বন্ধ হোক অপসাংবাদিকতা

ভূমিকা:
সাংবাদিকতা পৃথিবীর অন্যতম প্রভাবশালী একটি পেশা। সমাজে সত্য প্রতিষ্ঠা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা, জনগণের কণ্ঠস্বর তুলে ধরা সাংবাদিকতার মূল দায়িত্ব। সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন কিংবা অনলাইন পোর্টাল, যেখানেই সাংবাদিকতা হোক না কেন, এর উদ্দেশ্য একটাই সত্য প্রকাশ ও জনস্বার্থ রক্ষা।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে, এই মহৎ পেশাকে ঘিরে আজ সৃষ্টি হয়েছে গভীর সংকট। সত্যের পরিবর্তে মিথ্যা, নিরপেক্ষতার পরিবর্তে পক্ষপাত, ন্যায়বিচারের পরিবর্তে নির্বিচার, লোভ, এসবই সাংবাদিকতার অঙ্গনে প্রবেশ করেছে। এই বিকৃত রূপকেই আমরা বলি অপসাংবাদিকতা।
অপসাংবাদিকতা সমাজে এক ভয়ংকর বিষ। এটি মানুষের বিবেককে হত্যা করে, বিভ্রান্তি ছড়ায়, ক্ষমতাসীনদের তোষামোদ করে, আবার কখনও অযথা মানুষকে হেয় করে। ফলে গণমাধ্যমের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হয়, সমাজে অস্থিরতা বাড়ে, গণতন্ত্র বিপন্ন হয়। তাই এখন সময় এসেছে জোরালোভাবে বলার, ”বন্ধ হোক অপসাংবাদিকতা”।
অপসাংবাদিকতা বন্ধ করতে হলে কিছু বিষয় আমাদের জানা দরকার, যা নিচে কিঞ্চিৎ উল্লেখ করার চেষ্টা করছি।
সাংবাদিকতার ইতিহাস ও মর্যাদা:
১.প্রাচীন সাংবাদিকতার সূচনা:
মানুষ যখন থেকে সমাজে বসবাস শুরু করেছে, তখন থেকেই তথ্য আদান-প্রদানের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। প্রথমে তা ছিল মৌখিক সংবাদ পরিবেশন। পরে যখন লিপির উদ্ভব হয়, তখন প্রাচীন সভ্যতাগুলোতে তথ্য লিপিবদ্ধ হয়ে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। মিশর, ব্যাবিলন, রোম, এসব জায়গায়ই প্রাচীনকালে সংবাদ প্রচারের ধরণ ছিল।
রোমান সাম্রাজ্যে দেয়াল লিখনের মাধ্যমে সরকারি ঘোষণা প্রচার করা হতো। এটি ছিল সাংবাদিকতার প্রাচীন রূপ।
২.আধুনিক সাংবাদিকতার বিকাশ:
১৫শ শতকে ছাপাখানার আবিষ্কারের পর থেকে আধুনিক সাংবাদিকতার যাত্রা শুরু হয়। ১৭শ শতকে ইউরোপে প্রথম নিয়মিত সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। ধীরে ধীরে সংবাদপত্র, সাময়িকী, রেডিও ও টেলিভিশনের মাধ্যমে সাংবাদিকতা বিশ্বব্যাপী শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
৩.বাংলায় সাংবাদিকতার ইতিহাস:
বাংলাদেশ তথা বাংলায় সাংবাদিকতার শেকড় বেশ গভীরে প্রোথিত। ১৮১৮ সালে “সমাচার দর্পণ” প্রকাশের মাধ্যমে বাংলায় সাংবাদিকতার সূচনা হয়। এরপর রাজা রামমোহন রায়ের “সংবাদ কৌমুদী”, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের “শিক্ষা পত্রিকা”, পরবর্তী সময়ে নবজাগরণের কালে সংবাদপত্রগুলো সমাজ পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সাংবাদিকতা এক অনন্য গৌরবময় ভূমিকা পালন করেছে। বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ পৌঁছে দেওয়া, বিশ্বজনমত তৈরি করা, সবকিছুই হয়েছিল সাংবাদিকদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে।
