জয় হোক বিশ্ব মানবতার

এই পৃথিবীতে মানুষ যুদ্ধ চায় না, শান্তি চায়। এই স্লোগানে আমরা ইতোমধ্যে শান্তিপ্রিয় বিশ্ববাসীর নানা রকম কর্মসূচিও দেখেছি। ইরাক যুদ্ধ, সিরিয়া ও ফিলিস্তিন সংকট এবং সর্বোপরি ইউক্রেন সংকটসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে সৃষ্ট এমন পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে শান্তিপ্রিয় বিশ্ববাসী এই দাবি জানিয়েছে এবং এখনো এ দাবিতে শান্তিপ্রিয়রা সোচ্চার। কিন্তু মানুষের এই শুভ প্রত্যাশা বারবার হোঁচট খাচ্ছে। যুদ্ধ কিংবা দ্বন্দ্ব-সংঘাত নানা রকম ক্ষয়ক্ষতির চিত্রই স্ফীত করে। মানবতার পরাজয় ঘটায়। মানুষের পাশাপাশি সত্যেরও মৃত্যু হয়। আহত মানুষের আহাজারি বিশ্ব সম্প্রদায়ের বিবেকবান মানুষকে পীড়িত করে। চরমভাবে আঘাত লাগে অর্থনীতিতেও। সুন্দর ও মানবিক জীবনযাপনের জন্য শান্তি মানুষকে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে অদৃশ্যভাবে প্রেরণা জোগায়। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যেসব মৌলিক বিষয় বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার, এর মধ্যে শান্তি অন্যতম। মানুষের জন্যই মানুষের সৃষ্টি। একে অপরের উপকারের মধ্যেই মানবতার উদারতা প্রমাণিত হয়। কাউকে অপমানিত কিংবা অবহেলায় দূরে ঠেলে দেয়ার মধ্যে মানবতার সৌন্দর্য দৃপ্তময় হয়ে ওঠে না। আলোকিত মানুষ হওয়ার পাশাপাশি আলোকিত মানবতার ফেরিওয়ালা হওয়াও জরুরি। মানব সম্প্রদায় আর মানবতা দুটি পৃথককৃত শব্দ হয়ে থাকলেও এ দুটি শব্দ একই সুতোয় গাঁথা। পুষ্প যেমন করে আপনার তরে ফোটে না, মানুষকেও ঠিক সেরকম হতে হবে। একাকী বেঁচে থাকার মধ্যে তেমন কোনো প্রফুল্লতাময় স্বাদ নেই, তৃপ্তি নেই। ইচ্ছেশক্তির ওপর অনেক কিছুই ভর করে থাকে। মানবসম্প্রদায় ইচ্ছে করলে নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারে মানবতার ভিড়ে।
মানবতার উদারতার কারণে মানুষ মরেও অমর থাকে। এ শ্রেষ্ঠত্ব কতজনেই-বা অর্জন করে! কয়েকদিন আগেও মানবসম্প্রদায়কে কীভাবে মানবতার মাঝে বিসর্জন দিতে হয় তা দেখিয়ে দিয়েছেন গাজার মানুষ। পৃথিবীর মানুষের বহুকিছু শিক্ষণীয় আছে, বোঝার আছে, ভাবনার বিষয় আছে। আমরা সুস্থসবল এবং ঐশ্বর্যবান হওয়ার সত্ত্বেও মানব এবং মানবতাকে জীবিত করে রাখার জন্য এই পর্যন্ত কী করেছি? হিসাব করলে দেখা যাবে কিছুই করিনি। তাহলে আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব কোথায়? ভোগবিলাসী জীবনযাপন শুধু ক্ষণিকের জন্যই থাকে, স্তব্ধ হয়ে গেলে কেউ আর খোঁজ নেয় না, খুঁজতে আসে না, ভাবে না। এমন জীবন কাননের সুউৎকৃষ্ট পুষ্পের মতোই অকেজো। জন্মালে জীবন সুন্দর হয়ে ওঠে না, গঠন করতে হয়। মানুষ হওয়ার পাশাপাশি মনুষ্যত্ব এবং মানবতাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য নিজেকে তৈরি করে নিতে হবে। জীবন সুন্দর, যদি জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তোলা যায়। প্রত্যেকে