ঢাকা শনিবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৫

হাদিয়া বিনিময়ে ভালোবাসা বাড়ে


ডেস্ক রিপোর্ট  photo ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশিত: ১৭-১১-২০২৫ দুপুর ১০:৫৯

হাদিয়া বা উপহার এমন এক সুন্দর মানবিক আচরণ, যা কোনো আর্থিক বা বস্তুগত বিনিময় ছাড়াই অন্যের মালিকানায় হস্তান্তর করা হয়। এটি নিছক ভালোবাসা, সম্মান ও সৌজন্যের প্রকাশ। 
ইসলামি শরিয়তে এ ধরনের দান, অনুদান ও উপহারকে অত্যন্ত প্রশংসনীয় ও বরকতময় কাজ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। উপহার দেওয়ার মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে পারস্পরিক ভালোবাসা ও সৌহার্দ বৃদ্ধি পায়। সমাজে সহানুভূতির পরিবেশ সৃষ্টি হয় এবং মানুষ একে অপরের প্রতি আন্তরিকভাবে যত্নশীল হয়ে ওঠে। হাদিয়া কেবল বস্তুগত লেনদেন নয়; বরং এটি হৃদয়ের আন্তরিকতা, সৌজন্য ও সম্মানের বহিঃপ্রকাশ। 
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে দান, সহযোগিতা ও কল্যাণমূলক কাজের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘যারা নেক লোক, তারা সেই সব মানুষ; যারা আল্লাহর ভালোবাসার কারণে নিজেদের সম্পদ ব্যয় করে আত্মীয়স্বজন, এতিম, মিসকিন, মুসাফির, সাহায্যপ্রার্থী ও দাস-মুক্তির কাজে।’ (সুরা বাকারা : ১৭৭)
প্রকৃত নেককার ব্যক্তিরা শুধু নামাজ, রোজা বা ইবাদতেই সীমাবদ্ধ নয়; তারা তাদের সম্পদও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ব্যয় করে সমাজের অসহায় ও প্রয়োজনমতো মানুষকে সাহায্য করে। 
আরেক স্থানে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা নেকি ও তাকওয়ার কাজে একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতা করো’ (সুরা মায়েদা : ২)। এই নির্দেশনার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন যে, পারস্পরিক সহযোগিতা, সহানুভূতি ও কল্যাণের কাজে একে অপরের সহায়ক হওয়াই প্রকৃত ইসলামি ভ্রাতৃত্বের প্রতীক।
ফিকহের পরিভাষায় ‘হাদিয়া’ বলতে সেই সম্পদ বা বস্তুকে বোঝায়, যা কাউকে সম্মান ও শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে উপহার হিসেবে প্রদান করা হয়। এটি কোনো বাণিজ্যিক লেনদেন নয়, বরং আন্তরিক ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও সৌহার্দের বহিঃপ্রকাশ। আল্লামা ইবনে রুশদ (রহ.) বলেন, ‘হাদিয়া বলতে সেই জিনিসকে বোঝানো হয়, যা দাতা এমন ব্যক্তিকে দেয়, যাকে সে সম্মান ও মর্যাদার দৃষ্টিতে শ্রদ্ধা করে এবং তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা অর্জনের উদ্দেশ্যে তাকে উপহার প্রদান করে’ (আল-বায়ান ওয়াত তাহসিল : ১৭/৩৯৭)। শরিয়তে উপহার গ্রহণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, উপহারটি সৎ এবং ন্যায্য উদ্দেশ্য থেকে প্রেরিত হতে হবে। 