৪.সাংবাদিকতার মর্যাদা:
সাংবাদিকতার কাজ হলো জনগণকে তথ্য প্রদান করা। সাংবাদিককে বলা হয় “সমাজের দর্পণ” এবং “চতুর্থ স্তম্ভ” কারণ আইন, বিচার ও প্রশাসনের পাশাপাশি গণমাধ্যমও সমাজকে সঠিক পথে চালিত করে। কিন্তু সেই মহান দায়িত্ব যখন ভুল পথে ব্যবহৃত হয়, তখন সাংবাদিকতা হয়ে দাঁড়ায় ভয়ঙ্কর অস্ত্র।
অপসাংবাদিকতার সংজ্ঞা ও রূপ:
১.অপসাংবাদিকতা কী?
এই প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়, অপসাংবাদিকতা হলো সাংবাদিকতার অপব্যবহার, যেখানে সত্য বিকৃত করা হয়, মিথ্যাকে প্রচার করা হয়, এবং জনগণকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে সংবাদ পরিবেশন করা হয়। একে অনেক সময় “হলুদ সাংবাদিকতা” বা “ভাড়াটে সাংবাদিকতা” বলা হয়।
২.অপসাংবাদিকতার প্রধান রূপ:
হলুদ সাংবাদিকতা: যেখানে উত্তেজনামূলক, অশ্লীল বা অতিরঞ্জিত খবরকে বড় করে প্রচার করা হয়।
ভাড়াটে সাংবাদিকতা: নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির স্বার্থ রক্ষার্থে সংবাদ বিকৃত করা।
চাটুকার সাংবাদিকতা: ক্ষমতাসীনদের তোষামোদ করে সঠিক তথ্য আড়াল করা।
ভুয়া খবর বা গুজব ছড়ানো: বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিথ্যা সংবাদ ভাইরাল করা।
প্রচারণামূলক সাংবাদিকতা: বিজ্ঞাপনকে সংবাদ হিসেবে উপস্থাপন।
মানহানিকর সাংবাদিকতা: কোনো ব্যক্তিকে ইচ্ছাকৃতভাবে হেয় করা।
৩.অপসাংবাদিকতা কেন বিপজ্জনক?
অপসাংবাদিকতা সমাজে বিভ্রান্তি ছড়ায়, ভুয়া তথ্যের কারণে মানুষ ভুল পথে চলে যায়, গুজবের কারণে প্রাণহানি ঘটে। একই সঙ্গে প্রকৃত সাংবাদিকতার মর্যাদা কলুষিত হয়। ফলে দেশ ও জাতির স্বার্থে এখনই অপসাংবাদিকতা রোধ করা জরুরী।
অপসাংবাদিকতার কারণ:
বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা কারণে অপসাংবাদিকতা জন্ম নেয়, এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণগুলো নিম্নরূপ:
১.রাজনৈতিক প্রভাব:
বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই সংবাদমাধ্যম রাজনৈতিক দলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যে দল ক্ষমতায় থাকে, তারা নিজেদের স্বার্থে সংবাদকে নিয়ন্ত্রণ করে। এর ফলে নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
২. কর্পোরেট লোভ:
অনেক গণমাধ্যম ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। তারা নিজেদের পণ্য প্রচার কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে সংবাদকে ব্যবহার করে।
৩. ব্যক্তিগত স্বার্থ:
কিছু সাংবাদিক ব্যক্তিগত লাভের আশায় মিথ্যা সংবাদ তৈরি করে। তারা টাকার বিনিময়ে সংবাদ লিখে, বিজ্ঞাপনকে সংবাদ হিসেবে প্রকাশ করে।
৪. প্রতিযোগিতামূলক বাজার:
টেলিভিশন চ্যানেল বা অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো দ্রুত দর্শক টানতে গিয়ে ভুয়া বা যাচাই-বাছাইহীন খবর ছড়ায়। “সবার আগে ব্রেকিং নিউজ” দেওয়ার প্রতিযোগিতা সাংবাদিকতাকে বিকৃত করছে।
