ঢাকা বুধবার, ২৭ আগস্ট, ২০২৫

১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও বাংলাদেশ


কর্নেল (অব.) কাজী শরীফ উদ্দিন photo কর্নেল (অব.) কাজী শরীফ উদ্দিন
প্রকাশিত: ২৪-১-২০২২ দুপুর ৩:১১

১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি। সেদিন ছিল হরতাল। এই দিনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুব খান সরকার বিরোধী আন্দোলন রূপ নেয় তীব্র এক গণঅভ্যূত্থানে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠন ও স্বাধীনতা যুদ্ধে ইতিহাসে একে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করা হয় এই গণআন্দোলনকে।পাকিস্তানি শাসকেরা একে নস্যাৎ করতে আগরতলা মামলা করে। মামলার প্রধান আসামি শেখ মুজিবসহ অন্যান্যদের মুক্তি ও পাকিস্তানি সামরিক শাসন উৎখাতের দাবিতে ১৯৬৯ সালের ২৪শে জানুয়ারি সান্ধ্যআইন ভঙ্গ করে সাধারণ মানুষ মিছিল বের করে।

সেই মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণে প্রাণ হারান কিশোর মতিউর রহমান মল্লিকসহ চারজন। সময়টা ছিল এমন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে তখন বন্দী। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনির মৃত্যুর দিন গুনছেন। স্বৈরশাসক আইয়ুব খান সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ফাঁসি দেবেন।"

সে কারণে শেখ মুজিবকে ১৯৬৮ সালের ১৭ই জানুয়ারি কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে জেলগেটে আনার পর আবার গ্রেপ্তার করে 'আগরতলা ষড়যন্ত্র' মামলার আসামী হিসেবে ক্যান্টনমেন্টে বন্দী করা হয়। এই মামলার প্রকৃত নাম ছিল "রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান"। উদ্দেশ্য ছিল বাঙ্গালি জাতির কণ্ঠ স্তব্ধ করা । তবে পরের বছর জানুয়ারির চিত্র আমূল পাল্টে যায়।

৪ঠা জানুয়ারি কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এরপর ১০জন ছাত্র নেতার সমন্বয়ে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে আন্দোলন সংগঠিত করা হয়। ঊনসত্তরের ১৭ই জানুয়ারি

১৪৪ ধারা ভাঙ্গার ঘোষণা দেয়া হয়  এর প্রতিবাদে ১৮ই জানুয়ারি কর্মসূচি দেয়া হয়। হামলা চালানো হয়েছিল ওই কর্মসূচিতে। প্রতিবাদে ২০শে জানুয়ারি মিছিল বের করা হলে গুলিতে মারা যান ছাত্রনেতা আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন তিনি। আসাদের মৃত্যুর ঘটনাকে ঘিরে বেগবান হয়ে ওঠে আন্দোলন।  তার  মৃত্যুর প্রতিবাদে পরদিন আবার কলাভবনে কর্মসূচি দেয়া হয়। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হতে-তথা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা এসে যোগ দেয়। বাদ পড়েননি শ্রমিকরাও।

ছাত্রনেতারা শহীদ আসাদের গায়ের রক্ত মাখা জামা দিয়ে পতাকা তৈরি করে,  শহীদ মিনারে  তার  লাশ শুয়ে স্পর্শ করে শপথ নেয় আন্দোলনের, শপথ নেয় প্রতিবাদের, গর্জে ওঠে এক ঝাঁক কিশোর-তরুণ প্রাণ, জীবনের মায়া যাদের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্থ করতে পারে নাই।

‘আসাদ তোমার রক্ত বৃথা যেতে দেবো না।’ ২১ জানুয়ারি পল্টনে ২২ থেকে ২৪শে জানুয়ারি পর্যন্ত পরবর্তী তিনদিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। সেদিন সেখানে মাওলানা ভাসানীও ছিলেন, ছিলেন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। ২২ শে জানুয়ারি প্রত্যেকটা বাড়িতে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়।

২৩ তারিখ সন্ধ্যার পর হয় মশাল মিছিল। তৎকালীন আজাদ পত্রিকায় যার শিরোনাম হয়েছিল 'স্মরণকালের বৃহত্তম মশাল মিছিল'। এরপর ২৪শে জানুয়ারি হরতাল পালিত হয়। পল্টনে লক্ষ লক্ষ লোক জমায়েত হয়  ।