প্রত্যেকের অবস্থান থেকে উদারতা নিয়ে মানবতার অগ্রগতির মানোন্নয়নে কাজ করলে একটি সুশৃঙ্খল মানবসমাজ এবং আলোক রশ্মি জ্বলে থাকা পৃথিবী গঠন হবে। বিশ্বের প্রতিটি মানুষ যদি একে-অপরের তরে এগিয়ে আসে, তাহলে দুষ্ক্রিয়া বলতে আর কিছুই থাকবে না, থাকবে না দাঙ্গামা-হাঙ্গামা, রক্তপাত, অর্থ-ঐশ্বর্যের নানাবিধ লোভ-লালসা ক্ষোভ। মানুষের একটাই পরিচয় থাকা জরুরি, তা হলো সে মানুষ। আর এ মানুষ হওয়ার যেসব দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে তা যথারীতি পালন করার জন্য আপনা থেকে স্পৃহা জাগ্রত হবে। গাজায় দুই বছর যাবত চলা যুদ্ধ শেষ হয়েছে-অন্তত গাজাবাসীর তা-ই ধারণা। বিমানের চক্কর থেমেছে। কামানের গর্জন স্তব্ধ। রাত নামলেও গাজা ঘুমায়নি। যেন ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে মানুষ উঠে আসছে। যেন মৃতদেহ হঠাৎ পুনর্জীবন পেয়েছে। তারা ফিরে এল। তারা প্রথমেই বুকে করে নিয়ে এল নিজের মাতৃভূমিকে; তারপর নিজের সামান্য বেঁচে যাওয়া টুকটাক জিনিসপত্র।
বিশ্ব এমন দৃশ্য আগে দেখেনি। পুরুষেরা ঘরবাড়ির দোরগোড়ায় ধুলো ঝাড়ছে। নারীরা সাগরের পানি দিয়ে ভাঙা পাথর ধুচ্ছে। শিশুরা ধ্বংসস্তূপের ফাঁকে দৌড়াচ্ছে। কেউ হারানো বল খুঁজছে। কেউ খুঁজছে আগুন থেকে বেচে যাওয়া কোনো অদগ্ধ বই। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই যেন মৃত্যু বদলে গেল জীবনে। ধ্বংস বদলে গেল সৃষ্টিতে। নিস্তব্ধতা বদলে গেল মানুষের কর্মমুখরতায়। মানবতার এমন পুনর্জন্ম পৃথিবী কমই দেখেছে। মনে হলো, গাজা যেন কবর থেকে উঠে ঘোষণা দিচ্ছে-‘আমি বেঁচে উঠেছি আবারও'! ষাট হাজারেরও বেশি মানুষ শহীদ হয়েছে। দেড় লাখের বেশি লোক জখম হয়েছে। হাজার হাজার ঘরবাড়ি মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। তবু যারা বেঁচে গেছে, তারা কারও সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করেনি। কারও করুণার আশায় বসে থাকেনি। যাদের বিশ্বাসঘাতকতা ও উদাসীনতা তাদের একা ফেলে দিয়েছে, তাদের কাছে কোনো কৈফিয়তও তারা চায়নি। তারা ফিরে এসেছে নিজেদের ধ্বংসস্তূপে। হাতে হাত লাগিয়ে গড়ে তুলছে নিজের জীবন। যেন পাথরগুলোও তাদের হাত ছুঁয়ে বলছে-‘তুমি-ই সত্যিকারের পাথর, তোমার স্থিরতাই আমার শক্তি।’ভাঙাচোরা ঘরের মাঝে তারা রুয়ে দিচ্ছে আশার বীজ। তাদের এই জীবনের দিকে ফিরে চলা পৃথিবীকে আবারও চমকে দিয়েছে। বাকি বিশ্ব যাকে ফিরে আসা বলছে, গাজার মানুষ সেটাকেই বলছে ‘বিজয়’। সেটি তাদের কাছে চুরি যাওয়া অধিকার ফেরত পাওয়ার ঘোষণা। গাজার ছিল না কোনো যুদ্ধবিমান, ট্যাংক, অস্ত্র, বা কোনো শক্তিধর জোট। ছিল কেবল এই বিশ্বাস যত দিন হৃদয় ধুকধুক করে, তত দিন ভূমি মরে না।মাটির বুক থেকে তারা জন্ম নিয়েছে। তারাই সেই মাটি, সেই ধ্বংসস্তূপ, সেই ভগ্নাবশেষ। তারা ফিরে এসেছে উত্তাল ঢেউয়ের মতো, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, আগামী দিনের দিকে। গাজা না ধৈর্যের চেয়ে বড় কোনো অস্ত্র তুলেছে; না উড়িয়েছে আশার চেয়ে উঁচু কোনো পতাকা।