আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ কি হতে যাচ্ছে?

১৯৭৯-১৯৮৯ পর্যন্ত সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধেও পর ক্ষমতায় ছিল আফগান তালেবানের পরিচালিত 'ওংষধসরপ ঊসরৎধঃবং ঙভ অভমযধহরংঃধহ' সরকার। হাজারো ঘটনার জন্ম দেয় তালেবান পরিচালিত সেই সরকার কাঠামো। ১৯৯৬-২০০১ পর্যন্ত তালেবানের সেই শাসন জারি ছিল। কিন্তু ২০২১ সালে এসে মার্কিনিদের সৈন্য প্রত্যাহার পরবর্তী সময়ে আবারো আফগানিস্তান দখল করে নেই তালেবান। (১) আফগান তালেবানের সরকার গঠন যখন চলমান তখন পশ্চিমা রাষ্ট্্র তালেবানের স্বীকৃতির ব্যাপারে বলছে, এখনই তারা তালেবানকে স্বীকৃতি দিতে আগ্রহী নয়। এমন পরিস্থিতিতে আফগানিস্তানের সামনের ঘটনাপ্রবাহ কি হতে পারে? ১৯৯৬ সময়কার পরিস্থিতি কি ছিল? বর্তমানে আবার সেই সময়ের পুনরাবৃত্তি হলে কি হবে?
আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে যারা নিয়মিত খবর রাখেন তাদের নিকট এটি অজানা নয় যে, 'আফগানিস্তানের সরকার কাঠামো এখন তালেবানের নেতৃত্বে চলছে। দীর্ঘ ২০ বছর ধরে মার্কিনিদের আফগান অভিযান শেষ হয় সর্বশেষ সেনা প্রত্যাহারের মাধ্যমে। সত্যি বলতে সুযোগসন্ধানী মার্কিনিরা 'আখের গুছিয়ে' আফগানিস্তানে আর থাকতে আগ্রহী নয়। আফগান তালেবান ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আসার পূর্বে হোয়াইট হাউজে আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানিকে জো বাইডেন বলেন, 'আফগানিস্তানকেই এখন নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে হবে। (২) মার্কিনিদের এই ধরণের জবাবে তখন থেকেই স্পষ্ট ছিল যে আফগানিস্তান নিয়ে মার্কিনিরা আগের মত ততটা আগ্রহী নয়। এখন রাশিয়া, চীন, তাইওয়ান সহ অন্যান্য বৈশ্বিক ইস্যু নিয়ে পূর্ন মনোযোগ দেয়ার সময় এসেছে মার্কিনিদের! আফগানিস্তানের সংকট টি আজ হঠাৎ করেই তৈরী হয়নি।
আফগানিস্তানের আজকের যে সংকট সেটি সম্পর্কে জানতে চাইলে ১৯৭৯-১৯৮৯ সময়কার সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধ সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা থাকা দরকার। ১৯৭৯ সালের ২৪ ডিসেম্বও থেকে ১৯৮৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত চলমান সেই যুদ্ধে প্রায় ২০ লক্ষ সাধারণ আফগান প্রাণ হারান যা। (৩) এই যুদ্ধে আফগান সাধারণ জনগণের প্রতিপক্ষ ছিল সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়া। আর এই যুদ্ধের সময় আফগানিস্তানের জনগণ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সাহায্য পেয়ে থাকে আমেরিকা থেকে! আমেরিকা থেকে আফগান জনগণ সাহায্য পেয়েছে এটা বর্তমান সময়ে এসে বললে 'বন্ধ্যা নারীর অন্ধ পুত্র চাঁদ দেখতে যাচ্ছে' বলাটা যেমন অসম্ভব মনে হয় ঠিক তেমনি এই ঘটনা টি ও অসম্ভব বলে মনে হবে। তবে এই যুদ্ধে মার্কিনিদের সম্পৃক্ততার একটাই স্বার্থ ছিল আর তা হল,' চির বৈরী সোভিয়েত ইউনিয়ন কে ফাঁদে ফেলানো!' ১৯৭৯ সালের মার্চে সিআইএ কর্তৃক আফগানিস্তানে গুপ্ত অভিযান পরিচালনার বিষয়ে মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি ওয়াল্টার স্নোকোম্বে বলেন, 'যদি সোভিয়েতরা আফগানিস্তান আক্রমণ করে, তাহলে তারা যেন সেখানে আটকা পড়ে যায় এটা নিশ্চিত করার মধ্যেই আমাদের স্বার্থ নিহিত আছে!'