ঢাকা রবিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

এক চোখে বিশ্বাস আর অন্য চোখে অবিশ্বাস


এসএম পিন্টু photo এসএম পিন্টু
প্রকাশিত: ১-৯-২০২৫ দুপুর ১:৫৫

মানুষ সামাজিক প্রাণী। আমরা একা বাঁচতে পারি না, আমাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন পরিবার, বন্ধু, প্রতিবেশী, সহকর্মী, এমনকি অচেনা মানুষেরও সহযোগিতা। আর এই সম্পর্কগুলো টিকে থাকে মূলত বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আজকের সমাজে নিখুঁত বিশ্বাসযোগ্য মানুষ খুঁজে পাওয়া ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে। পরিপূর্ণ বিশ্বাস করার মতো মানুষ এই সমাজে বিরল। ফলে যাকে পরিপূর্ণ বিশ্বাস করবেন সে যদি সেই মর্যাদা রাখতে না পারে তাহলে আপনি যে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সেটা বলার জন্য দার্শনিক হওয়ার প্রয়োজন হবে না। আবার মানুষ মানুষকে বিশ্বাস না করেও চলতে পারবেনা। কাউকে না কাউকে বিশ্বাস করতে হবে, এটাই স্বাভাবিক। আর নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে অনাকাঙ্খিত বিপদ বা ক্ষতি এড়াতে বিশ্বাসের সাথে অবিশ্বাসকেও ধারণ করতে হবে। মানুষকে বাধ্য হয়ে একচোখে বিশ্বাস আর অন্য চোখে অবিশ্বাস নিয়ে চলতে হয়। আমি বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই এটি উপলদ্ধি¦ করেছি। নিচে আমি বিশ্বাস অবিশ্বাস সম্পর্কিত কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করব।

এই নিবন্ধে আলোচনা করব, বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের দর্শন, কেন মানুষ পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য নয়, মনস্তত্ত্ব ও বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা, ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান থেকে উদাহরণ, আধুনিক জীবনে এই দ্বৈত মানসিকতার প্রয়োজনীয়তা এবং শেষপর্যন্ত, কিভাবে সুষম দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমরা টিকে থাকতে পারি।

১. বিশ্বাসের দর্শন:
বিশ্বাস মানে হলো এমন এক অনুভূতি যেখানে আমরা অন্যের কথায়, কাজে বা প্রতিশ্রুতিতে ভরসা রাখি। মানুষকে বিশ্বাস না করলে সম্পর্ক গড়ে তোলা অসম্ভব। একজন সন্তানের চোখে বাবা-মা পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়; আবার এক বন্ধু তার গোপন কথাগুলো আরেক বন্ধুর কাছে বলে দেয় কারণ সে বিশ্বাস করে সেগুলো ফাঁস হবে না।
দর্শনের ভাষায়, বিশ্বাস হলো আত্মসমর্পণ, অন্যের প্রতি এক ধরনের আস্থা রাখা, যেখানে নিজের নিয়ন্ত্রণকে আংশিকভাবে অন্যের হাতে তুলে দেওয়া হয়।

২. অবিশ্বাসের বাস্তবতা:
তবে বাস্তব জগৎ নিখুঁত নয়। আমরা যতবারই কাউকে পুরোপুরি বিশ্বাস করেছি, ততবারই কেউ না কেউ সেই বিশ্বাস ভেঙেছে। তাই অভিজ্ঞতা আমাদের শিখিয়েছে, কাউকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করা বিপদজনক হতে পারে। অবিশ্বাস কোনো নেতিবাচক বিষয় নয় বরং এটি এক ধরনের আত্মরক্ষার কৌশল। যেমন, ব্যবসায়িক চুক্তিতে আমরা কাগজে সই করি, শুধু বিশ্বাসের উপর ভরসা করি না। রাজনীতিবিদদের আমরা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারি না, কারণ ইতিহাসে অসংখ্যবার তারা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছেন। এমনকি পরিবারের ভেতরেও সম্পদের ভাগাভাগি নিয়ে অবিশ্বাস জন্ম নেয়।

৩. কেন নিখুঁত বিশ্বাসযোগ্য মানুষ বিরল?

