ঢাকা মঙ্গলবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

সৌদির ভূরাজনৈতিক কণ্ঠস্বর: তেল, জোট ও পুরোনো মার্কিন চুক্তির টানাপোড়েন


কে এম জয়নুল আবেদীন  photo কে এম জয়নুল আবেদীন
প্রকাশিত: ২১-৯-২০২৫ দুপুর ৩:১১

দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি সম্পর্ক দাঁড়িয়ে ছিল এক নাজুক সমঝোতার ওপর- আমেরিকা দিত নিরাপত্তার নিশ্চয়তা আর সৌদি আরব বিশ্ববাজারে তেলের সরবরাহ স্থিতিশীল রাখত। কিন্তু এখন সেই সমঝোতা চাপে পড়েছে। বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্যে পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রিয়াদ এখন স্পষ্টভাবে জানাতে চাইছে যে তারা শুধু দর্শক নয়, বরং সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হতে চায়। তাদের কণ্ঠস্বর জোরালো করতে সৌদি আরব ব্যবহার করছে জ্বালানি কূটনীতি, বিকল্প জোট গঠন এবং ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃসমন্বয়ের কৌশল। ব্রুকিংস, কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস (CFR), এবং জার্মান মার্শাল ফান্ডসহ বিভিন্ন থিংক ট্যাংক এই পরিবর্তনের পেছনের কারণগুলো তুলে ধরছে।

২০২৪ সালের ১০ জুলাই ব্রুকিংস প্রকাশিত অ্যান্ড্রু লিবার ও কেভিন হাগার্ডের নিবন্ধ “Making Sense of a Proposed U.S.- Saudi Deal” উল্লেখ করে যে যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছিল একটি নতুন প্রতিরক্ষা চুক্তি, সম্ভবত এর সঙ্গে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়াও যুক্ত হতো। কিন্তু সৌদি নেতৃত্ব সেখানে খুব সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। ব্রুকিংস পর্যবেক্ষণে বলেছে, রিয়াদ “এই প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হবে যতক্ষণ না পর্যন্ত তা নিরাপত্তা বা মর্যাদাগত লাভ এনে দেয়, তবে নিজেদের অভ্যন্তরীণ বা আঞ্চলিক অবস্থানকে ঝুঁকির মুখে ফেলবে না।” অন্যদিকে CFR- এর “Saudi Arabia: U.S. Relations” প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্পর্কের বর্তমান অবস্থা “খুবই টানাপোড়েনপূর্ণ।” বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ এফ. গ্রেগরি গস III বলেছেন, “এটি দুই দেশের সম্পর্কের সবচেয়ে খারাপ সময় ১৯৭০- এর দশকের তেল অবরোধের পর থেকে।” এই তুলনা স্পষ্ট করে দেয় যে, সম্পর্ক কতটা ভঙ্গুর হয়ে উঠেছে এবং একই সঙ্গে সৌদি আরব এখনো কতটা প্রভাবশালী অবস্থানে আছে।

সৌদি আরবকে এখন অনেক গবেষণা প্রতিষ্ঠান এক ধরনের “সুইং স্টেট” হিসেবে ব্যাখ্যা করছে। ২০২৩ সালের মে মাসে জার্মান মার্শাল ফান্ডের প্রতিবেদনে বলা হয়, সৌদি আরবসহ কিছু দেশ “যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে ভিন্ন ভিন্নভাবে সহযোগিতা করে নিজেদের বৈশ্বিক প্রভাব বাড়াতে চাইছে এবং আঞ্চলিক গোষ্ঠী বা বহুপক্ষীয় প্ল্যাটফর্মেও সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে।” এই কৌশল, যাকে “মাল্টি-অ্যালাইনমেন্ট” বলা হচ্ছে, রিয়াদকে স্বাধীনভাবে তেলশক্তি, নতুন জোট এবং কূটনৈতিক মধ্যস্থতা ব্যবহার করে নিজেদের কণ্ঠস্বরকে শোনা নিশ্চিত করার সুযোগ দিচ্ছে।

তেল এখনও সৌদি আরবের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। ওপেক+এর প্রধান খেলোয়াড় হিসেবে তারা বৈশ্বিক বাজারে দাম ও সরবরাহ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। CFR স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে, পুরোনো মার্কিন- সৌদি সমঝোতার প্রধান ভিত্তি ছিল “আমেরিকার জন্য তেল আর সৌদি আরবের জন্য সামরিক নিরাপত্তা।” কিন্তু মার্কিন চাপ সত্ত্বেও সৌদি আরব অনেক সময় তেল উৎপাদনে বড় ধরনের ছাড় দিতে রাজি হয়নি। ব্রুকিংসও বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশা অনুযায়ী সৌদি আরব উৎপাদন কমায় বা বাড়ায় না; বরং সিদ্ধান্ত নেয় বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায়। পাশাপাশি, সৌদি আরব বিকল্প নিরাপত্তা অংশীদারও খুঁজছে। ২০২৫ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের সঙ্গে তারা একটি পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি সই করে, যেখানে বলা হয়, “এক দেশের ওপর আক্রমণ হলে তা উভয় দেশের ওপর আক্রমণ হিসেবে গণ্য হবে।” এটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে, রিয়াদ যুক্তরাষ্ট্রের বাইরেও কার্যকর নিরাপত্তা জোট তৈরি করতে সক্ষম।

