিদর্শক পর্যন্ত নন-ক্যাডার হলেও এএসপি থেকে তার উপরের কর্মকর্তারা বিসিএস ক্যাডারের কর্মকর্তা। আবার নন-ক্যাডার থেকে পদোন্নতি পেয়েও কেউ কেউ এএসপি বা এডিশনাল এসপি পর্যন্ত হন। কিন্তু রহস্যজনকভাবে ক্যাডার সদস্যদের নাম আসছে না ‘ডোপ টেস্ট’ করণের তালিকায়। ফলে নন ক্যাডারদের দাবি সব পুলিশ বাহিনীতে ‘দ্বৈত নিয়ম’ যেন না হয়। আবার নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে এএসপি থেকে তার উপরের কর্মকর্তাদের ‘ডোপ টেস্ট’ না হওয়া নিচের পদের সদস্যদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। এ নিয়ে বাহিনীর নীতিনির্ধারক পর্যায়ে বার বার আলোচনাও হয়েছে।এরপর থেকেই ‘ডোপ টেস্টে’র সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে।
ডিএমপির নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা জানান, পুলিশের ‘ডোপ টেস্ট’ এখনো বন্ধ হয়নি। আর ‘ডোপ টেস্টে’ পজেটিভ হওয়ায় ১২৪ জন পুলিশ সদস্য বরখাস্ত হয়েছেন। আর এই বিষয়টি সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার কারণে এবং চাকরি হারানোর ভয়ে ডিএমপির সদস্যদের মাদক গ্রহণের হার অনেকটা হ্রাস পেয়েছে। ফলে সন্দেহভাজন মাদকাসক্ত পাওয়া যাচ্ছে কম, শনাক্তও হচ্ছে কম। তবে ‘ডোপ টেস্ট’ সব পর্যায়ে না হওয়ায় নন ক্যাডারদের মাঝে অসন্তোষ হতেই পারে। এজন্য ডোপ টেস্টে কার্যক্রম অনেকটা ধীরগতিতে চলছে। অপরদিকে পুলিশ সদর দপ্তরের এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, গত ২০২০ সালের মার্চে ডিএমপিতে প্রথম ‘ডোপ টেস্ট’ শুরুর ঘোষণা করা হয়। আর ঘোষনার পর তা দ্রুতগতি কার্যক্রম চালানো হয়। গত ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত মাদকাসক্ত পুলিশ সদস্য শনাক্ত হন ১২০ জন। ২০২৩ সালে সে সংখ্যা দাঁড়ায় ১২৬ জন। এই ১২৬ জনের মধ্যে ৯৮ জনই পুলিশ কনস্টেবল, ৮ জন পুলিশের নায়েক, ৭ জন পুলিশের এএসআই, ১১ জন সহকারি পরিদর্শক (এসআই) ১ জন ট্রাফিক সার্জেন্ট ও ১ জন পরিদর্শক ছিলেন। কিন্তু পরবর্তী ১৪ মাসে শনাক্ত হন মাত্র ৮ জন।
অপরদিকে ডিএমপি সূত্র জানায়, গত ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্ত মোট ১৩৪ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে বরখাস্ত হয়েছেন ১২৪ জন। আর একজন মারা গেছেন এবং ১ জন অবসর প্রস্তুতিকালীন ছুটিতে যান। তাছাড়া, দুই জনের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। অন্য ৬ জনের বিরুদ্ধেও পদাবনতিসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, গত ২০১৯ সালের মে-জুন মাসের রাজারবাগ ব্যারাকে কয়েকজন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মাদক সেবন ও ব্যবসায় জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া যায়। ফলে সংশ্লিষ্ট দপ্তর ডিএমপি সদর দপ্তরের গোপন প্রতিবেদন পাঠানো হয়। আর স্ইে তথ্যের ভিত্তিতে তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া পুলিশে মাদক নির্মূলে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু তিনি পরের বছর অবসরে চলে যান। এরপর দায়িত্ব পান মোহা. শফিকুল ইসলাম। তিনি ঘোষণা দিয়ে ডিএমপি সদস্যদের মধ্যে মাদক সেবনের বিষয়ে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেন। সেই ঘোষণাটি ২০২০ সালের ১০ মার্চ দেওয়া হয়েছিল। এরপর থেকেই সন্দেহভাজন মাদকাসক্ত পুলিশ সদস্যদের চিহ্নিত করে রাজারবাগে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে পরীক্ষা করার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, তৎকালীন কমিশনারের নির্দেশের প্রতিটি বিভাগে