(৪) তাইতো আমেরিকা ইচ্ছে করেই এই যুদ্ধে জড়িয়ে গিয়েছিল। আফগান যুদ্ধের সময় যে আল কায়েদাকে আমেরিকা অস্ত্র দিয়েছিল আজ আমেরিকা সেই আল কায়েদা কে দমন করতে নেমেছে!
আফগান যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সৃষ্ট হয় আফগান গৃহযুদ্ধ যা ১৯৯২-১৯৯৬ পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এরপর মোল্লা মুহাম্মদ উমার এর নেতৃত্বে শুরু হয় আফগান তালেবানের শাসন। আফগান তালেবান শাসনের প্রথম ১ সপ্তাহ কাবুল শেয়ার বাজার ইতিবাচক ছিল। কিন্তু এরপরই খুব শীগ্রই অর্থনৈতিক ধ্বস শুরু হয়। (৫) আফগানে পরিচালিত যেকোন কোম্পানির উপর আরোপ করা হয় উচ্চমাত্রার কর! যেসব কোম্পানি ভ্যাট প্রদান করতে ব্যর্থ হয় তাদের উপর করা হত আক্রমণ! (৬) বিদেশ থেকে যেকোন কিছু আমদানির উপর ছিল ৬% কর। আফগান তালেবানের আয়ের অন্যতম বড় একটি উৎস ছিল আফিম! আফগান শাসনামলে প্রায় ৯৬% পপি চাষ দখলে ছিল তালেবানের। শুধু তাই নয় আফিম ও অন্যায় মাদক সংশ্লিষ্ট পণ্যের উপর আরোপিত হয় ১০% কর। ২০০০ সালে বিশ্বের ৭৬% আফিম সরবরাহ করত আফগান তালেবানরা! শুধু তাই নয় একই বছর ৮২১৭১ হেক্টর পপি চাষ থেকে প্রায় ৩২৭৬ টন আফিম উৎপাদন করে তালেবান। (৭) যে তালেবান ইসলামি খেলাফত এর দোহাই দিয়ে দেশ শাসন করছিল সে তালেবানের অন্যতম আয়ের উৎস ছিল আফিম! আফগান তালেবানের আয়ের আরেকটি বড় উৎস ছিল খনিজ মিনারেল এবং মূল্যবান পাথর। আফগানিস্তান খনিজ মিনারেল এবং মূল্যবান পাথরের প্রাচুর্যপূর্ণ একটি দেশ। খনিজ এই সম্পদ গুলো ছিল আফগান তালেবানের অন্যতম আয়। যার পরিমাণ ছিল প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। তবে এরপরও আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দিন দিন নাজুক হতে থাকে।
এ-তো গেল আফগান তালেবান পরিচালিত 'ওংষধসরপ ঊসরৎধঃবং ঙভ অভমযধহরংঃধহ' এর অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কথা। এবার দেখা যাক মানবিক ও অন্যান্য সার্বিক পরিবেশ কেমন ছিল। ১৯৯৬-২০০১ আফগানিস্তানের মানবাধিকার পরিস্থিতি ছিল খুবই নাজুক। নারীদের জন্য বের হওয়ার সুযোগ ছিল খুবই সীমিত। তালেবান শাসনামলে মাত্র ৫ হাজারের মত নারী স্কুলে যেতে পেরেছিল! যদিও সেই সংখ্যা এখন প্রায় ২৭ লাখের উপর। তালেবান শাসনামলে স্কুলে যাওয়াটা যেখানে কষ্টকর ছিল, তালেবান শাসন পরবর্তী সময়ে নারীরা সংসদ নির্বাচনে পর্যন্ত প্রার্থী হল! তালেবান শাসনামলে বিদেশি দাতব্য এনজিও গুলোর কাজ করার সুযোগও ছিল খুবই নগন্য। বিনোদন এর ক্ষেত্র গুলোও সংকুচিত হয়ে আসতে শুরু করে। গান এবং টেলিভিশন এর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। যেসকল পুরুষ রা দাঁড়ি রাখত না তাদের কে হাজতবাস ও করতে হতো! (৮)