তবে এই পথ ঝুঁকিমুক্ত নয়। অভ্যন্তরীণ বৈধতার জন্য সৌদি নেতৃত্বকে ফিলিস্তিনি ইস্যুতে জনগণের সংবেদনশীলতা মাথায় রাখতে হয়। ফলে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রশ্নটি এখনো স্পর্শকাতর। ব্রুকিংসের মতে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর থেকে সৌদি কর্মকর্তারা ধারাবাহিকভাবে বলেছেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রশ্ন মীমাংসা ছাড়া কোনো স্বাভাবিকীকরণ সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও তেলকে চাপের অস্ত্র হিসেবে অতিরিক্ত ব্যবহার করলে সৌদি আরবের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং ক্রেতারা বিকল্প উৎস বা নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে দ্রুত সরে যেতে পারে। আর যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও কংগ্রেস সৌদি আরবের সঙ্গে বাধ্যতামূলক নিরাপত্তা চুক্তির ব্যাপারে সন্দিহান- মানবাধিকার ও স্বচ্ছতার অভাব তাদের প্রধান উদ্বেগ।

ওয়াশিংটনের জন্য চ্যালেঞ্জ স্পষ্ট। সৌদি আরব আর আগের মতো অনুগত অংশীদার নয়। পুরোনো সমঝোতা, যেখানে মার্কিন নিরাপত্তা নিশ্চিত করত সৌদি আরবের তেল সরবরাহ, এখন কার্যত দুর্বল হয়ে পড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র হয়তো আরও বেশি লেনদেনভিত্তিক সম্পর্ক মেনে নিতে বাধ্য হবে- যেখানে সৌদি নিরাপত্তায় সীমিত সহায়তা দেবে, তবে রিয়াদ একইসঙ্গে চীন, রাশিয়া ও অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখবে। আবার, আমেরিকাকে সতর্ক থাকতে হবে যেন কৌশলগত শূন্যতা তৈরি করে সৌদি আরবকে প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির দিকে ঠেলে না দেয়। গবেষণা সংস্থাগুলো পরামর্শ দিচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রকে একটি পরিষ্কার প্রস্তাব দিতে হবে: বাস্তব নিরাপত্তা নিশ্চয়তা, জ্বালানি রূপান্তর ও পারমাণবিক প্রযুক্তিতে সহযোগিতা, এবং আঞ্চলিক কূটনীতিতে সৌদি আকাঙ্ক্ষাকে সম্মান করা।

সবশেষে বলা যায়, সৌদি আরব আজ ঘোষণা করছে যে তারা আর শুধু তেলের সরবরাহকারী নয়- বরং শর্ত নির্ধারণকারী, অংশীদার বেছে নেওয়া এবং বৈশ্বিক ফলাফল প্রভাবিত করার সক্ষমতা রাখে। এই দৃঢ় অবস্থান এসেছে একদিকে তেলের বাজারে তাদের প্রকৃত শক্তি থেকে, অন্যদিকে বৈশ্বিক শক্তির পুনর্বিন্যাস থেকেও। যুক্তরাষ্ট্র এই বাস্তবতাকে উপেক্ষা করতে পারবে না বা পুরোনো সমঝোতাকে আগের মতো ধরে রাখতে পারবে না। রিয়াদের কাছে প্রাসঙ্গিক থাকতে হলে ওয়াশিংটনকে মানিয়ে নিতে হবে- সৌদি স্বায়ত্তশাসনকে সম্মান জানাতে হবে, একইসঙ্গে পারস্পরিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। সংক্ষেপে, সৌদি আরব এখন নিজের ভূরাজনৈতিক কণ্ঠস্বর খুঁজে পেয়েছে এবং সেটি ব্যবহারের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

 লেখক:  প্রকৌশলী কে এম জয়নুল আবেদীন।

এমএসএম / এমএসএম

সৌদির ভূরাজনৈতিক কণ্ঠস্বর: তেল, জোট ও পুরোনো মার্কিন চুক্তির টানাপোড়েন

শুভ মহালয়া : দূর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গার আগমনী মঙ্গল বার্তা

সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ অপরিহার্য

আন্তর্জাতিক বিশ্বব্যবস্থা ও বৈশ্বিক বাস্তবতা

উপাচার্য ড. শওকাত আলীর এক বছর: শিক্ষা, প্রশাসন ও সৃজনশীল নেতৃত্বের মূল্যায়ন

প্লাস্টিকের বোতল: একটি নীরব পরিবেশগত মহামারির সুদূরপ্রসারী পরিণতি

নিরাপদ পৃথিবীর জন্য ওজোন স্তর রক্ষায় প্রয়োজন বিশ্বজনীন অঙ্গীকার

মুসলিম রাষ্ট্রকে নিয়ে বৈশ্বিক শক্তির ষড়যন্ত্র-মো. হাসিব

শিশু হাসপাতালে সেবার পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে ও দালালদের দৌরাত্ম্য কমেছে

স্কুল-জীবনের স্মার্টফোন: শিক্ষার পথ সহজ, নাকি বাঁধার দেয়াল?

ডিজিটাল ইকোনমিতে তরুণদের অংশগ্রহণে বাড়ছে প্রবৃদ্ধির গতি

রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে বাড়ছে অপরাধ

শিক্ষা ব্যবস্থায় ফিরে আসুক পুরনো দিনের ঐতিহ্য