জ্ঞানচর্চায় মেলে পুণ্য ও সম্মান
মানুষকে আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি করেছেন জ্ঞান অর্জনের যোগ্যতা দিয়ে। এর মাধ্যমে মানুষ যেমন তার পার্থিব প্রয়োজন পূরণের উত্তম পন্থা উদ্ভাবন করতে পারে, তেমনি আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি, ন্যায়-অন্যায়বোধ এবং আখেরাতের সফলতা-ব্যর্থতার জ্ঞানও অর্জন করতে পারে। মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণীর এ যোগ্যতা নেই। শিক্ষার মাধ্যমে অজানাকে জানার এবং জানা বিষয়কে কাজে লাগিয়ে অজানার সন্ধান করার যোগ্যতা একমাত্র মানুষেরই আছে। কাজেই ইসলামে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। রাসুল (সা.)-এর ওপর হেরা গুহায় সর্বপ্রথম ওহি নাজিল হয়, ‘পড়ো, তোমার পালনকর্তার নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন’ (সুরা আলাক : ১)। হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) বলেন, ‘তোমরা জ্ঞানার্জন করো। কেননা আল্লাহর উদ্দেশে জ্ঞানার্জনের অর্থ তাঁকে ভয় করা। জ্ঞান অন্বেষণ করা ইবাদতবিশেষ। জ্ঞানচর্চা করা হলো তসবি পাঠতুল্য। জ্ঞানের অনুসন্ধান করা সংগ্রাম-জিহাদের আওতাভুক্ত। অজ্ঞ ব্যক্তিকে জ্ঞান দেওয়া সদকা। উপযুক্ত ক্ষেত্রে তা ব্যয় করা আল্লাহর নৈকট্য লাভের কারণ। আর তা হালাল-হারাম জানার মানদণ্ড, একাকিত্বের বন্ধু, নিঃসঙ্গতার সঙ্গী, সুখ-দুঃখের সাথি, চরিত্রের সৌন্দর্য, অপরিচিতের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার মাধ্যম। আল্লাহ জ্ঞানের দ্বারা মানুষকে এমন মর্যাদাবান করেন, যা স্থায়ীভাবে তাকে অনুসরণীয় করে রাখে।’ (আখলাকুল উলামা : ৩৪-৩৫)
ইসলাম জাগতিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাও স্বীকার করে। পার্থিব জীবনযাত্রার প্রয়োজনীয় ও কল্যাণকর জ্ঞান অর্জন ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকেও কাম্য। বিধানগতভাবে জাগতিক জ্ঞান দুই প্রকার ১. যা চর্চা করা অপরিহার্য। ২. যা চর্চা করা নিষিদ্ধ। প্রথমটি হচ্ছে ওইসব জ্ঞান, যা জীবনযাপনের ক্ষেত্রে অপরিহার্য। যেমন চিকিৎসা, গণিত, কৃষি, রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি প্রভৃতি। প্রয়োজনীয় বিজ্ঞান, দর্শন ইত্যাদির মৌলিক পর্যায়ের জ্ঞানও অপরিহার্য। পুরো জনপদে যদি এসব জ্ঞানের পারদর্শী কেউ না থাকে, তা হলে সবাই কষ্টে পতিত হবে। পক্ষান্তরে দ্বিতীয়টি, যা মানুষকে অকল্যাণের দিকে নিয়ে যায়, তা চর্চা করা হারাম। যেমন ইসলামবিরোধী প্রাচীন ও আধুনিক দর্শন, কুফরি সাহিত্য ইত্যাদি। তদ্রুপ অকল্যাণকর ও অপ্রয়োজনীয় বিষয় চর্চা করাও নিষিদ্ধ। (ইহইয়াউ উলুমিদ দ্বীন : ১/২৯-৩০)
তবে জাগতিক জ্ঞান অর্জনেরও একটি বিশুদ্ধ ধর্মীয় দিক রয়েছে, সে ক্ষেত্রে তা দ্বীনি খেদমত হিসেবেই গণ্য হবে। যেমন বর্তমান বিজ্ঞান-প্রযুক্তির চরম উন্নতির যুগে মুসলমানদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে সর্বোচ্চ পারদর্শিতা অর্জন, দ্বীন প্রচারের জন্য কম্পিউটার শিক্ষা ও অন্যান্য অত্যাধুনিক মাধ্যমগুলোর জ্ঞান অর্জন ইত্যাদি দ্বীনি খেদমতের উদ্দেশ্যে হলে তা সম্পূর্ণরূপে ইসলামের খেদমত হিসেবে গণ্য হবে। পবিত্র কুরআনে মুসলমানদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ‘তোমরা তোমাদের সাধ্যমতো শক্তি অর্জন করো’ (সুরা আনফাল : ৬০)। অনুরূপ হালাল পন্থায় জীবিকা উপার্জন, মাতা-পিতা ও আত্মীয়স্বজনের খেদমত, পরিবার-পরিজনের হক আদায়, সমাজসেবা ইত্যাদি উদ্দেশ্যে জ্ঞান অর্জন করলে এতেও সওয়াব রয়েছে। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘হালাল রিজিক সন্ধান সব মুসলমানের ওপর ফরজ।’ (আল মুজামুল আওসাত : ৮৬১০)