২০০৯ সালে আমেরিকা ভিত্তিক অলাভজনক সংঘটন 'এশিয়া ফাউন্ডেশন' এর একটি জরিপে উঠে আসে যে’ 'আফগানিস্তানের প্রায় অর্ধেক জনগণের ই তালেবান এর মত সশস্ত্র সংঘটনের প্রতি ইতিবাচক অনূভুতি কাজ করে! মূলত অধিকাংশ পশতু এবং গ্রাম্য এলাকায় বসবাসকারী জনগণের তালেবান এর প্রতি ভালোবাসা কাজ করে! তবে ঠিক ঐ সংঘটন কর্তৃক পরিচালিত ২০১৯ সালের জরিপে উঠে আসে, 'মাত্র ১৩.৪ % জনগণ তালেবানের কার্যকলাপ কে ইতিবাচক বা ভাল মনে করে। (৯)তালেবান কে আফগানিস্তানের কিছু জনসাধারণ ইতিবাচক হিসেবে নেয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ আছে।
* প্রথমত দূর্নীতি তে আচ্ছন্ন দেশটির সরকারি প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রতি বিন্দু মাত্র ভরসা নেই দেশটির অধিকাংশ জনগণের।
* দ্বিতীয়ত তালেবান তাদের শাসন কে 'ইসলামি খেলাফত' বলেই চালিয়ে দিচ্ছে, যা দেশটির সাধারণ জনগণের মনে একটি ধর্মীয় অনূভুতি তৈরী করেছে।
* তৃতীয়ত আফগান জনগণ কখনো চাইনা দেশটিতে মার্কিনিদের সৈন্য- সামন্ত থাকুক,কেননা ইতিপূর্বে সোভিয়েত শাসনের তিক্ততা দেশটির জনগণ এখনো ভুলেনি। আর সেই সৈন্য-সামন্ত দের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরী করছে সশস্ত্র এই গোষ্ঠীটি।
বর্তমানের তালেবান স্ট্রাটেজি এবং ১৯৯৬-২০০১ সালের তালেবান স্ট্রাটেজির মধ্যে অনেক ফারাক থাকলে ও তালেবান সরকার কাঠামোকে অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে যেতে হবে তা নিশ্চিত। এখন দেখে নেয়া যাক আফগান তালেবান বর্তমানে আবারো ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দুতে থাকা অবস্থায় ভবিষ্যতে সম্ভাব্য কি কি ঘটনা হতে পারে। আফগান তালেবান প্রথমত আমেরিকার অর্থনৈতিক অবরোধের (ঝধহপঃরড়হ) স্বীকার হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। কেননা আফগানিস্তানে সেনা প্রত্যাহার পরবর্তী সময়ে আমেরিকার স্পষ্ট ঘোষণা এখন থেকে তালেবানকে সামরিকভাবে নয় বরং কূটনীতিক ভাবে মোকাবিলা করবে। তালেবান সরকার কে অবরোধ প্রয়োগের কথাটি বলার কারণ মার্কিনিরা ইরান, উত্তর কোরিয়া সহ একাধিক বৈরী যেসব দেশকে কূটনীতিক ভাবে মোকাবিলা করে তাদের উপর মার্কিনিদের প্রথম ও প্রধান অস্ত্র অবরোধ! উল্লেখ্য, ১৯৮৮ সালে কেনিয়া ও তানজানিয়ায় আমেরিকান দূতাবাসে হামলা চালায় আফগান তালেবান সমর্থিত আল কায়েদা গোষ্ঠী। সেই হামলার জেরে আফগানিস্তানের উপর দেয়া হয় 'নির্দিষ্ট ব্যক্তি বর্গের ভ্রমণের উপর অবরোধ,অস্ত্র ও সেই সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতির উপর অবরোধ, সামরিক ও অর্থনৈতিক অবরোধ'। এই অবরোধের ফলে আফগান জনগনকে এখনো ভুগতে হচ্ছে। ১৯৯৯ সালের নভেম্বর মাসে এই অবরোধের প্রতিবাদে আফগানিস্তানের সাধারণ জনগণ মাঠে নেমে আসে এবং হামলা চালায় জাতিসংঘের অফিস ও যানবাহনের উপর। (১০) আফগান জাতীয় বিমানসংস্থা 'এরিয়ানা' যেটি খাবার, ঔষধ এবং চিকিৎসা সেবা যোগান দিত সেটি প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়ে।