ক) স্বার্থপরতা:
মানুষ প্রকৃতিগতভাবে স্বার্থপর। নিজের প্রয়োজন বা স্বার্থ রক্ষায় অনেক সময় সে অন্যের ক্ষতিও করে।
খ) প্রলোভন:
অর্থ, ক্ষমতা, খ্যাতি, সম্পর্ক, এসবের লোভে মানুষ সহজেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে।

গ) দুর্বলতা:
অনেক সময় মানুষ ইচ্ছা করেও প্রতিশ্রুতি রাখতে পারে না। এটা চরিত্রহীনতার চেয়ে দুর্বলতার কারণে ঘটে।

ঘ) সমাজব্যবস্থা:
আমাদের সামাজিক কাঠামোতেই আছে প্রতিযোগিতা, টিকে থাকার সংগ্রাম। ফলে মানুষ অনেক সময় সত্য লুকিয়ে বা প্রতারণা করে এগিয়ে যায়।

৪. মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি:
মনোবিজ্ঞানের মতে, অতিরিক্ত বিশ্বাস মানুষকে দুর্বল করে তোলে। অপরদিকে অতিরিক্ত অবিশ্বাস মানুষকে একা করে দেয়। তাই একটি ভারসাম্য দরকার। যা হলো “একচোখে বিশ্বাস, একচোখে অবিশ্বাস”।
শিশুরা স্বভাবতই বিশ্বাসপ্রবণ। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে তারা অভিজ্ঞতা থেকে অবিশ্বাস শিখে।

কর্মজীবনে যদি আমরা সবাইকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করি, তাহলে সহজেই প্রতারিত হবো। আবার সবাইকে অবিশ্বাস করলে দলগত কাজ সম্ভব নয়। সম্পর্কের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম। আংশিক বিশ্বাস ও আংশিক সতর্কতা সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখে।

৫. ইতিহাস ও সমাজ থেকে শিক্ষা:

ক) রাজনৈতিক ইতিহাস:
বিশ্ব ইতিহাসে দেখা যায়, বিশ্বাসঘাতকতা প্রায় প্রতিটি যুগে ঘটেছে। যেমন, জুলিয়াস সিজারের হত্যায় তার ঘনিষ্ঠ ব্রুটাসও জড়িত ছিল। এখানেই প্রমাণ হয়, সবচেয়ে প্রিয় মানুষও কখনো বিশ্বাস ভাঙতে পারে।

ব্রুটাস:
প্রাচীন রোমের স্বৈরশাসক জুলিয়াস সিজারকে হত্যা করেছিল তারই ঘনিষ্ট বন্ধু ব্রুটাস। সিজার আর ব্রুটাসের সম্পর্কে বন্ধুর মত ছিলো, এমনকি ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার পরিকল্পনায় ব্রুটাস সিজারকে সমর্থনও দিয়েছিলো। শেষ পর্যন্ত সেই ব্রুটাসের নেতৃত্বে অন্যান্য সিনেটরেরা, রাজদরবারে সিজারকে একের পর এক ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে । 

এফিয়েলটস:
খৃস্টপূর্ব ৪৮০ সালে পার্সীয়ান রাজা জেরেক্সের সাথে হাত মিলিয়ে তাদের স্পার্টান যোদ্ধাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন এফিয়েলটস। তার সেই বেঈমানীর ফলে স্পার্টান রাজা লিওনাইডাস সহ অন্যান্য যোদ্ধারাও মৃত্যুর মুখে পতিত হন। 
জুডাস: 
খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের কাছে ঘৃণিত নাম জুডাস। তাদের মতে, পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য বিশ্বাসঘাতক হলো এই জুডাস্। যীশুর সহচর ছিল সে। মাত্র ৩০ রৌপ্য মুদ্রার বিনিময়ে জুডাস যীশুকে রোমান সৈন্যদের হাতে ধরিয়ে দিতে সহায়তা করে। 
মীর জাফর: 
মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য তার নামটি বিশ্বাসঘাতকের প্রতিশব্দ হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আছে। সে ছিল নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্রধান সেনাপতি। এই ব্যাক্তির জন্য বরন করতে হয়েছিলো ২০০ বছরের পরাধীনতা। বিশ্বাসঘাতকতা করে সে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রবার্ট ক্লাইভ এর সাথে ষড়যন্ত্রের ফলে  পলাশীর যুদ্ধে ব্রিটিশদের হাতে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় ঘটে। 