৫. প্রযুক্তির অপব্যবহার:
ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক ইত্যাদি প্ল্যাটফর্মে অনেকে যাচাই না করেই খবর ছড়ায়। একবার খবর ভাইরাল হলে তা সত্য-মিথ্যা যাচাই না করেই মানুষ বিশ্বাস করে ফেলে।
৬. শিক্ষার অভাব:
অনেকেই সাংবাদিকতার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই পেশায় প্রবেশ করছে। নৈতিকতা ও দায়বদ্ধতার অভাব থেকে জন্ম নিচ্ছে অপসাংবাদিকতা।
সমাজে অপসাংবাদিকতার প্রভাব:
অপসাংবাদিকতা শুধু সংবাদ জগতের জন্য নয়, সমগ্র সমাজের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এর প্রভাব রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষা, এমনকি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ভয়াবহভাবে বিস্তার লাভ করে। এখন আমরা পর্যায়ক্রমে এর প্রধান প্রভাবগুলো বিশ্লেষণ করব।
১. সত্য চাপা পড়ে যায়:
সাংবাদিকতার মূল লক্ষ্য হলো সত্য প্রকাশ করা। কিন্তু যখন সংবাদ বিকৃত হয় বা ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা তথ্য প্রচার করা হয়, তখন সত্য আড়াল হয়ে যায়। একটি মিথ্যা সংবাদ যখন ভাইরাল হয়, তখন সেটি যতই খণ্ডন করা হোক না কেন, মানুষের মনে সন্দেহ থেকে যায়। ফলে সত্য তার শক্তি হারায়।
২. জনগণ বিভ্রান্ত হয়:
ভুয়া সংবাদ বা পক্ষপাতদুষ্ট রিপোর্ট মানুষের চিন্তাভাবনা বিকৃত করে। উদাহরণস্বরূপ, কোনো নির্বাচন সামনে রেখে একটি নির্দিষ্ট দলের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হলে জনগণ বিভ্রান্ত হয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এর ফল সমাজব্যবস্থায় অস্থিরতা ও অরাজকতা তৈরি হয়।
৩. ন্যায়বিচার বাধাগ্রস্ত হয়:
অনেক সময় সংবাদমাধ্যম অপরাধীদের পক্ষ নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করে, অথচ ভুক্তভোগীদের কণ্ঠস্বর চাপা পড়ে। আবার কখনও বিচারাধীন মামলার বিষয়ে অতিরঞ্জিত সংবাদ প্রকাশ করে বিচার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। ফলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয় না।
৪. দুর্নীতি ঢেকে যায়:
অপসাংবাদিকতার মাধ্যমে দুর্নীতি, অবিচার, লুটপাট আড়াল করা হয়। অনেক মিডিয়া মালিক নিজেই ব্যবসায়ী বা রাজনীতিবিদ হওয়ায় তাদের স্বার্থ রক্ষায় সাংবাদিকদের ব্যবহার করেন। এর ফলে দুর্নীতি আরো বাড়ে।
৫. বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতা বাড়ে:
ভুয়া খবর ও গুজব অনেক সময় সরাসরি সহিংসতার জন্ম দেয়। বাংলাদেশে দেখা গেছে, কোনো এক ব্যক্তিকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে ভুয়া পোস্টের কারণে গণপিটুনি দেওয়া হয়েছে। আবার কখনও একটি গুজব বাজার অস্থির করেছে, মানুষ আতঙ্কে হাহাকার করেছে।
৬. সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়:
