ঢাকা বুধবার, ২৭ আগস্ট, ২০২৫

বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তীর শুভলগ্নে বাংলাদেশ


জিয়াউদ্দিন লিটন photo জিয়াউদ্দিন লিটন
প্রকাশিত: ১৫-১২-২০২১ দুপুর ২:৩৬

 ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস। বাঙালি জাতির ইতিহাসে সর্বোচ্চ অর্জনের ও আত্মগৌরবের একটি দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে মহান মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি বিজয় ছিনিয়ে আনে। বাঙালি জাতির ইতিহাস হাজার বছরের পরাধীনতার ইতিহাস। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ পাকিস্তান থেকে স্বাধীন দেশ হিসাবে ঘোষণা করে বাংলাদেশ। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হয়। ২৫শে মার্চ রাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পুলিশ, সামরিক বাহিনী ও সাধারণ জনগণের ওপর হামলা শুরু করে পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করে বাংলাদেশ। প্রবাসী মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয়। বাঙ্গালী জনতা ভারতের সহযোগিতায় মুক্তিবাহিনী গঠন করে তাদের প্রতিরোধ করতে শুরু করে। পরবর্তীতে ভারত এই যুদ্ধে অংশ নিলে দুই বাহিনী মিলে যৌথ বাহিনী গঠিত হয়। সেই মুক্তিযুদ্ধে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী প্রায় ৯৩ হাজার সৈন্য বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ও ভারতের সামরিক বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর কোন যুদ্ধে এতো বড় বাহিনী আত্মসমর্পণ করেনি। স্বাধীন দেশ হিসাবে জাতিসংঘের সদস্য রয়েছে ১৯৩টি দেশ। আরো দুইটি দেশ রয়েছে পর্যবেক্ষক সদস্য হিসাবে। পৃথিবীর অনেক দেশ বরাবরই স্বাধীন দেশ হিসাবে থেকেছে। আবার অনেক দেশ পরাধীনতা থেকে বা কলোনি থেকে আন্দোলন  সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। কোন কোন দেশ আলোচনার মাধ্যমে, আবার কোন কোন দেশ বিপক্ষ শক্তিকে হারিয়ে বিজয়ী হয়েছে সে আলোচনা করতে গেলে অনেক সময় লেগে যাবে। তবে এটা সত্য যে,বাংলাদেশের মতো খুব কম দেশই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে শত্রুকে পরাজিত করে বিজয় অর্জন করেছে। আরো কিছু  দেশ যেমন আমেরিকা, উত্তর আমেরিকা, ইরিত্রিয়া, চিলি,বেলজিয়াম, হাইতি, আলজেরিয়া রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বিপক্ষ শক্তিকে পরাজিত করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। তবে তাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিলো অনেক দীর্ঘদিনের।  

 দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম এবং আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের হাত থেকে ভারতীয় উপমহাদেশ স্বাধীন হলেও এই ভুখণ্ডের বাঙালির স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আসেনি। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভক্ত হয় এবং পূর্ব বাংলাকে নিয়ে পাকিস্তান নামে একটি অসম রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। তখন থেকেই পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী বাঙালির ওপর চেপে বসে এবং শাসন, শোষণ ও নির্যাতনের স্টিম রোলার চালায়। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জাতি ১৯৭১ সালে উপনীত হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আধুনিক অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বাঙালি জাতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। এরই প্রেক্ষাপটে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। শুরু হয় রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে গিয়ে বন্দি করে রাখা হয়।

 বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতেই তাকে রাষ্ট্রপতি করে গঠিত বাংলাদেশের সরকারের অধীনে পরিচালিত দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। এই বিজয় অর্জনে মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান আর দুই লাখ মা-বোনের ত্যাগ-তিতিক্ষায় এই বিজয় অর্জিত হয়। কোটি বাঙালির আত্মনিবেদন ও গৌরবগাঁথা গণবীরত্বে পরাধীনতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পায় বাঙালি জাতি। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিকে মুক্তির আকাঙ্খায় উজ্জীবিত করে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের পথে এগিয়ে নিয়ে যান। ’৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়লাভ, ’৫৬-এর সংবিধান প্রণয়নের আন্দোলন, ’৫৮-এর মার্শাল ’ল বিরোধী আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলন, ’৬৬-এর বাঙালির মুক্তির সনদ ৬-দফার আন্দোলন, ৬৮-এর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ’৬৯-এর রক্তঝরা গণঅভ্যুত্থান, ৬-দফা ভিত্তিক ’৭০-এর ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন মুক্তিযুদ্ধকে অবধারিত করে তোলে। এই সব আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এর পর ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”…………... “যার কাছে যা    কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে” খ্যাত কালজয়ী ভাষণ ও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতিকে চূড়ান্তভাবে উদ্বুদ্ধ করে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন প্রভূত ঘটনা প্রবাহের মধ্য স্বাধীনতা অর্জনের চূড়ান্ত লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওঠে বাঙালি জাতি। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দিলে তার ডাকে সাড়া দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালি জাতি। বাঙালির এই মুক্তিযুদ্ধে পাশে দাঁড়ায় প্রতিবেশী দেশ ভারত, সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রগতিশীল রাষ্ট্রের সরকার ও মুক্তিকামী মানুষ। তবে কোনো কোনো পরাশক্তি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি বিরুদ্ধে নামে এবং পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে সব ধরণের সহযোগিতা দেয়। শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে মুক্তিযুদ্ধে দোর্দণ্ড গতিতে এগিয়ে যায় বাঙালি। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধ শেষে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী ১৬ ডিসেম্বর যৌথবাহিনীর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। এর মধ্য দিয়ে বাঙালির চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে (এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী । সারা দেশে উড়েছিল বিজয়ের পতাকা৷ এসেছে বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের মাহেন্দ্রক্ষণ৷ নয় মাসের যুদ্ধে বিজয় ছিনিয়ে আনতে অনেক হারাতে হয়েছিল বাংলাদেশকে৷ লাখো শহিদের রক্ত কি বৃথা গেছে? নাকি যে আকাঙ্খা নিয়ে অস্ত্র হাতে নিয়েছিল লাখো মানুষ, তাদের সব আকাঙ্খা পূরণ হয়েছে? এক কথায় কোনো প্রশ্নের উত্তরই দেয়া সম্ভব নয়৷ বিজয়ের চার বছর পূর্তির আগেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্য এবং চার জাতীয় নেতাকে হত্যার মাধ্যমে দেশের রাজনীতিতে যে ঘনঘোর লেগেছিল, সেই ঘনঘোর বিজয়ের পঞ্চাশ বছরেও কাটেনি ৷ বরং যে দেশের মানুষ বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সামনে রেখে শুরু করা স্বাধিকারের আন্দোলনকে স্বাধীনতায় রূপ দিয়েছিল, সে দেশের মানুষের মাঝে বপন করা হয়েছে ‘বাঙালি না বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ'-এর দ্বন্দ্ব৷ বিশ্বের প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জনসংখ্যা বিবেচনায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের দেশ ভারতসহ আরো কিছু দেশের মতো বাংলাদেশও স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর সাংবিধানিকভাবেও ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হয়েছে ৷ তবে ক্ষমতার পালাবদলে শাসকের ইচ্ছাপূরণের রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতার পাশে মানুষকে ধোঁকা দিয়ে রাষ্ট্রধর্মও যোগ হয়েছে সংবিধানে ৷ খুঁজলে আরো  বিতর্ক, আরো বৈপরিত্যের উল্লেখ করা যাবে, যেগুলো '৭১-এর শহিদ, মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিকামী সাধারণ মানুষদের স্বপ্নে ছিল না ৷ সেখানে উদার গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা নিশ্চয়ই আসবে। অবাধ ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমেই কেবল তা সম্ভব  হতে পারে ৷ এছাড়া '৫২-র ভাষা আন্দোলন এবং '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যোগফলে ভাষা এবং সংস্কৃতিকে সব জায়গায় অগ্রাধিকার দেয়ায় সাফল্য-ব্যর্থতার প্রসঙ্গটিও খুব বড় হয়ে উঠবে অবশ্যই ৷ এসব অপ্রাপ্তিকে সাথে নিয়েই করোনাকালে বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তীর শুভলগ্নে বাংলাদেশ ৷ এ দেশে বিশ্বব্যাংক তাকিয়ে দেখে পদ্মা সেতু ৷ দুর্নীতির ধারাবাহিকতা বা আরো বাড়বাড়ন্তের মাঝেও একটি বিষয়ে অন্তত খুব গর্ব করতে পারে বাংলাদেশ- অর্থনীতির অনেক সূচকে '৭১-এর শত্রুপক্ষ পাকিস্তানের চেয়ে তো বটেই, এমনকি ‘মিত্র' ভারতের চেয়েও অনেক এগিয়ে বাংলাদেশ ৷ এ দিবসটি বাঙালির বিজয় দিবস ও বাংলাদেশের জাতীয় দিবস। দিনটি সরকারি বেসরকারি ও বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে উদযাপন করছে।   

 

লেখকঃ

শিক্ষক, সাংবাদিক এবং কলামিস্ট

এমএসএম / এমএসএম

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার গণতন্ত্রের জন্য চ্যালেঞ্জ

কোচিং-এর গোলকধাঁধায়, শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে গুরুত্ব নেই

সাংবাদিকের দল সমর্থন গণতন্ত্রের জন্য হুমকি

ইঁদুরের কৃতজ্ঞতা

নাগরিক সেবা ও প্রত্যাশার সংকট: রাষ্ট্রীয় কর্মচারী কোথায়?

টেকসই সমাজ গঠনে সাম্য একটি অপরিহার্য ভিত্তি

শুভ জন্মাষ্টমী : সত্য, সুন্দর ও সাম্য প্রতিষ্ঠায় শান্তির বার্তা

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অপরিহার্য

জনগণের অংশগ্রহণে নির্বাচিতরাই কাশ্মীরের শাসক

স্বৈরশাসকের বিদায়, বিদ্রোহ ও পলায়ন

জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় তারেক রহমান

এপিআই ও এক্সিপিয়েন্ট উৎপাদনে বাংলাদেশের আত্মনির্ভরশীলতা: স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির নবদিগন্ত উন্মোচন

ট্রাম্প-উরসুলার বাণিজ্য চুক্তিতে স্বস্তির হাওয়া