বিভাজনের রাজনীতি দেশের জন্য হুমকি হতে পারে

রাজনীতিতে কে কখন শত্রু হয়, কখন মিত্র হয় তা বলা মুশকিল। এক সময়ের মিত্ররা এখন মুখোমুখি অবস্থানে। জুলাই বিপ্লবে ঐক্য থাকলেও এখন অনেকের মধ্যে অনৈক্য দৃশ্যমান। আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে রাজনীতিতে বিভক্তি এখন চরমে।অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষিত নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে রাজনীতিতে উত্তাপ তত বাড়ছে। বিশেষ করে দীর্ঘদিন আলোচনার পরও জুলাই সনদের বাস্তবায়ন নিয়ে একমত হতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো।একই সময়ে কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে নেমেছে জামায়াতে ইসলামীসহ অন্তত সাতটি দল। যদিও দলগুলো কাগজে-কলমে কোনো জোটের কথা বলছে না, তবে তারা বিএনপির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে কি না, সেই প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। মাঠে নামা দলগুলোর মধ্যে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতে জড়িত কয়েকটি দল যেমন আছে, আবার তাদের দাবিগুলোও অনেকটা একইরকম। জুলাই সনদের ভিত্তিতে আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন, আনুপাতিক বা পিআর পদ্ধতির নির্বাচন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা, আওয়ামী লীগের বিচার এবং জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করা এসব দাবিতে বিভিন্ন দলের কর্মসূচিও পালন করা হচ্ছে একই দিনে। অনেকটা হঠাৎ করেই রাজপথে আন্দোলন কেন সেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি দাবি নিয়ে বিএনপির অবস্থান ভিন্ন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে-বিএনপির বিপরীতে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর একটা শক্তিকে কি দৃশ্যমান করার চেষ্টা হচ্ছে?আন্দোলন গড়ে তোলার কথা বলছে যে দলগুলো, তারা যদিও এই জোট করার দাবি খারিজ করে দিয়েছে, তবে বিএনপি এর পেছনে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা' দেখছে। আবার রাজনৈতিক কর্মসূচিকে ঘিরে রাজপথে সংঘাতের সূচনা হতে পারে কি না, সে আশঙ্কাও করছেন অনেকে।কারণ শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিভিন্ন পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের আন্দোলন হলেও রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে আন্দোলনে নামার উদ্যোগ এবারই প্রথম। ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা চলছে।এরমধ্যেই আন্দোলন কী বার্তা দিচ্ছে, সেই প্রশ্ন উঠছে।
আলোচনার টেবিলে যখন সমাধান হচ্ছে না, তখন দরকষাকষির টেবিলে আন্দোলনের চাপ হয়তো বাড়তি সুবিধা দিতে পারে জামায়াত ও সমমনা দলগুলোকে। ফলে এই পরিস্থিতি বিএনপির জন্যও একটা চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে বলেই অনেকে মনে করেন। আবার রাজনীতিতে অস্থিরতা সৃষ্টি হলে নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও প্রকাশ করছেন কেউ কেউ। জামায়াত এবং অন্যান্য দলগুলোর যে আন্দোলন, দৃশ্যত সেটা সরকারের উদ্দেশ্যে হলেও এর মূল বিরোধ কিংবা দ্বন্দ্ব মূলত বিএনপির সঙ্গে। ফলে আন্দোলনের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্নটা আসছে বিএনপির দিক থেকেই। আপনি যেটা চান, সেটা তো অন্য দলকে জোর করে করাতে পারবেন না। এখানে কারও জোর করার সুযোগ নেই। রাস্তায় নেমে আপনি যদি জোর করে কোনো কিছু চাপিয়ে দিতে চান তাহলে তো জনগণের ওপর আপনার আস্থার অভাব আছে পড়বে এটাই সাভাবিক। এছাড়া বিএনপি মনে করছে ঐকমত্য কমিশনে যখন আলোচনা চলছে তখন রাজপথে আন্দোলনের ভিন্ন উদ্দেশ্য আছে। এখানে সাংবিধানিক ভাবে কী করা যায় সেটা তো আলোচনায় আছে। আলোচনায় থাকা অবস্থায় যদি কেউ কর্মসূচি দেয় তখন তো সেটার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। ঐকমত্যের প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে কেউ যদি রাস্তা অবরোধ করতে চায়, মবোক্রেসি করতে