অপসাংবাদিকতার মাধ্যমে অশ্লীলতা, চটকদার জীবনধারা, ভোগবাদী মনোভাবকে উৎসাহিত করা হয়। এর ফলে তরুণ সমাজ বিভ্রান্ত হয়, সাংস্কৃতিক অবক্ষয় ঘটে।
৭. আন্তর্জাতিক পরিসরে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়:
যখন একটি দেশের গণমাধ্যম মিথ্যা বা বিকৃত তথ্য ছড়ায়, তখন আন্তর্জাতিকভাবে দেশের সুনাম ক্ষুণ্ণ হয়। বিদেশি গণমাধ্যমে সেই খবর গিয়ে আরও বড় আকার ধারণ করে। ফলে অর্থনীতি, কূটনীতি ও বৈদেশিক বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
বাংলাদেশে অপসাংবাদিকতার চিত্র:
বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময় দেশ। এখানে সাংবাদিকতার রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সাংবাদিকরা বিশ্বকে বাংলাদেশের সত্য জানাতে অসাধারণ ভূমিকা রাখেন। বিদেশি গণমাধ্যম, প্রবাসী সাংবাদিক, এমনকি গেরিলা সাংবাদিকতার মাধ্যমেও মুক্তিযুদ্ধের বার্তা ছড়িয়ে পড়ে। তখন সাংবাদিকতা ছিল সত্যের জন্য এক মহাযুদ্ধ।
১.স্বাধীনতার পর ভাড়াটে সাংবাদিকতার উত্থান:
দুঃখজনক হলেও সত্য, সাম্প্রতিক দশকগুলোতে অপসাংবাদিকতা ভয়ঙ্করভাবে বেড়েছে। স্বাধীনতার পর থেকেই রাজনৈতিক দলগুলো গণমাধ্যমকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে শুরু করে। ধীরে ধীরে অনেক সাংবাদিক রাজনৈতিক প্রভাবের কাছে নতি স্বীকার করেন। ফলে সংবাদ হয়ে ওঠে পক্ষপাতদুষ্ট।
২.টেলিভিশন সাংবাদিকতার যুগ:
৯০-এর দশকের পর থেকে দেশে টেলিভিশন চ্যানেলের বিস্তার ঘটে। এতে সংবাদপ্রবাহ দ্রুত হয়, তবে প্রতিযোগিতায় নামতে গিয়ে অনেক চ্যানেল যাচাই-বাছাই ছাড়া খবর প্রচার করতে থাকে। দর্শক টানতে চটকদার শিরোনাম, অপরাধকেন্দ্রিক সংবাদ ও উত্তেজনাপূর্ণ কন্টেন্ট বাড়তে থাকে।
৩.অনলাইন সাংবাদিকতার বিস্তার:
ডিজিটাল যুগে বাংলাদেশে হাজারো অনলাইন নিউজ পোর্টাল গড়ে উঠেছে। কিন্তু অনেক পোর্টালের কোনো নিবন্ধন নেই, সাংবাদিকতার নৈতিকতা নেই। তারা মূলত ভুয়া খবর, চটকদার শিরোনাম ও উত্তেজনামূলক কনটেন্ট প্রকাশ করে।
৪.সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপসাংবাদিকতা:
আজকাল ফেসবুক পোস্ট বা ইউটিউব ভিডিওকেই অনেকে সংবাদ ভেবে নেয়। অনেক ব্যক্তি সাংবাদিকতার নাম ব্যবহার করে ভুয়া তথ্য ছড়াচ্ছেন। এতে জনগণ বিভ্রান্ত হচ্ছে, আবার মাঝে মাঝে ভয়ংকর ঘটনা ঘটছে।
অপসাংবাদিকতা বনাম প্রকৃত সাংবাদিকতা
অপসাংবাদিকতা ও প্রকৃত সাংবাদিকতার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। প্রকৃত সাংবাদিকতার উদ্দেশ্য হচ্ছে, সত্য প্রকাশ, জনস্বার্থ রক্ষা করা, নিরপেক্ষ ও তথ্যনির্ভর সংবাদ প্রকাশ করা আর অপসাংবাদিকতার উদ্দেশ্য হচ্ছে, ব্যক্তিস্বার্থ, ক্ষমতার স্বার্থ রক্ষা করা, পক্ষপাতদুষ্ট, মিথ্যা ও গুজবমূলক সংবাদ প্রকাশ করা। সাংবাদিকতা সমাজে আস্থা সৃষ্টি করে অপসাংবাদিকতা সমাজে বিভ্রান্তি ছড়ায়। সাংবাদিকের ভাষা সংযত, দায়িত্বশীল আর অপসাংবাদিকতার ভাষা চটকদার, উত্তেজনামূলক। সাংবাদিকতার ফলে গণতন্ত্র শক্তিশালী হয় আর অপসাংবাদিকতার ফলে গণতন্ত্র দুর্বল হয়। প্রকৃত সাংবাদিকতা যেখানে সমাজের বিবেক, অপসাংবাদিকতা সেখানে সমাজের জন্য বিষবৃক্ষ।