১৯৯৬ সালে আন্তর্জাতিক আর্থিক সহায়তা বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং নিরাপত্তার ঝুঁকি সহ আরো কিছু কারণে অধিকাংশ এনজিএ সংস্থা তাদের কার্যকলাপ বন্ধ করে দিয়েছিল। (১১) বর্তমানে তালেবানের হাতে দেশ যাওয়ার পর শুধু অন্যান্য দেশের ব্যক্তিবর্গ নয় বরং স্বদেশ ছেড়ে আফগানদের দেশত্যাগ ছিল চোখে পড়ার মত।
১৯৯৬ সালে আফগানিস্তানের স্বাস্থ্যসেবার ৭০% কাজ করতো বিভিন্ন এনজিও। কিন্তু মার্কিনিদের অবরোধের কারণে আফগান জনগণকে প্রায় ২০ বছর দূর্বিষহ জীবনযাপন করতে হয়। ২০০০ সালের আগষ্ট মাসে (ঃযব টঘ ঙভভরপব ভড়ৎ ঃযব ঈড়ড়ৎফরহধঃরড়হ ড়ভ ঐঁসধহরঃধৎরধহ অভভধরৎং ঙঈঐঅ) একটি রিপোর্টে প্রকাশ করে যে জাতিসংঘের আরোপিত অবরোধের কারণে আফগানিস্তানের মানবিক পরিস্থিতি খুবই নাজুক। এছাড়াও 'হিউমন রাইটস ওয়াচ, দাতব্য সংস্থা এম.এস.এফ এবং জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান আফগানিস্তানের উপর জাতিসংঘের আরোপিত অবরোধের সমালোচনা করেন। আন্তর্জাতিক মেডিকেল জার্নাল 'দি লেনসেট' এর ২০০১ সালের একটি একটি প্রতিবেদনে উঠে আসে যে, জাতিসংঘের আরোপিত অবরোধের কারণে আফগানিস্তানে খরা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আফগানিস্তানের অনেক জনগণ জীবন বাঁচাতে গাছের শিকড় পর্যন্ত খাচ্ছে! (১২)
পরিশেষে বলা যায় যে, আফগানিস্তানে ১৯৯৬-২০০১ পরিস্থিতির একই পুনরাবৃত্তি সাধারণ আফগান রা কখনো চাইবে না। আফগান সাধারণ জনগণ যুদ্ধ বিগ্রহ দেখতে দেখতে ক্লান্ত। এখন তারা মুক্তির আশায় 'তীর্থের কাকের' মত চেয়ে আছে। তবে কি অপেক্ষা করছে সাধারণ আফগানদের ভাগ্যে সেটা নিশ্চিত ভাবে বলা খুবই কঠিন। কিন্তু এটি নিশ্চিত যে, আলেকজান্ডার, চেঙ্গিস খান, বাবর, মাহমুদ গজনী ও সোভিয়েত ইউনিয়ন এর বিরুদ্ধে যেভাবে সংগ্রাম করে ঠিকেছিল এই জাতি সেই জাতি ঠিক একইভাবেই ঠিকে থাকবে!
মোরশেদ-রিদয় প্রাবন্ধিক ও তরুণ সংবাদকর্মী
এমএসএম / এমএসএম

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার গণতন্ত্রের জন্য চ্যালেঞ্জ

কোচিং-এর গোলকধাঁধায়, শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে গুরুত্ব নেই

সাংবাদিকের দল সমর্থন গণতন্ত্রের জন্য হুমকি

ইঁদুরের কৃতজ্ঞতা

নাগরিক সেবা ও প্রত্যাশার সংকট: রাষ্ট্রীয় কর্মচারী কোথায়?

টেকসই সমাজ গঠনে সাম্য একটি অপরিহার্য ভিত্তি

শুভ জন্মাষ্টমী : সত্য, সুন্দর ও সাম্য প্রতিষ্ঠায় শান্তির বার্তা

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অপরিহার্য

জনগণের অংশগ্রহণে নির্বাচিতরাই কাশ্মীরের শাসক

স্বৈরশাসকের বিদায়, বিদ্রোহ ও পলায়ন

জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় তারেক রহমান

এপিআই ও এক্সিপিয়েন্ট উৎপাদনে বাংলাদেশের আত্মনির্ভরশীলতা: স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির নবদিগন্ত উন্মোচন