চায়, জোর করে আদায় করতে চায় তাহলে তো এটা ঐকমত্যের বাইরে গিয়ে একটা অরাজনৈতিক ও অগণতিান্ত্রিক প্রক্রিয়ার দিকে যাচ্ছে বলেও মনে করছেন অনেকে। জামায়াতসহ অন্যান্য দলগুলো যে আন্দোলন শুরু করেছে সেখানে সাতটি রাজনৈতিক দলকে দেখা যাচ্ছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জামায়াতে ইসলামী, খেলাফতে মজলিসের দুটি অংশ, নেজামে ইসলাম, খেলাফত আন্দোলন ও জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি-জাগপা। দলগুলো যেসব দাবিতে সরকারকে চাপ দিতে রাজপথে নেমেছে সেগুলো নিয়ে বিরোধিতা হচ্ছে মূলত বিএনপির সঙ্গে।
কারণ জুলাই সনদের ভিত্তিতে আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন, পিআর পদ্ধতিতে ভোট, জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করার মতো বিষয়গুলোতে ভিন্নমত আছে বিএনপির। দলটি মনে করে, যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হচ্ছে না সেগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে ভোটের মাঠে জনগণের কাছে যেতে হবে। আর সংস্কারের যেসব বিষয় বাকি থাকবে সেগুলো পরবর্তী সংসদে উঠবে।এছাড়া বিএনপি পিআর পদ্ধতি বা এর জন্য গণভোট কোনোটাতেই রাজি নয়। জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করার বিষয়েও কোনো পক্ষ নিতে চায় না দলটি। তারা মনে করে, কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হবে কি-না সেটা আইন-আদালতের বিষয়। কিন্তু এই বিষয়গুলো নিয়েই বিভিন্ন ইসলামী দল একই সুরে কথা বলেছে বিভিন্ন ফোরামে। শেষপর্যন্ত রাজপথের কর্মসূচিও পালন করেছে। আর এই বিষয়গুলো ঘটছে এমন এক সময়ে যখন সরকার ঘোষিত নির্বাচনের বাকি আছে পাঁচ মাসেরও কম। নির্বাচন হতে হলে নির্বাচন কমিশনকে তিন মাস পরই তফসিল ঘোষণার দিকে যেতে হবে। কিন্তু সেই নির্বাচনে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ থাকায় আওয়ামী লীগ অংশ নিতে পারবে না বলেই মনে হচ্ছে। ফলে শেখ হাসিনা পরবর্তী রাজনীতিতে বিএনপি থাকলেও আওয়ামী লীগ না থাকায় একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল একজোট হয়ে মূলত বিএনপির বিপরীতে একটা বড় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজেদের দৃশ্যমান করতে চাইছে। অর্থাৎ আন্দোলনের মাধ্যমে একটা রাজনৈতিক জোট ঘটন করা। যদিও বিএনপিকে টার্গেট করে জোটের চেষ্টা হচ্ছে, এমন দাবি নাকচ করছে জামায়াত। দলটি বলছে, আনুষ্ঠানিক ভাবে তারা কোনো জোট গঠন করেননি। দলগুলো নিজেদের মতো করে কর্মসূচি পালন করছে। এটা বিএনপির বিরুদ্ধেও কোনো জোট নয়। জামায়াতের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তাদের আন্দোলন কারও বিরুদ্ধে নয়। তারা জনগণের পক্ষে আন্দোলন করছেন। তারা সংস্কারের আইনি ভিত্তি চান, এই সরকারের আমলে বাস্তবায়ন চান, তার ভিত্তিতে নির্বাচন চান। এই দাবিগুলোতেই তারা এক হয়েছেন।
এছাড়া পিআরসহ আরও বিষয় আছে। সামনে আরও অনেক দল এখানে আসবে। জামায়াতসহ দলগুলো বলছে, সরকার একটি বিশেষ দলের দিকে ঝুঁকে আছে। ফলে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় সমাধান আসছে না। এর জন্যই আন্দোলনের দিকে যেতে হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে টেবিলে সমাধান না পেয়েই তারা এই রাজপথে এসেছেন। জামায়াত জুলাই সনদের ভিত্তিতে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বিভিন্ন দলকে নিয়ে একটি জোট গড়ার চেষ্টা করছে। রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে একটা শোডাউনেরও চেষ্টা করা হচ্ছে বলে মনে করেন অনেকে। তবে এখনো যুগপৎ মডেলে কোনো কর্মসূচিতে যেতে আগ্রহ দেখায়নি এনসিপি। যদিও শুরু থেকেই ইসলামী বিভিন্ন দল এবং এর বাইরে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ ও অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় সম্পৃক্ত ছিল এই দলটি।