বিশ্ব প্রেক্ষাপটে অপসাংবাদিকতা:
অপসাংবাদিকতা কেবল বাংলাদেশ বা দক্ষিণ এশিয়ার সমস্যা নয়, বরং এটি এখন বৈশ্বিক সংকট। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই সাংবাদিকতার নামে মিথ্যা, বিকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট তথ্য প্রচারের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। ইতিহাস থেকে শুরু করে সমকালীন সমাজে অপসাংবাদিকতা নানা আকারে বিস্তার লাভ করেছে।
১. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হলুদ সাংবাদিকতা:
১৯শ শতকের শেষভাগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ”ইয়েলো জার্নালিজম” বা হলুদ সাংবাদিকতা শব্দটির জন্ম হয়। উইলিয়াম র্যান্ডলফ হার্স্ট ও জোসেফ পুলিতজারের সংবাদপত্রের প্রতিযোগিতার সময় চটকদার, অতিরঞ্জিত ও উত্তেজনাপূর্ণ সংবাদ ছড়ানো শুরু হয়।
স্পেন-আমেরিকা যুদ্ধে (১৮৯৮) এ অপসাংবাদিকতা বড় ভূমিকা রাখে। হার্স্টের পত্রিকাগুলো স্পেনের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করতে মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করে, যার প্রভাব পড়ে মার্কিন সরকারের সিদ্ধান্তে। তখন থেকেই “হলুদ সাংবাদিকতা” শব্দটি হয়ে ওঠে অপসাংবাদিকতার প্রতীক।
২. ইউরোপে রাজনৈতিক সাংবাদিকতা:
ইউরোপের অনেক দেশে সংবাদপত্র দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক দলের মুখপত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। বিশেষ করে ২০শ শতকে জার্মানি, ইতালি ও রাশিয়ায় রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর জন্য গণমাধ্যমকে ব্যবহার করা হয়েছে।
হিটলারের নাৎসি জার্মানিতে ”দের স্ট্যুর্মার” পত্রিকা ছিল ইহুদি বিদ্বেষ ছড়ানোর প্রধান অস্ত্র।
সোভিয়েত ইউনিয়নে “প্রাভদা” ছিল কমিউনিস্ট পার্টির প্রচারণার মাধ্যম, যেখানে সরকারবিরোধী সত্য প্রকাশ করা হতো না।
৩. ভারতীয় উপমহাদেশে সাংবাদিকতার সংকট:
ভারত ও পাকিস্তানেও সাংবাদিকতার ওপর রাজনৈতিক প্রভাব প্রবল। ভারতে নির্বাচনের সময় ভুয়া খবর ও ”পেইড নিউজ” (টাকা দিয়ে সংবাদ প্রচার) একটি বড় সমস্যা। অনেক প্রভাবশালী মিডিয়া কর্পোরেট ও রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণে।
পাকিস্তানে সাংবাদিকরা প্রায়শই সেনা ও সরকারের চাপের মুখে কাজ করেন। অনেক সময় গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হেয় করা হয়।
৪. মধ্যপ্রাচ্যে সংবাদ নিয়ন্ত্রণ:
মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে সংবাদমাধ্যম সরকার নিয়ন্ত্রণ করে। ভিন্নমত প্রকাশ করলে সাংবাদিকদের গ্রেফতার বা নির্বাসিত হতে হয়। ফলে স্বাধীন সাংবাদিকতা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকেও সেন্সর করা হয়।