আসলে তাদের বিজয় এসেছে আল্লাহর কাছ থেকে। মানুষের অস্ত্র থেকে নয়। শত্রুরা যেটিকে অর্জন ভেবেছে, বাস্তবে তারা তার চেয়েও বেশি হারিয়েছে। তারা হারিয়েছে নিজেদের মুখোশ, নিজেদের মর্যাদা, নিজেদের বয়ান।আর গাজার পতাকা ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিমে; স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে তারা উদ্দাম নাচ নেচে যাচ্ছে।
আজ পৃথিবীর প্রতিটি মুক্ত আত্মা গাজা থেকে এসেছে। সেখানে চামড়ার রং, ধর্ম, ভাষা, জাত-কিছুই বাধা নয়। গাজার এখন নতুন এক পাসপোর্ট আছে যা কোনো সরকার দেয়নি। সেই পাসপোর্টের নাম বিজয়। এটি বহন করে প্রত্যেক মুক্ত, মর্যাদাবান মানুষ যার জন্য লাগে না কোনো ভিসা, কোনো অনুমতি। গাজার নাম এখন ধ্বনিত হচ্ছে বিশ্বের বড় বড় শহরে, স্টেডিয়ামে, সম্মেলনে, সংবাদমাধ্যমে। অন্যদিকে গাজার শত্রু হারিয়েছে গল্প বলার ক্ষমতা। দশকের পর দশক ধরে গড়ে তোলা ভারসাম্য, প্রভাব, ভাবমূর্তি সব ভেঙে পড়েছে। এখন সেই জাহাজের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে নেই। এটি নিয়ন্ত্রণ করছে পৃথিবীর মুক্ত মানুষ। এটাই আল্লাহর বিজয়। আর গাজা? সে জিতেছে, কারণ সে ফিরে এসেছে। ফিরে আসাটাই এক মহাবিজয়। গাজা জিতেছে, কারণ তার অটলতা রাজনীতিকদের নত হতে বাধ্য করেছে। তার মানুষ ফের গড়ে নেওয়াকে বেছে নিয়েছে, কান্নাকে নয়; তার মানুষ বেছে নিয়েছে কাজ, বিলাপকে নয়; তার মানুষ বেছে নিয়েছে আশাকে, হতাশাকে নয়।গাজা জিতেছে, কারণ তারা আত্মসমর্পণ করেনি। তারা বিজয়ী, কারণ পৃথিবীর সব বিশ্বাসঘাতকতা, সব অবরোধের পরও তারা মাথা নত করেনি। তাদের পানি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, তবু তারা যায়নি। তাদের উচ্ছেদ করতে চেয়েছিল, তবু তারা থেকে গেছে। তাদের ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, তবু তারা ভাঙেনি। তাদের প্রতিরোধকে চেপে ধরা হয়েছিল, তবু তারা পিছু হটেনি। তাদের কণ্ঠ রোধ করা হয়েছিল, তবু তারা নীরব হয়নি। প্রতিদিন মনে হয়-জীবনের নিরাপত্তা, শিক্ষা-সভ্যতার অস্তিত্ব বোধহয় শেষ কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে। ক্রমেই নিষ্ঠুরতম অমানবিক কর্মকাণ্ডে মানব জাতি বেশি পরিমাণে উৎসাহী হয়ে পড়েছে। রক্তলোলুপ জিঘাংসু বাহিনীর বর্বরোচিত সন্ত্রাস-প্রতিসন্ত্রাসে সভ্যতার শরীরজুড়ে রক্তের আল্পনা। প্রশ্ন জাগে মনে, আমরা কোন সভ্যতায় বসবাস করছি? একবিংশ শতকে আমরা কী এই আধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ সভ্যতার কাছে চরম নৃশংসতা প্রত্যাশা করেছি।
