ঢাকা শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৫

মানুষের হক নষ্ট করা পাপ


ডেস্ক রিপোর্ট  photo ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশিত: ১০-১২-২০২৫ দুপুর ১০:৫১

পৃথিবীতে মানুষকে পাঠানো হয়েছে কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য দিয়ে। সেই দায়িত্ব দুই ভাগে বিভক্ত-১. আল্লাহর প্রতি দায়িত্ব। ২. মানুষের প্রতি দায়িত্ব। আল্লাহর প্রতি যে দায়িত্ব রয়েছে সেগুলো হুকুকুল্লাহ বা আল্লাহর হক নামে পরিচিত। আর মানুষের প্রতি মানুষের যে দায়িত্ব সেগুলো হুকুকুল ইবাদ বা বান্দার হক নামে পরিচিত। যেসব আমলের সম্পর্ক সরাসরি আল্লাহর সঙ্গে সেগুলো আল্লাহর হক। যেমন-নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ইত্যাদি। নামাজ না পড়া মানে আল্লাহর হক আদায় না করা। জাকাত না দেওয়া মানে আল্লাহর হক আদায় না করা। আর যেসব কাজের সম্পর্ক সরাসরি আল্লাহর সঙ্গে নয়, বরং মানুষের সঙ্গে জড়িত সেগুলো মানুষের হক। যেমন কারও সম্পদ গ্রাস করা, কারও মনে আঘাত করা, কাউকে গালি দেওয়া, শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা, পাওনাদারের প্রাপ্য পরিশোধ না করা, জুলুম-অত্যাচার করা, মানুষ হত্যা করা, দুর্নীতি করা ইত্যাদি। 
হক নষ্ট করা পাপ
আল্লাহর হক নষ্ট করা এবং মানুষের হক নষ্ট করা উভয়ই মারাত্মক পাপ। কিন্তু পরিণতির দিক থেকে কখনো মানুষের হক নষ্ট করার পাপ বেশি জঘন্য হয়ে ওঠে। আল্লাহর হক নষ্ট করলে তওবা-ইস্তেগফারের মাধ্যমে তা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। কিন্তু মানুষের হক নষ্ট করলে শুধু তওবা-ইস্তেগফারের মাধ্যমে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। ধরুন, আপনি নামাজ পড়েননি। দীর্ঘদিন পর আপনার বোধোদয় হলো, আপনি নামাজ পড়তে শুরু করলেন। তা হলে অতীতের নামাজ ছাড়ার জন্য আপনি আল্লাহর দরবারে তওবার মাধ্যমে ক্ষমা লাভ করতে পারেন। কিন্তু আপনি যদি অন্য কারও সম্পদ অন্যায়ভাবে দখল করেন, তা হলে আল্লাহর কাছে যতই তওবা করেন আল্লাহ তা মাফ করবেন না, যতক্ষণ না সেই ব্যক্তির সম্পদ তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় অথবা তার কাছ থেকে মাফ নেওয়া না হয়। 
ব্যক্তির হক নষ্টের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুতর অন্যায় হলো রাষ্ট্রীয় সম্পদে দুর্নীতি করা, অন্যায়ভাবে ভোগদখল করা। কারণ রাষ্ট্রীয় সম্পদে দেশের প্রতিটি নাগরিকের হক বিদ্যমান থাকে। ব্যক্তির সম্পদ কুক্ষিগত করলে ব্যক্তিকে হক বুঝিয়ে দেওয়া বা ক্ষমা চাওয়া সম্ভব। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করলে দেশের কোটি কোটি নাগরিকের হক নষ্ট হয়। কোটি কোটি নাগরিকের প্রাপ্য বুঝিয়ে দেওয়া বা সবার কাছে ক্ষমা চাওয়া এবং সবার কাছ থেকে ক্ষমা পাওয়া অনেকটা অসম্ভব ব্যাপার। 
এ জন্য ‘হুকুকুল ইবাদ’ নষ্ট করা আল্লাহর হক নষ্টের চেয়ে বেশি মারাত্মক। অথচ বর্তমানে আমাদের অবস্থা সম্পূর্ণ উল্টো। আমরা আল্লাহর হক নষ্ট করাকে অন্যায় মনে করলেও মানুষের হক নষ্ট করাকে অন্যায় মনে করি না। প্রতিনিয়ত বেপরোয়াভাবে মানুষের হক নষ্ট করছি। মানুষকে হত্যা করছি। পরিবারের হক আদায় করি না। সন্তানের হক আদায় করি না। স্ত্রীর হক আদায় করি না। মা-বাবার প্রাপ্য দিই না। আত্মীয়স্বজনের হক আদায় করি না। অন্যের সম্পদ গ্রাস করি। ভাইবোনের সম্পর্ক নষ্ট করি। ভাই ভাইয়ের সম্পর্ক নষ্ট করছি। মানুষের সম্পদ মেরে দিচ্ছি! 