শেষ পর্যন্ত যুগপৎ আন্দোলনে না থাকার কারণ হিসেবে দাবি নিয়ে মতভিন্নতার কথাই উঠে এসেছে দলটির নেতাদের বক্তব্যে। এনসিপির জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ও গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সংবিধানের যে দাবি, তা নিয়ে অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু পূর্ণ সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের বিষয় এনসিপির কোনো অবস্থান নেই। বরং এনসিপি শুধু উচ্চকক্ষে পিআর বিষয়ে একমত।এছাড়া সন্ত্রাসী ও ফ্যাসিবাদের সহযোগী হিসেবে জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থগিতের দাবির সাথে এনসিপির সমর্থন থাকার কথাও জানিয়েছেন তারা। তাদের দল কোনো জোট বা যুগপৎ আন্দোলনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে গণঅধিকার পরিষদ আবার স্পষ্ট করেই জানিয়েছে, দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য কিংবা মুখোমুখি অবস্থার সৃষ্টি হয় এমন কোনো কার্যক্রমে তারা থাকবে না। কোনো জোটের বিষয়েও কোনো দলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কোনো আলোচনা হয়নি বলেও জানিয়েছেন তারা। তারা এও বলেছেন,যদি যুগপৎ আন্দোলনের নামে বিভক্তি তৈরি হয়,কোনো জোট তৈরি হয়, সেক্ষেত্রে অন্য দলগুলোর সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থান তৈরি হতে পারে।
তাই সবাইকে এক থাকা দরকার।এখানে যদি এখন আট-দশটা দল আলাদা হয়ে যায়, তাহলে অনৈক্য তৈরি হবে, আর এই সুযোগে আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদ ফিরে আসবে। বিএনপি যা চায় তার বিপরীতে যখন একটা আন্দোলন তৈরি হচ্ছে, তখন বিএনপি সেটার জবাব কীভাবে দেবে সেটা একটা প্রশ্ন। যদিও পাল্টা কোনো কর্মসূচির পক্ষপাতি নয় বিএনপি। অর্থাৎ মাঠের কর্মসূচির বদলে বক্তব্য-বিবৃতির মধ্যেই দলের প্রতিক্রিয়া সীমাবদ্ধ থাকবে এমনটাই জানা যাচ্ছে। বিএনপি মাঠে পাল্টা কর্মসূচি দিলে সেটা পরিস্থিতিকে সংঘাতমুখর কিংবা রাজনৈতিক পক্ষগুলোকে মুখোমুখি করে দিতে পারে। এছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হলে নির্বাচনও অনিশ্চয়তায় পড়ে যেতে পারে এমন মূল্যায়ন আছে বিএনপিতে। দলটি এখনও জোর দিচ্ছে নির্বাচনি প্রস্তুতিতে। তবে নির্বাচনকে ঘিরে রাজপথ উত্তপ্ত হলে তা দেশের জন্য মোটেও ভাল কিছু বয়ে আনবে না এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। তবে রাজনৈতিক কর্মসূচিকে ঘিরে রাজপথে সংঘাতের সূচনা হতে পারে কি না, সে আশঙ্কাও করছে বিনএনপি। তারা বলছেন, রাজনীতিতে অস্থিরতা সৃষ্টি হলে নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিবর্তিত অবস্থায় ঐক্য ধরে রাখতে অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তিগুলোকে আগে আলোচনার মাধ্যমে খুঁজতে হবে সমাধানের পথ। একে অন্যকে ছাড় না দিলে সংকট নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এজন্য সব পক্ষকে সংযত ও দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। অন্যথায় বিভক্তি-বিভাজনের এই সুযোগ নেবে পরাজিত শক্তি।সুতরাং দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এবং রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা রক্ষায় জাতিগত ঐক্যের বিকল্প নেই।
লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক
Aminur / Aminur

বিভাজনের রাজনীতি দেশের জন্য হুমকি হতে পারে

প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের স্বপ্নের সৌদি আরব

শারদীয় দুর্গোৎসবে সম্প্রীতির বাংলাদেশ ভাবনা

দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য প্রয়োজন পর্যটন গন্তব্যগুলোর সামগ্রিক উন্নয়ন এবং শক্তিশালী ব্র্যান্ডিং

গণতান্ত্রিক অধিকার ও নতুন নেতৃত্বের অন্বেষণ

দুঃখই সবচেয়ে আপন

জাতিগত নিধন বন্ধে জাতিসংঘের ব্যর্থতা

গণতান্ত্রিক হতে হলে মৌলিক অধিকার সমুন্নত রাখতে হয়

স্মার্ট ডিভাইস-আসক্তিতে বিপদগামী হচ্ছে শিশু-কিশোররা

মানবসম্পদ উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা

সৌদির ভূরাজনৈতিক কণ্ঠস্বর: তেল, জোট ও পুরোনো মার্কিন চুক্তির টানাপোড়েন

শুভ মহালয়া : দূর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গার আগমনী মঙ্গল বার্তা