ইসলামে সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ধর্মীয় শিক্ষা। ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করে অসংখ্য আয়াত-হাদিস বর্ণিত হয়েছে। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের ইলম দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদের মর্যাদা বহুগুণ বর্ধিত করেন’ (সুরা মুজাদালা : ১১)।
রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি সর্বোত্তম, যে কুরআন শিক্ষা করে এবং শিক্ষা দেয়’ (বুখারি : ৫০২৭)।
অন্যত্র তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি জ্ঞান অর্জনের জন্য কোনো পথ অবলম্বন করে, আল্লাহ তার জান্নাতের পথ সহজ করে দেন’ (মুসলিম : ২৬৯৯)।
আরেক হাদিসে আছে, ‘আল্লাহ তায়ালা যাকে প্রভূত কল্যাণ দিতে চান, তাকে দ্বীনের ক্ষেত্রে গভীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দান করেন’ (বুখারি : ৭১)।
রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন, ‘যে ইলম অনুসন্ধানে বের হয়, সে ফিরে আসা পর্যন্ত আল্লাহর রাস্তায় থাকে’ (তিরমিজি : ২৬৪৭)।
তবে দ্বীনি ইলমের ওই ফজিলত লাভের জন্য শর্ত হলো ‘ইখলাস’ তথা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ইলম অর্জন করা। পার্থিব কোনো উদ্দেশ্যে দ্বীনি ইলম অর্জন করা হলে তার পরিণাম হবে ভয়াবহ। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি দুনিয়াবি স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে এমন ইলম শিখল, যা কেবল আল্লাহর জন্যই শেখা হয়, সে কেয়ামতের দিন জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না।’ (আবু দাউদ : ৩৬৬৪)
সারকথা, ইসলামে দ্বীনি শিক্ষার যেমন গুরুত্ব রয়েছে, তেমনি রয়েছে জাগতিক শিক্ষার গুরুত্ব। পার্থিব প্রয়োজন পূরণ, সামাজিক ব্যবস্থাপনা ও ভারসাম্য ঠিক রাখার জন্য জাগতিক শিক্ষা অতীব জরুরি। উপরন্তু বহু দ্বীনি কাজের জন্যও জাগতিক শিক্ষার প্রয়োজন পড়ে। পক্ষান্তরে জীবনের সব কাজ ইসলামের বিধান মোতাবেক করার জন্য দ্বীনি শিক্ষার বিকল্প নেই। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে সমাজ যতই উন্নতি লাভ করুক, ঈমান ও খোদাভীতি না থাকলে নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানবিক সমাজ গঠন সম্ভব নয়।
তাই আমাদের জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞানার্জনের লক্ষ্য হওয়া উচিত ইহলৌকিক কল্যাণের পাশাপাশি পারলৌকিক কল্যাণ নিশ্চিত করা। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য অর্জিত জ্ঞানকে মানুষসহ আল্লাহর সব সৃষ্টির কল্যাণে ব্যবহার করতে হবে। সব ধরনের অকল্যাণ ও অশান্তির কাজে যাতে অর্জিত জ্ঞান ব্যবহৃত না হয়, সেদিকে আমাদের লক্ষ রাখা একান্ত প্রয়োজন। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে কল্যাণমুখী জ্ঞান অর্জন করে, অর্জিত জ্ঞান মোতাবেক আমল করার ও জীবন গড়ার তওফিক দান করুন।
Aminur / Aminur
দায়িত্বশীল মুমিনের মর্যাদা ও পুরস্কার
বিপদ-মসিবতে ভেঙে পড়বেন না
পুরুষের সতর কতটুকু
জ্ঞানচর্চায় মেলে পুণ্য ও সম্মান
পরামর্শ মাফিক কাজ করা সুন্নত
মানুষের আত্মার প্রকার
সুন্দর ব্যবহার মুমিনের ভূষণ
ইসলামি সংস্কৃতির ভিত্তি বিশ্বাস ও বিশ্বস্ততা
তিউনিসিয়ার ঐতিহ্যবাহী সাহাবা মসজিদ
স্ত্রী-সন্তানের জন্য খরচ করাও সদকা
ইবাদতের জন্য সময় বের করা
ইসলামে প্রশংসা-নিন্দার নীতি