ঢাকা বুধবার, ২৭ আগস্ট, ২০২৫

৩ নভেম্বর ৭৫, বাংগালী জাতির দ্বিতীয় কলংকিত অধ্যায়


জিয়াউদ্দিন লিটন photo জিয়াউদ্দিন লিটন
প্রকাশিত: ২-১১-২০২১ দুপুর ২:১৬
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী চার জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম. মনসুর আলী ও এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামানের নির্মম হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়। মানবতা লংঘনকারী ঐ নির্মম হত্যাকান্ডগুলো এমন এক সময়ের ইতিহাস যাকে দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে বস্তুনিষ্ঠভাবে গবেষণা এবং বিশ্লেষন না করা ও তার থেকে শিক্ষা না নেবার বিষয়টিও ছিল অন্যতম এক কারণ, যে জন্যে আমরা আজও সত্যিকারের এক সভ্য রাষ্ট্ররুপে পরিগণিত হতে পারিনি। যে কারণে আজও বাংলাদেশ লাভ করেনি মানসিক স্বস্তি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। এই বিষয়গুলো নিয়ে নির্মোহভাবে ও যুক্তি তথ্যের আলোকে মৌলিক গবেষণা আমাদের দেশে খুব কমই হয়েছে। আজকের প্রজন্ম যারা সেই সময়টি সম্বন্ধে জানে না বা তাদেরকে আমরা সঠিকভাবে জানাতে ব্যর্থ হয়েছি বিশেষত তাদের জন্যই সেই ইতিহাসের অতি সংক্ষিপ্ত এই বর্ণনা তুলে ধরা হল।
আজ বুধবার (৩ নভেম্বর) জেলহত্যা দিবস। পচাঁত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর  রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর দ্বিতীয় কলঙ্কজনক অধ্যায় এই দিনটি। জেল হত্যা দিবস আওয়ামী লীগসহ বাংলাদেশের বেশ কিছু রাজনৈতিক দল কর্তৃক প্রতি বছর ৩রা নভেম্বর পালিত হয়। ১৯৭৫ সালের এই দিনে আওয়ামী লীগের চারজন জাতীয় নেতাঃ সাবেক উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সাবেক বাংলাদেশী ধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামারুজ্জামান হত্যাকাণ্ডের স্মৃতি স্মরণার্থে এ দিবস পালন করা হয়। ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর তিন মাসেরও কম সময়ের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বীর সেনানী ও চার জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, এএইচএম কামারুজ্জামান এবং ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে এই দিনে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।জাতি বুধবার (৩ নভেম্বর) মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম  বীর সেনানী ও চার জাতীয় নেতাকে যথাযথ শ্রদ্ধা প্রদর্শনের মাধ্যমে দেশের ইতিহাসের অন্যতম বর্বরোচিত এই কালো অধ্যায়টিকে স্মরণ করবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে এবং আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠনের উদ্যোগে সারাদেশে পালিত হবে শোকাবহ এই দিবস। 
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সৈয়দ ফারুক রহমানের নেতৃত্বে কতিপয় অসন্তুষ্ট ও উচ্চাভিলাষী জুনিয়র অফিসারদের সংঘটিত অভ্যুত্থানে নিহত হন। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি ও মুজিবনগর সরকার প্রধান (বাংলাদেশী প্রবাসী সরকার) ছিলেন। ১৯৭২ সালে জাতীয় রক্ষীবাহিনী প্রতিষ্ঠা, ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ও ৭ জুন ১৯৭৫ বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) প্রতিষ্ঠা করে একদলীয় গণতন্ত্র প্রথা চালু করেন। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণের প্রতি সেভাবে গুরুত্ব দেয় নি। পাকিস্তান ফেরত সামরিক অফিসারদের প্রতি বৈরী মনোভাব ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত অফিসারদের দ্রুত পদোন্নতি, প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় – বরাদ্দের পরিমাণ ক্রামান্বয়ে হ্রাসকরণ এবং সামরিক বাহুনীর সমান্তরাল রক্ষীবাহিনী তৈরী ও এর দ্রুত উন্নয়ন এবং এর উপর সরকারের নির্ভরশীলতা সামরিক বাহিনীর লোকদের মধ্যে অত্যন্ত স্বাভাবিক কারণেই প্রচন্ড ক্ষোভের সঞ্চার করে। তাই ক্ষমতাসীন সরকারের দলীয় লোকদের সীমাহীন লোভ ও দুর্নীতির প্রেক্ষাপটে মুজিব সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাসের সুযোগে সেনাবাহিনীর কতিপয় বিপদগামী অফিসার ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট রাতে শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে। 
৭৫’ এর ১৫ই আগষ্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার  পর বাংলাদেশকে পুরোপুরি নেতৃত্ব শূন্য করার পরিকল্পনা নেয় ঘাতকরা৷  আর তাই ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর কারাগারের অভ্যন্তরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় জাতীয় ৪ নেতাকে৷আগষ্টেই জাতীয় ৪ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ. ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে আটক করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নেয়া হয়৷ ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর কারাগারের অভ্যন্তরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় জাতীয় ৪ নেতাকে৷ তখন কারগারের জেলার ছিলেন আমিনুর রহমান ৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে জানান, সেই নির্মম হত্যাকান্ডের কথা৷ 