মানুষের হক আত্মসাৎকারীর পরিণতি
মানুষের হক আত্মসাৎকারীর হিসাব ও শাস্তি পরকালে সবচেয়ে ভয়াবহ হবে। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আখেরাতে মানুষের আমলনামা তিন প্রকার হবে-১. এক প্রকার আমলনামার প্রতি আল্লাহ ভ্রুক্ষেপ করবেন না। ২. এক প্রকার আমলনামায় বিন্দুমাত্র ছাড় দেবেন না। ৩. আরেক প্রকার আমলনামা ক্ষমা করবেন না। আল্লাহ যে আমলনামা ক্ষমা করবেন না সেটি হলো শিরকের পাপ। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে শিরক করে আল্লাহ তার ওপর জান্নাত হারাম করেছেন।’ যে আমলনামার প্রতি আল্লাহ ভ্রুক্ষেপ করবেন না, সেটি হলো আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে সংঘটিত পাপকর্ম। যেমন কোনো দিনের নামাজ ছেড়ে দেওয়া বা কোনো দিনের রোজা ছেড়ে দেওয়া। আল্লাহ ইচ্ছা করলে এগুলো ক্ষমা করে দেবেন। আর যে আমলনামায় বিন্দুমাত্র ছাড় দেবেন না সেটি হলো মানুষের পারস্পরিক জুলুমের গুনাহ। সেগুলোর প্রতিশোধ অবশ্যই নেওয়া হবে। (মুসনাদে আহমাদ : ৬/২৪০, ২৬০৩১)
যারা মানুষের ওপর অত্যাচার করে, পরের হক মেরে খায় তারা মূলত নিজের ওপর সীমাহীন জুলুম করছে। হাদিস শরিফে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের মালসামানা বা অন্য কোনো বস্তুর ক্ষেত্রে জুলুম করে, সে যেন আজই তার কাছ থেকে মাফ করিয়ে নেয়, সেদিন আসার আগে যেদিন তার কোনো দিনার বা দিরহাম থাকবে না। সেদিন তার কোনো সৎকর্ম থাকলে তার জুলুমের পরিমাণ তার কাছ থেকে নেওয়া হবে আর তার কোনো সৎকর্ম না থাকলে তার প্রতিপক্ষের পাপ তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে। (বুখারি : ২৪৪৯) 
অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে জিজ্ঞেস করলেন, অভাবী কে? তাঁরা বললেন, আমাদের মধ্যে যার দিরহাম ও সম্পদ নেই সেই অভাবী। নবীজি (সা.) বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে সেই অভাবী-যে নামাজ, রোজা ও জাকাতের পুণ্য নিয়ে হাশরের ময়দানে হাজির হবে। অথচ সে এ অবস্থায় আসবে যে, একে গালি দিয়েছে, একে অপবাদ দিয়েছে, এর সম্পদ ভোগ করেছে, একে হত্যা করেছে এবং একে মেরেছে। এরপর একে তার নেক আমল থেকে দেওয়া হবে। এরপর পাওনাদারের পাওনা শেষ হওয়ার আগেই যদি তার নেক আমল শেষ হয়ে গেলে তাদের পাপগুলো তার প্রতি নিক্ষেপ করা হবে। এরপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (মুসলিম : ২৫৮১) 
সুতরাং নেক আমল কম-বেশি যাই করি না কেন, মানুষের ওপর জুলুম করলে, তাদের হক নষ্ট করলে সব নেক আমল বিলীন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ জন্য আমাদের উচিত নেক আমলের পাল্লা ভারী করার পাশাপাশি মানুষের হক আদায়ে আরও বেশি সতর্ক হওয়া। কোনো অবস্থাতেই যেন আমরা অন্য মানুষের ওপর জুলুম না করি। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন। 

Aminur / Aminur