৫. আন্তর্জাতিক ভুয়া নিউজ ইন্ডাস্ট্রি:
ডিজিটাল যুগে ভুয়া খবর এখন আন্তর্জাতিক ব্যবসা। বিশেষ করে নির্বাচনের সময় ভুয়া ফেসবুক পেজ, বট অ্যাকাউন্ট ও ইউটিউব চ্যানেল থেকে গুজব ছড়ানো হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ”ফেইক নিউজ” ছিল আলোচিত একটি বিষয়। রাশিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে অন্য দেশের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলে।
অপসাংবাদিকতা প্রতিরোধের উপায়:
অপসাংবাদিকতা যত ভয়াবহই হোক না কেন, এটি প্রতিরোধযোগ্য। এজন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, গণমাধ্যমের স্বচ্ছতা, সাংবাদিকদের নৈতিকতা এবং জনগণের সচেতনতা।
১.সাংবাদিকতার নৈতিকতা শক্ত করা:
প্রত্যেক সাংবাদিককে “নৈতিক বিধি” মেনে কাজ করতে হবে। যেমন, সত্য যাচাই ছাড়া সংবাদ প্রকাশ না করা, ব্যক্তিগত আক্রমণ বা মানহানিকর ভাষা ব্যবহার না করা, অর্থ, উপঢৌকন বা রাজনৈতিক প্রলোভনে প্রভাবিত না হওয়া ইত্যাদি।
২. গণমাধ্যমে স্বচ্ছতা আনা:
মালিকানার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। কে কোন গণমাধ্যমের মালিক এবং তার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থ কি, তা জনগণের জানা থাকা উচিত।
৩. সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার মানোন্নয়ন:
সাংবাদিকতার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আরও জোরদার করতে হবে। নৈতিকতা, পেশাদারিত্ব, গবেষণা ও বিশ্লেষণভিত্তিক সাংবাদিকতা শেখাতে হবে।
৪. রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত গণমাধ্যম নিশ্চিত করা:
গণমাধ্যমকে দলীয় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা বন্ধ করতে হবে। এজন্য আইনি সংস্কার, স্বাধীন নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক চাপ প্রয়োজন।
৫. জনগণের সংবাদ সচেতনতা বাড়ানো:
শুধু সাংবাদিকদের নয়, জনগণকেও সচেতন হতে হবে। ভুয়া খবর চেনা, তথ্য যাচাই করা এবং দায়িত্বশীলভাবে সংবাদ গ্রহণ করা নাগরিকদের দায়িত্ব।
৬. ভুয়া খবর প্রতিরোধে প্রযুক্তি ব্যবহার:
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), ফ্যাক্ট-চেকিং ওয়েবসাইট, অ্যালগরিদমিক সিস্টেম ব্যবহার করে ভুয়া খবর শনাক্ত করা সম্ভব। অনেক দেশে ইতিমধ্যেই এই উদ্যোগ শুরু হয়েছে।
ডিজিটাল যুগ ও অপসাংবাদিকতার নতুন রূপ:
ডিজিটাল বিপ্লব যেমন সংবাদ প্রবাহকে দ্রুত করেছে, তেমনি অপসাংবাদিকতাকেও বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
১.সোশ্যাল মিডিয়া সাংবাদিকতা:
ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব বা টিকটক, এসব মাধ্যম এখন অনেকের জন্য সংবাদ গ্রহণের প্রধান উৎস। কিন্তু এখানে যাচাই-বাছাই ছাড়াই যে কেউ সংবাদ প্রকাশ করতে পারে। ফলে ভুয়া খবর ও গুজব আগের চেয়ে অনেক দ্রুত ছড়াচ্ছে।
২.চটকদার শিরোনাম:
অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো দর্শক টানতে চটকদার শিরোনাম ব্যবহার করে। যেমন, “অবিশ্বাস্য” ! আপনি দেখলে হতবাক হবেন, কিন্তু ভেতরে তেমন কোনো তথ্য থাকে না। এভাবে পাঠককের সাথে প্রতারিত করা হয়।
৩.ট্রল নিউজ:
মজার ছলে বানানো ভুয়া খবরও অনেক সময় সত্য ভেবে ছড়িয়ে পড়ে। এতে সমাজ বিভ্রান্ত হয়।
৪.প্রচারণামূলক ভিডিও ও মিথ্যা প্রচারণা:
নির্বাচনের সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়া ভিডিও বা মিথ্যা প্রচারণা চালানো হয়। অনেক সময় ছবি বা ভিডিওকে এডিট করে মিথ্যা প্রমাণ তৈরিও করা হয়।
৫.অ্যালগরিদম-ভিত্তিক সংকট:
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অ্যালগরিদম এমনভাবে কাজ করে যে, চটকদার বা উত্তেজনামূলক খবর বেশি ছড়িয়ে পড়ে। এতে করে সত্য খবর অনেক সময় আড়ালে চলে যায়।
ভবিষ্যতের সাংবাদিকতা কোন পথে?
যদি সাংবাদিকতা সত্য, নিরপেক্ষতা ও সাহসিকতার ভিত্তিতে না দাঁড়ায়, তবে ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তবে আশা আছে, যদি আমরা এখন থেকেই উদ্যোগ নিই।
১.মানবিক সাংবাদিকতা: শুধু তথ্য নয়, মানবিক মূল্যবোধকে সামনে আনা।
২.ডেটা সাংবাদিকতা: তথ্য-প্রমাণ ও গবেষণাভিত্তিক সাংবাদিকতার বিকাশ।
৩.নাগরিক সাংবাদিকতা: সাধারণ মানুষকে সঠিকভাবে সংবাদ পরিবেশনে সম্পৃক্ত করা।
৪.আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: ভুয়া খবর প্রতিরোধে দেশগুলোর মধ্যে সমন্বয়।
৫.প্রযুক্তির ইতিবাচক ব্যবহার: এআই ও ব্লকচেইন দিয়ে সংবাদ যাচাই।
উপসংহার:
সাংবাদিকতা কেবল পেশা নয়, এটি মানুষের জন্য সেবা, সত্যের জন্য সংগ্রাম। কিন্তু যখন সাংবাদিকতা মিথ্যার পথে হাঁটে, তখন তা সমাজকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়। অপসাংবাদিকতা হলো সেই অন্ধকারের প্রতীক। এটি থামানো জরুরি, নইলে আমাদের ভবিষ্যৎ বিপর্যস্ত হবে। তাই আসুন আমরা সবাই একসাথে প্রতিজ্ঞা করি, বন্ধ হোক অপসাংবাদিকতা, জয় হোক সত্যের সাংবাদিকতা।
লেখক: সাংবাদিক ও সভাপতি, রেলওয়ে জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন।
এমএসএম / এমএসএম

গাজায় যুদ্ধের নৃশংসতা ও আন্তর্জাতিক বিচার আদালত

বন্ধ হোক অপসাংবাদিকতা

বিভাজনের রাজনীতি দেশের জন্য হুমকি হতে পারে

প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের স্বপ্নের সৌদি আরব

শারদীয় দুর্গোৎসবে সম্প্রীতির বাংলাদেশ ভাবনা

দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য প্রয়োজন পর্যটন গন্তব্যগুলোর সামগ্রিক উন্নয়ন এবং শক্তিশালী ব্র্যান্ডিং

গণতান্ত্রিক অধিকার ও নতুন নেতৃত্বের অন্বেষণ

দুঃখই সবচেয়ে আপন

জাতিগত নিধন বন্ধে জাতিসংঘের ব্যর্থতা

গণতান্ত্রিক হতে হলে মৌলিক অধিকার সমুন্নত রাখতে হয়

স্মার্ট ডিভাইস-আসক্তিতে বিপদগামী হচ্ছে শিশু-কিশোররা

মানবসম্পদ উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা