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের তৎকালীন জেলার আমিনুর রহমান বিবিসির সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, রাত একটা থেকে দেড়টার দিকে একটি পিকআপে করে কিছু সেনাসদস্য জেলগেটে উপস্থিত হন। এসময় আইজি প্রিজনের ফোন পেয়ে তিনিও সেখানে যান। এর কিছুক্ষণ পর তার কার্যালয়ের টেলিফোনটি বেজে ওঠে। "টেলিফোন ধরলেই বললো যে প্রেসিডেন্ট কথা বলবে আইজি সাহেবের সাথে। কথা শেষ করার পরই আইজি সাহেব বললেন যে প্রেসিডেন্ট ফোন করেছিলো। বললো যে আর্মি অফিসাররা যা চায় সেটা তোমরা করো"।এরপর কারা মহাপরিদর্শক আমিনুর রহমানের হাতে চারজনের নাম লেখা একটি চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে বলেন এদেরকে এক জায়গায় করো।"সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং তাজউদ্দীন সাহেব ছিলেন এক রুমে আর অন্য দুজন ছিলেন অন্য রুমে। তো অন্য রুম খুলে আনলাম"।"আমি ভাবলাম কথাবার্তা বলবে তো পরিচয় করিয়ে দিই। মনসুর আলী সাহেব ছিলেন সর্বদক্ষিণে। তাকে পরিচয় করানোর জন্য মাত্র ম.. বলা শুরু করার সাথে সাথেই গুলি করে দিলো । গুলি করেই তারা খোলা গেট দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেলো"। সাখাওয়াত হোসেন বলছিলেন ঐ জেলহত্যার ঘটনাটি তাৎক্ষনিকভাবে জানাজানি হয়নি। ঘটনাটি সেনা অফিসারদের কাছে পৌঁছে ৪ঠা নভেম্বর সকালের দিকে। ৩রা নভেম্বরের পরের কয়েকটি দিন কার্যকর দেখা যায় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদের গণবাহিনীকে। কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বাধীন এই গণবাহিনী পরবর্তী অভ্যুত্থানে একটি মূল ভূমিকা পালন করে। 
কারগারের জেলার আমিনুর রহমান বলেন, তখনকার আইজি প্রিজন নুরুজ্জামান ৫ জন সেনা কর্মকর্তাকে সাথে নিয়ে সেই রাতে কারাগারে প্রবেশ করেন৷ এরপর টেলিফোনে খন্দকার মোশতাক ৪ নেতার নাম জানিয়ে দেন৷ তাদের নিউ সেলে জড়ো করে ঘাতকরা ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে৷ হত্যাকান্ডের ২ দিন পর পরিবারের সদস্যদের কাছে জাতীয় নেতাদের লাশ হস্তান্তর করা হয়৷ কিন্তু তা ছিল সেনা পাহারায়৷ তার আগে কারাগারের ভেতরে লাশের ময়না তদন্ত হয়৷ তবে তখনকার ডিআইজি প্রিজন কাজী আবদুল আউয়াল ৩রা নভেম্বরেই লালবাগ থানায় অনেকটা গোপনে হত্যা মামলা দায়ের করেছিলেন৷ খন্দকার মোশতাক আহমেদ শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রীসভার বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর তিনি ১৫ই আগস্ট অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত অফিসারদের সমর্থন করেন এবং নিজেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন।  
ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন বাঙালি অফিসার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই তিনি মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করেন। তিনি মুজিবনগর সরকার কর্তৃক মুক্তিবাহিনীর ২ নং সেক্টর কমাণ্ডার হিসেবে নিযুক্ত হন। যুদ্ধে তিনি মাথায় বুলেটের আঘাত পান এবং ভারতের লখনউতে চিকিৎসা নেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বীর উত্তম উপাধিতে ভূষিত হন। ১৯৭৫ সালে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চীফ অফ জেনারেল স্টাফের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ শেখ মুজিবুর রহমানের খুনিচক্রকে ক্ষমতার আসন থেকে উৎখাত করার জন্য একটি রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত করেন।  
জেলহত্যার প্রায় ২৯ বছর পর এর বিচারকার্য শুরু হয়। ২০০৪ সালের ২০শে অক্টোবর তিনজন পলাতক সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদণ্ড, এবং ১২  জন সেনা কর্মকর্তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দেওয়া হয়। বিএনপির চারজন সিনিয়র নেতাসহ পাঁচজনকে খালাস দেওয়া হয়। ২০০৮ সালের ২৮শে আগস্ট বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ জেলহত্যা মামলায় অভিযুক্ত ছয়জন সামরিক কর্মকর্তাকে খালাস দেয়। খালাসীদের মধ্যে সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, বজলুল হুদা এবং এ কে এম মহিউদ্দীন আহমেদকে ২০১০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

এমএসএম / এমএসএম

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার গণতন্ত্রের জন্য চ্যালেঞ্জ

কোচিং-এর গোলকধাঁধায়, শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে গুরুত্ব নেই

সাংবাদিকের দল সমর্থন গণতন্ত্রের জন্য হুমকি

ইঁদুরের কৃতজ্ঞতা

নাগরিক সেবা ও প্রত্যাশার সংকট: রাষ্ট্রীয় কর্মচারী কোথায়?

টেকসই সমাজ গঠনে সাম্য একটি অপরিহার্য ভিত্তি

শুভ জন্মাষ্টমী : সত্য, সুন্দর ও সাম্য প্রতিষ্ঠায় শান্তির বার্তা

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অপরিহার্য

জনগণের অংশগ্রহণে নির্বাচিতরাই কাশ্মীরের শাসক

স্বৈরশাসকের বিদায়, বিদ্রোহ ও পলায়ন

জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় তারেক রহমান

এপিআই ও এক্সিপিয়েন্ট উৎপাদনে বাংলাদেশের আত্মনির্ভরশীলতা: স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির নবদিগন্ত উন্মোচন

ট্রাম্প-উরসুলার বাণিজ্য চুক্তিতে স্বস্তির হাওয়া