‘ঢাকা শহরের সমস্ত মানুষ রাজপথে নেমে এলো। আগুন জ্বলছে। মানুষের স্রোত পল্টনের দিকে। এই যে মতিউর, মকবুল, রুস্তম ও আলমগীর - এই চারজনকে গুলি করে হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে মানুষ রাজপথে নেমে এলো। আগরতলা মামলার সাক্ষী, তৎকালীন মন্ত্রী, এমনকি বিচারপতির বাড়িতেও মানুষ আগুন লাগিয়ে দেয়,এ যেন এক অন্যরকম প্রতিজ্ঞা দৃঢ় প্রত্যয় ইস্পাতকঠিন মনি মনোবল নিয়ে বীরদর্পে সামনে এগিয়ে যাওয়া, বিজয়ের প্রত্যাশা I ছাত্রনেতারা ভাবতে শুরু করে যে এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।’

"তখন প্রথম পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপ এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া গ্রুপ এবং ডাকসুর ভিপি বর্তমান বর্ষীয়ান রাজনীতিক তোফায়েল আহমেদ এবং জিএস নাজিম কামরান চৌধুরী ১১ দফা কর্মসূচি প্রণয়ন  করে এবং পরে জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন-এর একটি অংশ এসে যোগ দেয়"

মাহ্বুব উল্লাহ ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক।তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ছিলেন ,তিনি  ২৪শে জানুয়ারির দিনটির স্মৃতিচারণ থেকে   জানান,"১৯৬৮ সালে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ৫ই ডিসেম্বর পরের দিন হরতালের ডাক দেন এবং তা পালিত হয়। সেখানে দু'জন নিহত হন।"

"পরদিন সাত তারিখেও হরতাল পালিত হয়। পরবর্তী ২৯শে ডিসেম্বর সারাদেশে হাট-হরতাল পালনের আহ্বান জানান মওলানা ভাসানী। এখান থেকে মানুষ আন্দোলনের উদ্দীপনা পায়। পরবর্তীতে ১১ দফা কর্মসূচি আসে ছাত্রসমাজ থেকে, যার মূল বিষয় ছিল পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন।"

মাহ্বুব উল্লাহ জানান, "এরপর ১৭ই জানুয়ারি থেকে আন্দোলনের সূচনা। ২০শে জানুয়ারি আসাদ শহীদ হলেন। এরপর ২৪শে জানুয়ারি আরেকটি হরতালের ডাক দেয়া হয়।"

"সে ছিল এক বিশাল গণ-অভ্যুত্থান। যখন আমরা পল্টন ময়দানে জড়ো হলাম আমাদের সামনে পাঁচ লক্ষ লোকের বিশাল সমাবেশ। জনগণের মধ্যে প্রচণ্ড আক্রোশ এবং ক্রোধ কাজ করছিল।"

"তারা তৎকালীন গভর্নর হাউজে (বর্তমান বঙ্গভবন) হামলা করতে চাইছিল। কিন্তু এটা হবে হঠকারী এবং বহু মানুষের প্রাণ হারাবে সেই চিন্তা করে আমরা সেখানে শহীদ মতিউরের জানাযা আদায় করে মিছিল নিয়ে তৎকালীন ইকবাল হলের দিকে চলে গেলাম," বলছিলেন মাহ্বুব উল্লাহ। তিনি বলেন, "ছাত্র সমাজ, মেহনতি জনতা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের একতার বাতাবরণ সৃষ্টি হয় এই আন্দোলনকে ঘিরে।"

"আন্দোলন তখন রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।"

বর্ষীয়ান রাজনীতিক তোফায়েল আহমেদ ২৪শে জানুয়ারি দিনটির স্মৃতিচারণ থেকে       বলেন, ২৪শে জানুয়ারি নিহত হওয়া নবকুমার ইন্সটিটিউটের ছাত্র কিশোর মতিউর রহমান এর আগে পল্টনে গায়েবানা জানাযাতে অংশ নিয়েছিল। সেই মতিউরকে তার বাবা আন্দোলন থেকে আটকে রাখতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।

মৃত কিশোর মতিউরের পকেটে হাত দিয়ে পরে একটি চিরকুট পাওয়া গেল, যেখানে লেখা ছিল - "মা আমি মিছিলে যাচ্ছি, যদি ফিরে না আসি তাহলে মনে করো, তোমার মতিউর বাংলার মানুষের জন্য, শেখ মুজিবের জন্য জীবন দিয়ে গেল, ইতি মতিউর রহমান।"

বিরবিসি বাংলা

আজকের বঙ্গভবন তখন পরিচিত ছিল গভর্নর হাউজ হিসেবে। সেখানেও আক্রমণ করতে উদ্যত হয়েছিল উত্তেজিত জনতা। তোফায়েল আহমেদ বলেন, এরপর মিছিল নিয়ে শৃঙ্খলার সাথে ইকবাল হল (বর্তমান শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) মাঠে জড়ো হই। সেদিনই সান্ধ্যআইন (কারফিউ) জারি করে দেয়া হয়। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতেই আইয়ুব খান ঘোষণা করেন তিনি আর প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করবেন না।