আলফ্রেড রেড: 
অস্ট্রিয়ার কাউন্টার ইন্টিলেজেন্সীর প্রধান আলফ্রেড রেড এর বিশ্বাসঘাতকতার মূল্য দিতে হয়েছিলো অস্ট্রিয়ার ৫ লক্ষ্য মানুষের জীবন দিয়ে। কর্মক্ষেত্রে তার অনেক সুনাম ছিল তবে কেউ জানতোনা সে গোপনে রাশিয়ার হয়েও কাজ করছিলো। সে ১৯০৩ থেকে ১৯১৩ পর্যন্ত সে একজন ডবল এজেন্টের কাজ করেছিলো। 
ভিডকুন কুইসলিং: 
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক খলনায়ক ভিডকুন কুইসলিং। তিনি একজন নরোয়েজিয়ান আর্মী অফিসার এবং রাজনীতিবিদ । জার্মানদের নরওয়ে দখলের জন্য যাবতীয় সামরিক তথ্য হিটলারের কাছে পাচার করেন পুরস্কার হিসেবে হিটলার তাকে দখলকৃত নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন। ১৯৪৫ সালে জার্মানদের আত্মসমর্পণের পরে নরওয়ের জনগণ তাকে বিচারের সম্মুখীন করে এবং তার ফাঁসি হয়।
রবার্ট হ্যানসেন:
রবার্ট হ্যানসেন জন্ম আমেরিকায়। একজন এফবিআই অফিসার। ১৯৮৩ সালে কাউন্টার ইন্টিলিজেন্সীর অংশ হিসেবে একটা সাথে তাকে সোভিয়েত ইউনিয়নে (বর্তমান রাশিয়া) পাঠানো হয় । সেখানে সে টাকার বিনিময়ে মার্কিন ডবল এজেন্টদের নাম সহ অন্যান্য কিছু গুরুত্বপূর্ন তথ্য কেজিবির এক এজেন্টের কাছে বিক্রি করে দেয়। 
খ) ধর্মীয় শিক্ষা

ইসলামে বলা হয়েছে, “বিশ্বাসঘাতক ব্যক্তি আল্লাহর কাছে প্রিয় নয়”। আবার খ্রিস্টধর্মেও জুডাসের বিশ্বাসঘাতকতার উদাহরণ রয়েছে।

গ) সামাজিক উদাহরণ:
আজকের সমাজে প্রতিদিনই আমরা সংবাদপত্রে প্রতারণা, দুর্নীতি, বিশ্বাস ভঙ্গের খবর পড়ি। এগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য মানুষ সত্যিই বিরল।

৬. আধুনিক জীবনে দ্বৈত মানসিকতার প্রয়োজনীয়তা

আজকের ডিজিটাল যুগে মানুষ ভার্চুয়াল জগতে যতটা সংযুক্ত হচ্ছে, বাস্তবে ততটা বিচ্ছিন্ন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা সহজে বন্ধুত্ব করি, কিন্তু একই সাথে প্রতারণা, ভুয়া পরিচয় ও ফাঁদও বেড়ে যাচ্ছে। তাই এখানে আংশিক অবিশ্বাস অপরিহার্য। ব্যাংকিং সিস্টেমে আমরা পাসওয়ার্ড ব্যবহার করি, এটা অবিশ্বাসেরই প্রকাশ। অনলাইন কেনাকাটায় আমরা আগাম টাকা না দিয়ে “ক্যাশ অন ডেলিভারি” চাই, এটা আস্থাহীনতার কারণে। এমনকি চিকিৎসক বা আইনজীবীর ক্ষেত্রেও আমরা “সেকেন্ড ওপিনিয়ন” নেই, কারণ এককথায় বিশ্বাস করা যায় না।