অর্থাৎ কোনো উপহার যদি এমন উদ্দেশ্যে দেওয়া হয় যা অন্যের অধিকার লঙ্ঘন করে, মানবাধিকারে ক্ষতি করে বা অনৈতিক ও অবৈধ কাজে সহায়তা করে, তা হলে তা গ্রহণ করা অনুমোদনযোগ্য নয়। উদাহরণস্বরূপ উপহার যদি কোনো উচ্চপদ, প্রশাসনিক দায়িত্ব বা ক্ষমতা অর্জনের জন্য দেওয়া হয়। 
যদি এটি অন্যকে প্ররোচিত করে বা প্রতিদ্বন্দ্বীর ওপর প্রভাব বিস্তার করতে ব্যবহার করা হয়। কিংবা যদি এটি ঘুষ বা অন্য কোনো অবৈধ উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়, তা হলে ওই উপহার গ্রহণ করা হারাম এবং তা বিশ্বাসঘাতকতার একটি রূপ হিসেবে গণ্য হবে। হজরত আবু সাঈদি (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) এক ব্যক্তিকে সদকা সংগ্রহের জন্য নিয়োগ দিয়েছিলেন। যখন তিনি ফিরে এলেন, তখন তিনি বললেন, ‘এটি সদকার সম্পদ আর এটি আমাকে উপহার হিসেবে দেওয়া হয়েছে।’
এ শুনে নবী (সা.) মিম্বরে আরোহণ করে আল্লাহর প্রশংসা ও মাহাত্ম্য ঘোষণা করলেন এবং বললেন : ‘যে কর্মকর্তাকে আমরা সদকা সংগ্রহের জন্য প্রেরণ করি, যদি সে এসে বলে যে ‘এটি সদকার সম্পদ আর এটি আমাকে উপহার হিসেবে দেওয়া হয়েছে’, তার অবস্থা কী হবে? কেন সে শুধু নিজের পিতা-মাতার ঘরে বসে থেকে দেখল না যে, তার কাছে কোনো উপহার আসে কি না?’ 
তিনি আরও বললেন : ‘যে সত্তার হাতে আমার প্রাণ! যা কিছুই সে (অবৈধভাবে) গ্রহণ করবে, কেয়ামতের দিন তা কাঁধে বহন করে নিয়ে উপস্থিত হবে। যদি উট হয়, তা হলে তা চিৎকার করবে, যদি গাভি হয় তা হলে তা হাম্বা হাম্বা করবে, অথবা যদি বকরি হয় তা হলে তা ভ্যা ভ্যা করবে। তারপর তিনি উভয় হাত উঠালেন। 
এমনকি আমরা তার উভয় বগলের শুভ্র ঔজ্জ্বল্য দেখতে পেলাম। তারপর বললেন শোনো! আমি কি আল্লাহর কথা পৌঁছে দিয়েছি? এ কথাটি তিনি তিনবার বললেন’ (সহিহ বুখারি : ৭১৭৪)। ইমাম নববি (রহ.) তার মুসলিম শরিফের শারহে বলেছেন, এই হাদিসে স্পষ্টভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের দেওয়া হাদিয়া বা উপহার গ্রহণ করা হারাম এবং এটি বিশ্বাসঘাতকতার অন্তর্ভুক্ত, কারণ এতে সে নিজের দায়িত্ব ও আমানতে খেয়ানত করে।
হারাম উপার্জনকারীর হাদিয়া গ্রহণের ব্যাপারে ইসলামের বিধান হচ্ছে, যদি কোনো ব্যক্তির সব উপার্জন বা অধিকাংশ আয় হারাম হয়, তা হলে তার দেওয়া হাদিয়া গ্রহণ করা জায়েজ নয়। যদি সে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় যে, ‘এই হাদিয়া আমার হালাল উপার্জন থেকে দেওয়া, তা হলে তা গ্রহণ করার সুযোগ রয়েছে। 
একইভাবে যদি কারও উপার্জনের অধিকাংশ অংশ হালাল হয় এবং বাকি অংশ হারাম হয়, তা হলে তার দেওয়া হাদিয়া গ্রহণ করা যায়। কিন্তু এর থেকে বিরত থাকাই উত্তম। (ফাতাওয়ায়ে আলমগিরি : ৫/৩৪২)

Aminur / Aminur