চিঠি দিয়ে সন্দেহভাজন মাদকাসক্ত পুলিশ সদস্যের তালিকা চাওয়া হয়েছিল। আর সে তালিকা তৎকালীন ডিএমপি কমিশনারের নিজস্ব গোয়েন্দা বিভাগ যাচাই-বাছাই করে সন্দেহভাজনদের তালিকা করে ‘ডোপ টেস্ট’ করানো হয়েছিল। এখনো পুলিশের কেউ যদি মাদকাসক্ত বা শৃঙ্খলাবিরোধী ন্যূনতম অপরাধ করে, তাহলে যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করা হয়। এখানে কোনো র্যাংঙ্ক বা কে কর্মকর্তা, তা দেখা হয় না। মাদকাসক্ত শতভাগ নিশ্চিত হওয়ার পরই তাদের ‘ডোপ টেস্ট’ করানো হচ্ছে।
বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বাংলাদেশ পুলিশকে মাদকমুক্ত রাখতে ‘ডোপ টেস্টে’র উদ্যোগ অনন্য উল্লেখ করে জানিয়েছেন, আমরাও চাই পুলিশ সদস্যরা মাদকমুক্ত থাকুক। কিন্তু বাহিনীতে তা সবার জন্য সমান হতে হবে। শুধু কনস্টেবল, এএসআই, এসআই, ইন্সপেক্টরদের টেস্ট হবে, এটা কোনো নিয়ম হতে পারে না। এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণও করেছেন তিনি। কেননা, ঊর্ধ্বতন কারও ‘ডোপ টেস্ট’ হয়েছে এমন কোনো তথ্য এখনো নেই। উল্লেখিত সংগঠনটি কনস্টেবল থেকে পরিদর্শক পর্যন্ত সদস্যদের প্রতিনিধিত্ব করে।
আর এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ও ডিএমপির গুলশান থানার ভারপাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজহারুল ইসলাম সকালের সময়কে বলেন, ডোপ টেস্টের বিরোধিতা করার মতো বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে কেউ নেই। আর কেউ এর বিরোধীতা করছে না। কনস্টেবল থেকে আইজিপি মহোদয় পর্যন্ত প্রত্যেকেরই সন্দেহ হলে ‘ডোপ টেস্ট’ করার নির্দেশনা এখনো বলবত রয়েছে। আর নির্দেশনা আছে পুলিশের যাকে সন্দেহজনক মনে করা হবে, তার ডোপ টেস্ট করতে হবে। টেস্ট করে যার পজিটিভ আসবে, সে পুলিশে চাকরির যোগ্যতা হারাবে। পুলিশে মাদকাসক্তের কোনো স্থান নেই বলে জানিয়েছেন তিনি।
এ বিষয়ে সকালের সময় এর পক্ষ থেকে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমানের সেল ফোনে কল করা হলেও তিনি তার ফোনটি রিসিভ করেননি। তবে তিনি গণমাধ্যমে সম্প্রতি বলেছেন, ‘পুলিশের ‘ডোপ টেস্ট’ বন্ধ হয়নি বরং নতুন বছর থেকে আরও জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আগে এসআই ও কনস্টেবল পর্যায়ের সদস্যদের ডোপ টেস্ট করানো হলেও এখন পুলিশের ঊর্ধ্বতন সব কর্মকর্তাদের এই পরীক্ষা করা হবে। আমারও করানো হবে। এই ডোপ টেস্ট অব্যাহত থাকবে।’
তিনি বলেন, ‘কোনো পুলিশ সদস্যের ‘ডোপ টেস্টে’র ফল পজিটিভ হলে তাকে চাকরিচ্যুত করা হবে। এ ছাড়া চাকরিতে প্রবেশের আগেও ডোপ টেস্ট করা হবে। এ বিষয়ে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’ ডোপ টেস্টের ফল পজিটিভ হওয়ায় চাকরি হারিয়েছেন অনেক পুলিশ। কিছু পুলিশ সদস্য এখন নিরাময়কেন্দ্রে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছেন। তারা এখন চাকরিতে ফিরতে চান। কিন্তু চাকরিতে তাদের ফেরার কোনো সুযোগ নেই’।
উল্লেখ্য, গত ২০২০ সালের ৯ নভেম্বর সোমবার আদাবরের বাইতুল আমান হাউজিং সোসাইটিতে ‘মানসিক রোগ নিরাময়’ কেন্দ্রে চিকিৎসা করাতে গেলে হাসপাতালের কর্মচারীদের নির্মম নির্যাতনে পুলিশের মেধাবী এএসপি আনিসুল করিম নিহত হন। তিনি ৩১তম বিসিএস পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। নিহত পুলিশ কর্তকর্তা মাদকাসক্ত ছিলেন। তার পরিবারই ওই নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করতে নিয়ে গিয়েছিলেন। এঘটনায় আদাবর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। পরে পুলিশ জড়িত দশজনকে গ্রেফতার করে।
এমএসএম / এমএসএম