এর মাঝে ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীতে ডক্টর শামসুজ্জোহাকে হত্যা করা হয় এবং কারফিউ জারি করা হয়। ২০ তারিখে কারফিউ ভঙ্গ করে মশাল মিছিল করা হয় এবং ২১ তারিখ ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেওয়া হয় শেখ মুজিবকে মুক্তি দেয়ার দাবি জানিয়ে। এই আন্দোলনের জেরে আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের ঘোষণা আসে এবং ২২শে ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবসহ মামলার অভিযুক্তদের মুক্তি দেয়া হয়। এখন যেটি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নামে পরিচিত, সেখানে ২৩শে ফেব্রুয়ারি তাকে সম্বর্ধনা দেয়া হয় এবং ভূষিত করা হয় বঙ্গবন্ধু উপাধিতে।

সেখানেই সেদিন শেখ মুজিব জানান, তিনি পাকিস্তান সরকারের কাছে এগারো দফা দাবি তুলে ধরবেন।

তোফায়েল আহমেদ এর ভাষায়, "বঙ্গবন্ধু তো বাংলাদেশের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন, তিনি যদি ছয় দফা না দিতেন আগরতলা মামলা হতো না, এই মামলা না দিলে গণঅভ্যুত্থান হতো না, এই গণঅভ্যুত্থান না হলে তাকে কারাগার থেকে মুক্ত করতে পারতাম না, আর তিনি মুক্তি না পেলে সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী হতাম না।"

"আর তিনি যদি নির্বাচনে বিজয়ী না হতেন, তাহলে আমরা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা লাভ করতে পারতাম না," এভাবেই মি. আহমেদ ব্যাখ্যা করেন ঘটনাক্রমকে।মাহ্‌বুব উল্লাহ বলেন, তখন ইত্তেফাক নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু আজাদ, মর্নিং নিউজ, পাকিস্তান অবজারভার, সংবাদ - এসব পত্রিকায় প্রতিদিন এই আন্দোলনের খবর বেরুতো গুরুত্ব সহকারে।

তিনি মনে করেন, এই আন্দোলন শুধু ছাত্র বা রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে নয়, বরং কৃষকদের মধ্যে, শ্রমিকদের মধ্যে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল - ফলে তা হয়ে উঠেছিল গণঅভ্যুত্থান।

ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের ফলেই ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে পাকিস্তানের শাসক জেনারেল আইয়ুব খানের পতন ঘটে। ঐতিহাসিকরা এই মামলা এবং মামলা থেকে সৃষ্ট গণ-আন্দোলনকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পেছনে প্রেরণাদানকারী অন্যতম প্রধান ঘটনা বলে গণ্য করে থাকেন।

তথ্য :-  বিবিসি বাংলা, বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও প্রাক্তন মন্ত্রী জনাব তোফায়েল আহমেদ, এমপি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক ও প্রাক্তন ছাত্র নেতা জনাব মাহবুব উল্লাহ স্মৃতিচারণ থেকে কর্নেল (অব.) কাজী শরীফ উদ্দিন : নিরাপত্তা বিশ্লেষক, লেখক ও কলামিস্ট, পরিচালক, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগ, প্রকল্প পরিচালক বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর, মধুখালী।

জামান / জামান

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার গণতন্ত্রের জন্য চ্যালেঞ্জ

কোচিং-এর গোলকধাঁধায়, শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে গুরুত্ব নেই

সাংবাদিকের দল সমর্থন গণতন্ত্রের জন্য হুমকি

ইঁদুরের কৃতজ্ঞতা

নাগরিক সেবা ও প্রত্যাশার সংকট: রাষ্ট্রীয় কর্মচারী কোথায়?

টেকসই সমাজ গঠনে সাম্য একটি অপরিহার্য ভিত্তি

শুভ জন্মাষ্টমী : সত্য, সুন্দর ও সাম্য প্রতিষ্ঠায় শান্তির বার্তা

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অপরিহার্য

জনগণের অংশগ্রহণে নির্বাচিতরাই কাশ্মীরের শাসক

স্বৈরশাসকের বিদায়, বিদ্রোহ ও পলায়ন

জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় তারেক রহমান

এপিআই ও এক্সিপিয়েন্ট উৎপাদনে বাংলাদেশের আত্মনির্ভরশীলতা: স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির নবদিগন্ত উন্মোচন

ট্রাম্প-উরসুলার বাণিজ্য চুক্তিতে স্বস্তির হাওয়া