পৃথিবীর কোথাও না কোথাও যুদ্ধ, সংঘর্ষ বা রক্তপাত হচ্ছেই। বলা যায়, এটিই এখনো বিশ্বের বাস্তবতা।পৃথিবী জোড়া এখনো অশান্তি, উত্তেজনা, সহিংসতা ও সংঘর্ষের চিত্রই প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে। মানুষ যে শান্তিপূর্ণ বিশ্বের প্রত্যাশা করেছিল, তা এখনো সুদূর পরাহতই রয়ে গেছে। হিংসা, হানাহানিই এখনো পৃথিবীর বাস্তবে। এই চিত্র অস্বীকার করার উপায় নেই। এ জন্যই মনে হয়, এতকিছুর পরও ওই আঁধার যেন গেল না। শান্তির পথে বাধা তো আরও আছে- ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অপুষ্টি। এগুলোও শান্তির পথে কম বড় বাধা নয়। পৃথিবীতে একদিকে প্রাচুর্য ও অপচয়, অন্যদিকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দূর করা না গেলে বিশ্বে শান্তির সুবাতাস প্রত্যাশা করা যায় না। এ জন্যই ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এত জরুরি। বিশ্বে নতুন করে খাদ্যশস্যের মূল্যবৃদ্ধি ও খাদ্য সংকট দেখা দেওয়ার বাস্তবতায় কোটি কোটি মানুষের জীবনে আরও দুর্দশা দেখা দিয়েছে। এই পরিস্থিতি বিশ্ব শান্তির অনুকূল নয়। বিশ্ব শান্তির স্বার্থেই বিশ্বে খাদ্য নিরাপত্তা পড়ে তুলতে হবে। একই সঙ্গে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করতে হবে। যে মানুষ খেতে পায় না, অভুক্ত ও ক্ষুধার্ত- তার শান্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু শান্তি আজ মানুষের প্রায় শেষ আশ্রয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব শান্তি ছাড়া এ বিশ্ব সভ্যতাই অর্থহীন হয়ে দাঁড়াবে। শান্তির কোনো বিকল্প নেই। প্রকৃতপক্ষে আশা বসবাস করে ইচ্ছা ও বিশ্বাসের মধ্যে। আশার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় ঠিক তখনই- যখন বিশ্বকে আশাহীন মনে হয়। আশা পৃথিবীতে সহজলভ্য এবং আপনি চাইলেই পেয়ে যাবেন- এমন নয়। পৃথিবীবাসীর স্বস্তি, শান্তি, কল্যাণ ও প্রগতি ত্বরান্বিত এবং নিশ্চিত করার স্বার্থে শান্তিবাদী আঙ্গিকের একটি শুভতর প্রবর্তনার বিষয়টি অবশ্যই মানবিক বিবেচনায় রাখার উদ্যোগ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তবে এটি নির্ভর করে আমরা পরস্পরকে ধ্বংসের লক্ষ্যে দেখব, নাকি সমকক্ষ মানুষ হিসেবে দেখব- এ প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক, যুক্তরাজ্য
Aminur / Aminur

তুরস্কের প্রত্যাবর্তন: মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির নতুন সম্ভাবনা

জীবনের জয়গানে সড়ক হোক মুখরিত

এক ভয়ংকর সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশ

জয় হোক বিশ্ব মানবতার

আলোর উৎসব দীপাবলি :শান্তি ও সম্প্রীতির জয়গান

কর্পোরেট দুনিয়ায় মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিলুপ্তির সম্ভাবনা: প্রযুক্তির ঝড়, না কি মানবিক পুনর্জাগরণ?

জুলাই সনদ স্বাক্ষর হলো, সংশয় কি কাটলো

পুলিশ - সাংবাদিক দূরত্ব কাম্য নয়

গাজার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগ

নতুন আশা ও সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনে নোবেল প্রাইজ

বিএনপির ভাবনায় আগামীর শিক্ষা ব্যবস্থা: জ্ঞানভিত্তিক দেশ গড়ার দূরদর্শী রোডম্যাপ

রেলের উন্নয়ন কেবল প্রকল্প নয়, দরকার র্কাযকর ব্যবস্থাপনা
