ঢাকা রবিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

অতিরিক্ত স্বাধীনতা জীবনে আধাঁর ডেকে আনে


এসএম পিন্টু photo এসএম পিন্টু
প্রকাশিত: ৪-৯-২০২৫ দুপুর ১:৩৭

মানুষের জীবনে স্বাধীনতা একটি অনন্য উপহার। স্বাধীনতা ছাড়া মানুষ কখনো পূর্ণ মানুষ হতে পারে না। জন্মের পর থেকেই মানুষ তাঁর নিজের অস্তিত্ব রক্ষা এবং বিকাশের জন্য স্বাধীনতা চায়। একদিকে স্বাধীনতা মানুষের সৃজনশীলতা, জ্ঞান, শিল্প ও সংস্কৃতিকে বিকশিত করে; অন্যদিকে অতিরিক্ত স্বাধীনতা তা ধ্বংসের দিকেও ঠেলে দেয়। কারণ স্বাধীনতা যদি দায়িত্বশীলতার সঙ্গে যুক্ত না হয়, তবে তা স্বেচ্ছাচারিতায় পরিণত হয়। সেই স্বেচ্ছাচারিতা মানুষকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয়, যেখানে থাকে অরাজকতা, ভোগবিলাস, নৈতিক অবক্ষয় এবং সামাজিক বিপর্যয়।
ইতিহাস, দর্শন, ধর্ম, সমাজবিজ্ঞান, সব জায়গায়ই স্বাধীনতার মূল্য আলোচিত হয়েছে। তবে সেই সঙ্গে সতর্ক করা হয়েছে “অতিরিক্ত স্বাধীনতা”র বিপদ সম্পর্কে। সক্রেটিস, এরিস্টটল, জন লক, জ্যাঁ জ্যাক রুশো কিংবা মহাত্মা গান্ধী সবাই বলেছেন স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তার কথা, তবে সেটি অবশ্যই সংযম ও দায়িত্ববোধের সঙ্গে থাকা চাই।
এই প্রবন্ধে আমরা স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ, অতিরিক্ত স্বাধীনতার ক্ষতি, ইতিহাস ও আধুনিক সমাজে এর উদাহরণ, দার্শনিকদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং কীভাবে সুষম স্বাধীনতা রক্ষা করে আলোকিত সমাজ গড়া যায়, তা আলোচনা করব।

স্বাধীনতার সংজ্ঞা ও প্রকৃত অর্থ:
স্বাধীনতা মানে শুধু যা খুশি তাই করার অধিকার নয়। বরং স্বাধীনতা হলো এমন এক অবস্থা, যেখানে মানুষ নিজের সিদ্ধান্ত নিতে পারে, নিজের জীবনকে গড়ে তুলতে পারে, তবে সেটি করতে গিয়ে অন্যের অধিকার বা সমাজের নিয়ম ভঙ্গ করে না। বিখ্যাত দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিল তাঁর অন লিবার্টি গ্রন্থে বলেছেন: “স্বাধীনতা মানে হলো এমন স্বাধীনতা, যেখানে ব্যক্তি তার জীবন যেভাবে ইচ্ছা গড়তে পারে, তবে শর্ত হলো সে যেন অন্যের স্বাধীনতা বা অধিকার ক্ষুণ্ণ না করে।” অতএব, স্বাধীনতা মানে সীমাহীনতা নয়, বরং সীমার ভেতরে থেকে দায়িত্বশীলতার চর্চা।
অতিরিক্ত স্বাধীনতার ধারণা:
অতিরিক্ত স্বাধীনতা মানে হলো যখন মানুষ বা সমাজ স্বাধীনতার নামে সকল সীমা ভেঙে ফেলে, দায়িত্ববোধ হারিয়ে ফেলে এবং শৃঙ্খলার তোয়াক্কা করে না।
উদাহরণস্বরূপ: সন্তান যদি বলে “আমি পড়ব না, আমি খাব না, আমি কাজ করব না, আমার স্বাধীনতা আছে”, তবে এটি শিক্ষা ও দায়িত্বকে অস্বীকার করা হয়। স্বাধীনতার দোহায় দিয়ে পরিবারের যে কেউ যদি বেপরোয়া জীবন যাপন করে, তাকে থামাতে গেলে যদি বলে আমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হবে। আবার পরিবার বা রাষ্ট্রের অভিবাবক যদি সদস্যদের শাসনের নামে অবিচার করে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে যদি কেউ দায় চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে, তবে সেটাকে কখনোই স্বাধীনতার সজ্ঞায় রাখতে পারিনা। তা হবে স্বাধীনতার অপব্যবহার। এমন স্বাধীনতা কখনোই কাম্য নয়। পরিবারে যদি সবাই নিজের মতো করে চলে এবং অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা না দেখায়, তবে সেটি পরিবার ভাঙনের দিকে নিয়ে যায়। রাষ্ট্রে যদি নাগরিকরা আইনকে মানতে না চায় এবং শুধু নিজেদের সুবিধা দেখে, তবে রাষ্ট্র ভেঙে পড়ে। অর্থাৎ, যেখানে স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণহীন, সেখানেই আধাঁর নেমে আসে।

ব্যক্তিজীবনে অতিরিক্ত স্বাধীনতার প্রভাব:
১. দায়িত্বহীনতা:
স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে যখন কেউ মনে করে তার জন্য কোনো নিয়ম নেই, তখন সে দায়িত্বহীন হয়ে পড়ে। যেমন, কর্মক্ষেত্রে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া, শিক্ষায় অবহেলা, পারিবারিক কর্তব্য পালন না করা ইত্যাদি।

২. ভোগবিলাসে আসক্তি:
অতিরিক্ত স্বাধীনতা মানুষকে তাৎক্ষণিক আনন্দের দিকে টেনে নেয়। ফলে মাদক, জুয়া, অশ্লীল বিনোদন ইত্যাদিতে জড়িয়ে পড়ে। আর এই বিলাসিতার ফলে মানুষ অন্ধকারের দিকে ধাবিত হয় আর এই পথ থেকে ফেরানোর চেষ্টায় পরিবার অস্থির হয়ে পড়ে। সংসারে নেমে আসে অশান্তি, যা একসময় ধ্বংসে পরিনত হয়। 

৩. আত্মকেন্দ্রিকতা:
স্বাধীনতার নামে অনেকেই শুধু নিজের ইচ্ছাকেই বড় করে দেখে। এতে সহমর্মিতা, মানবিকতা, ত্যাগের মানসিকতা কমে যায়। ফলে পরস্পরের প্রতি কোন দায় থাকে না। এই পরিস্থিতি মানুষকে ঝগড়া বিবাদের কাছে নিয়ে যায়। একপর্যায়ে মামলা, হামলা, মানসিক অস্থিরতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর এভাবেই একজন মানুষ থেকে ধ্বংস হয়ে যায় পরিবার, সমাজ এমনকি রাষ্ট্র পর্যন্ত। 

৪. মানসিক অস্থিরতা:
দায়িত্বহীন ও অতিরিক্ত স্বাধীন জীবনযাপন দীর্ঘমেয়াদে মানসিক শূন্যতা তৈরি করে। তখন মানুষ জীবনের অর্থ খুঁজে পায় না। জীবন যাপন উশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে একা হয়ে পড়ে। পরিস্থি বুঝার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে ফলে যেকোন সময় অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এই পরিস্থিতি দীর্ঘ হলে একসময় আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখা দেয়।

পারিবারিক জীবনে অতিরিক্ত স্বাধীনতার প্রভাব:

১. বাবা-মা ও সন্তানের সম্পর্কের টানাপোড়েন:
বর্তমান সমাজে দেখা যায়, সন্তানরা অনেক সময় প্রেম, বিবাহ বা ক্যারিয়ার বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের অভিমত অগ্রাহ্য করে। তারা ভাবে এটাই স্বাধীনতা। কিন্তু এই স্বাধীনতা যখন বাবা-মায়ের মনে আঘাত করে, তখন পরিবারে অশান্তি জন্ম নেয়।

২. সংসার ভাঙনের ঝুঁকি:
স্বামী-স্ত্রী যদি অতিরিক্ত স্বাধীনতার নামে একে অপরের প্রতি দায়িত্ব এড়িয়ে চলে, তবে সংসারে অশান্তি শুরু হয়, সংসার ভেঙে যায়। অনেক ক্ষেত্রে হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনাও ঘটে।

৩. মূল্যবোধের ক্ষয়:
অতিরিক্ত স্বাধীনতার ফলে পরিবারের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও নৈতিকতা ধ্বংস হতে থাকে।

সামাজিক জীবনে অতিরিক্ত স্বাধীনতার প্রভাব:

১. আইন-শৃঙ্খলার অবনতি

যদি সমাজের মানুষ বলে “আমরা স্বাধীন, তাই আইন মানব না”তাহলে চুরি, ডাকাতি, দুর্নীতি বেড়ে যায়।

২. অপসংস্কৃতির বিস্তার:
সংস্কৃতির নামে অশ্লীলতা, অনৈতিকতা এবং ভোগবাদ সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। এথেকেও অনেক সময় ধর্ষণের মতো জঘন্য ঘটনা ঘটে থাকে। আবার পরিস্থিতি আরো খারাপ হলে খুন খারাপির ঘটনা ঘটাও অস্বাভাকি নয়।

৩. সামাজিক বৈষম্য বৃদ্ধি:
যখন সবাই শুধু নিজের স্বাধীনতা চায়, তখন ধনী আরও ধনী হয় আর গরিব বঞ্চিত হয়।

রাষ্ট্রীয় জীবনে অতিরিক্ত স্বাধীনতার প্রভাব:
রাষ্ট্র তখনই টিকে থাকে, যখন নাগরিকরা স্বাধীনতার পাশাপাশি আইনকেও মানে। কিন্তু অতিরিক্ত স্বাধীনতার কারণে অরাজকতা সৃষ্টি হয়, সরকার দুর্বল হয়ে পড়ে, বিদেশি শক্তি হস্তক্ষেপের সুযোগ পায়। ইতিহাসে আমরা দেখেছি, ফরাসি বিপ্লবের সময় স্বাধীনতার নামে বিশৃঙ্খলা হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নে অতিরিক্ত স্বাধীনতা চাওয়ার কারণে ভাঙন এসেছিল।

দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের দৃষ্টিভঙ্গি:
গ্রিক দার্শনিক ও পশ্চিমা দর্শনের জনক সক্রেটিস বলেছেন, “অযাচিত স্বাধীনতা শেষ পর্যন্ত দাসত্বে পরিণত হয়।” প্রাচীন গ্রিক বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও পাশ্চাত্য দর্শনের জনক এরিস্টটল বলেছেন, “মানুষ হলো সামাজিক প্রাণী। যদি সে অতিরিক্ত স্বাধীনতার কারণে সমাজের নিয়ম অমান্য করে, তবে সে পশুর মতো হয়ে যায়।” ইংরেজ দার্শনিক জন লক বলেছেন, স্বাধীনতা মানে আইন ভাঙা নয়। বরং আইন মেনে চলার ভেতরেই প্রকৃত স্বাধীনতা আছে। ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রধান নেতা ও ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর ভাষায় “স্বাধীনতা তখনই সুন্দর, যখন তা অন্যের অধিকার ও সুখকে সম্মান করে।”
এসব ইতিহাস থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি স্বাধীনতা মানে ভোগ করা নয়, স্বাধীনতা মানের অন্যের অধিকার নিশ্চিত করা। সুন্দরের জন্য ত্যাগ করা।

আধুনিক সমাজে অতিরিক্ত স্বাধীনতার উদাহরণ:
১. সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার
আজকের যুগে সোশ্যাল মিডিয়া স্বাধীন মতপ্রকাশের সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু অতিরিক্ত স্বাধীনতার কারণে এখানে গুজব, পর্নোগ্রাফি, ঘৃণামূলক বক্তব্য ছড়িয়ে পড়ছে।
২. ভোগবাদী সংস্কৃতি:
অনেক তরুণ “আমি স্বাধীন, তাই ভোগ করব” এই মনোভাব নিয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
৩. পারিবারিক অশান্তি:
বাবা-মা ও সন্তানের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্বন্দ্ব বাড়ছে, বিশেষত বিয়ে বা প্রেমের ক্ষেত্রে।
৪. রাজনৈতিক অস্থিরতা:
রাজনীতিতে অতিরিক্ত স্বাধীনতা দাবি করে আন্দোলন কখনো কখনো সহিংসতায় রূপ নেয়।

সুষম স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা:
অতিরিক্ত স্বাধীনতার অন্ধকার থেকে বাঁচতে হলে দরকার সুষম স্বাধীনতা। এর মানে হলো, ব্যক্তি তার মত প্রকাশ করবে, তবে দায়িত্বশীলভাবে। পরিবারে স্বাধীনতা থাকবে, তবে পারস্পরিক শ্রদ্ধা বজায় রাখতে হবে। সমাজে স্বাধীনতা থাকবে, তবে আইন ও নৈতিকতার ভিত্তিতে। রাষ্ট্রে স্বাধীনতা থাকবে, তবে জাতীয় স্বার্থকে কেন্দ্র করে।

উপসংহার:
অতিরিক্ত স্বাধীনতা দেখতে যতই আকর্ষণীয় হোক না কেন, বাস্তবে তা জীবনে আধাঁর নিয়ে আসে। কারণ এটি দায়িত্ব, শৃঙ্খলা ও নৈতিকতাকে ধ্বংস করে দেয়। ইতিহাস, দর্শন ও বাস্তব জীবন সবই প্রমাণ করে, সীমাহীন স্বাধীনতা কোনো কল্যাণ বয়ে আনে না। তাই আমাদের মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতা প্রয়োজন, তবে তা অবশ্যই দায়িত্বশীলতার সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ হতে হবে।


অতএব, অতিরিক্ত স্বাধীনতা নয়; সংযত, দায়িত্বশীল ও সুষম স্বাধীনতাই মানুষকে প্রকৃত আলো, সুখ ও শান্তির পথে নিয়ে যেতে পারে।
লেখক: সভাপতি, রেলওয়ে জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন

এমএসএম / এমএসএম

স্কুল-জীবনের স্মার্টফোন: শিক্ষার পথ সহজ, নাকি বাঁধার দেয়াল?

ডিজিটাল ইকোনমিতে তরুণদের অংশগ্রহণে বাড়ছে প্রবৃদ্ধির গতি

রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে বাড়ছে অপরাধ

শিক্ষা ব্যবস্থায় ফিরে আসুক পুরনো দিনের ঐতিহ্য

মধ্যপ্রাচ্যের ভিসা সংকট থেকে প্রযুক্তি বাজার: বাংলাদেশের করণীয় কি?

পিআর পদ্ধতি নিয়ে হঠাৎ এতো আলোচনা

আ-তে আলো, আ-তে আধাঁর

মোদির চীন সফর ও বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রভাব

রিসাইক্লিং থেকে রেভিনিউঃ চক্রাকার অর্থনীতির বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি

বিপদের বন্ধু লোকনাথ বাবা ও তাঁর অলৌকিক কাহিনী

অতিরিক্ত স্বাধীনতা জীবনে আধাঁর ডেকে আনে

বিএনপির ৪৭ বছরের পথচলা ও জিয়াউর রহমান

লঙ্ঘিত মানবতার বিশ্বে আশার বাণী