৭. দার্শনিক আলোচনায়:
ফরাসি দার্শনিক দেকার্ত বলেছেন: “সন্দেহই জ্ঞানের প্রথম ধাপ।” অর্থাৎ, প্রশ্ন না করলে, সবকিছু অন্ধভাবে বিশ্বাস করলে আমরা কখনো সত্য জানতে পারব না। আবার জার্মান দার্শনিক নীৎসে বলেছেন: “মানুষের মনের ভেতর দ্বৈততা থাকবেই, বিশ্বাস ও অবিশ্বাস মিলেই সত্য।”

৮. ব্যক্তিজীবনে প্রভাব:
এক চোখে বিশ্বাস আর অন্যচোখে অবিশ্বাস নিয়ে চলা মানে আমরা কাউকে সুযোগ দেবো, কিন্তু সবকিছু অর্পণ করবো না। আমরা সম্পর্ক রাখব, কিন্তু নিজের সীমারেখা স্পষ্ট করব। আমরা সতর্ক থাকব, যাতে প্রতারণার শিকার না হই। 
এভাবে ভারসাম্য রেখে চললেই জীবনে স্থিতি ও নিরাপত্তা বজায় রাখা সম্ভব।

উপসংহার:
সমাজে নিখুঁত মানুষ নেই, তাই নিখুঁত বিশ্বাসযোগ্যতাও নেই। মানুষ যতই কাছের হোক না কেন, তার মধ্যে লোভ, দুর্বলতা কিংবা স্বার্থ লুকিয়ে থাকে। তাই জীবনের নিরাপত্তা ও মানসিক শান্তির জন্য দরকার একচোখে বিশ্বাস আর অন্যচোখে অবিশ্বাস। এই ভারসাম্যই আমাদের শেখায়, কাকে কতটা ভরসা করতে হবে, কোথায় সীমারেখা টানতে হবে এবং কিভাবে মানুষের ভেতর ভালো-মন্দ মিলিয়ে সহাবস্থান করতে হবে। তবে যারাই বিশ্বাসঘাতকতা করেছে প্রত্যেকেরই পরিণাম ভয়াবহ হলেও বিশ্বাসঘাতকতার কারণে একবার আমাদের যে ক্ষতি হয়ে যাবে তা কখনোই পূরণ হবার নয়। সুতরাং সতর্কতার কোন বিকল্প নেই।

এমএসএম / এমএসএম

স্কুল-জীবনের স্মার্টফোন: শিক্ষার পথ সহজ, নাকি বাঁধার দেয়াল?

ডিজিটাল ইকোনমিতে তরুণদের অংশগ্রহণে বাড়ছে প্রবৃদ্ধির গতি

রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে বাড়ছে অপরাধ

শিক্ষা ব্যবস্থায় ফিরে আসুক পুরনো দিনের ঐতিহ্য

মধ্যপ্রাচ্যের ভিসা সংকট থেকে প্রযুক্তি বাজার: বাংলাদেশের করণীয় কি?

পিআর পদ্ধতি নিয়ে হঠাৎ এতো আলোচনা

আ-তে আলো, আ-তে আধাঁর

মোদির চীন সফর ও বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রভাব

রিসাইক্লিং থেকে রেভিনিউঃ চক্রাকার অর্থনীতির বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি

বিপদের বন্ধু লোকনাথ বাবা ও তাঁর অলৌকিক কাহিনী

অতিরিক্ত স্বাধীনতা জীবনে আধাঁর ডেকে আনে

বিএনপির ৪৭ বছরের পথচলা ও জিয়াউর রহমান

লঙ্ঘিত মানবতার বিশ্বে আশার বাণী