ঢাকা সোমবার, ২৫ আগস্ট, ২০২৫

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, বিষন্নতায় নিমজ্জিত শিক্ষার্থী-শিক্ষক-অভিভাবক


জিয়াউদ্দিন লিটন photo জিয়াউদ্দিন লিটন
প্রকাশিত: ৩১-১-২০২২ দুপুর ৩:২৩

করোনা ভাইরাস সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ক্লাস সামনের ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বন্ধ রাখার ঘোষণায় পাঠ ও পঠনে 

ক্ষতির শিকার হচ্ছে। প্রায় দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পর সেপ্টেম্বর থেকে প্রতিষ্ঠান খোলায় বিগত সময়গুলোর ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চিন্তাভাবনা করেছিল শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা। কিন্তু নতুন শিক্ষাবর্ষের দু সপ্তাহ না যেতেই আবারও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণায় হতাশ শিক্ষক শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক। ফলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের মধ্যে। ইতমধ্যে মাধ্যমিকের, উচ্চ মাধ্যমিকের এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষির্থীরা কোভিড-১৯ এর প্রথম ডোজ টিকা গ্রহন করেছে।তারপরেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের হতাশ করেছে বৈকি।    

বাংলাদেশ জন্মের ৫০ বছরে অনেক প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করেছে। সত্যি বলতে, বাংলাদেশকে জন্মলগ্ন থেকে সব  সময়ই প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে বাঁচতে হয়। কখনো বন্যা, কখনো ঝড়, কখনো জলোচ্ছ্বাস নিত্যদিনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ। কিন্তু বাংলাদেশ কখনো শিক্ষায় দুর্যোগে পড়েনি। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর করোণার  বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি  দুর্যোগে পড়েছে যে খাত,সেটি হলো দেশের শিক্ষাখাত। এ পরিস্থিতির মূলে ছিল অপ্রত্যাশিতভাবে আঘাত হানা করোনাভাইরাস। আর এই সংক্রমণ ঠেকাতে হলে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। প্রায় ১৮ মাস ধরে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পর শর্তসাপেক্ষে ৪ মাস প্রতিষ্ঠান খোলা না রাখতেই বন্ধের ঘোষনায় দেশের সব শিক্ষা গবেষক,নীতিনির্ধারক, অভিভাবকসহ ছাত্রছাত্রীদের ভাবিয়ে তুলছে। যদিও শিক্ষায় এ ধরনের পরিস্থিতি শুধু বাংলাদেশেই নয়,সারা বিশ্বের জন্যই নতুন। করোনা পরিস্থিতির কারণে সরাসরি শ্রেণি পাঠদান চালিয়ে যেতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। তবে অনলাইন এবং টেলিভিশনে পাঠদানের মাধ্যমে আমরা সে ক্ষতি কিছুটা কমিয়ে দেবার চেষ্টা করেছি এবং তাতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জীবন তুলনামূলক ঝুঁকিমুক্ত থেকেছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী নির্যাতনের  অমানবিক সংবাদে ২০২০-২০২১ সালে বারবার মর্মাহত ও হতাশাগ্রস্ত হয়েছি আমরা। বিশেষ করে শিশু শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা ছিল সর্বাধিক সমালোচিত। চুপি চুপি সংঘটিত হয়েছে অগণিত মেয়ে শিশুর বাল্যবিয়ে। কাজে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছে অসংখ্য ছেলে শিশু। লেখাপড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে অনেক শিক্ষার্থী। প্রায় সকল শিক্ষার্থী নিমজ্জিত হয়েছে কম-বেশি হতাশায়!

একটি জাতির পরিচয় হচ্ছে তার শিক্ষায়। শিক্ষা হচ্ছে জাতির উন্নয়নের মানদন্ড। মেরুদন্ড ছাড়া যেমন কোন প্রাণী সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না তেমনি শিক্ষা ছাড়াও কোন জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। কোন জাতি কতখানি অগ্রসর তা নির্ভর করে  সেই জাতির শিক্ষা সংস্কৃতি ও কৃষ্টি-কালচার এর উপর। যে জাতি যত শিক্ষিত সে জাতি তত উন্নত। শিক্ষা ও জ্ঞান ছাড়া কোন জাতি বিশ্ব মানদণ্ডে উন্নত জাতি হিসেবে বিবেচিত হয় না। তাইতো প্রমথ চৌধুরী তার বই পড়া প্রবন্ধে বলেছেন, "যে জাতির জ্ঞানের ভান্ডার শুন্য সে জাতির ধনের ভাঁড়েও ভবানী" অর্থাৎ যে জাতির শিক্ষা নাই সে জাতির ধন সম্পদ নাই। জ্ঞান ছাড়া কোন জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নতি কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। আর এই জ্ঞান বিকশিত হয় শিক্ষার মাধ্যমে, যে শিক্ষা শুরু হয় বাল্যকাল থেকে। প্রবাদ আছে "যার জ্ঞান হয় তার সাত বছরেই হয় আর যার হয় না তার ৭০ বছরেও হয়না"। আর সেই জ্ঞান অর্জনের জন্য বাল্যকাল থেকেই শিক্ষা জরুরী। শিক্ষা বাল্যকাল থেকে শুরু না করলে তার সফলতা যে পাওয়া যায় না তার বড় প্রমাণ কোন পাঁচ-ছয় বছরের কোন ছাত্রকে  হাফেজ বানানো যতটা সহজ ৩০ বছরের বয়স্ক ছেলেকে ততটাই কষ্টকর ।  সুতরাং বাল্যকাল শিক্ষা অর্জনের জন্য  খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়, অথচ আমাদের সন্তানদের এই বাল্যকাল টা করোনার কারণে পুরোপুরি হতাশার মধ্যে নিমজ্জিত। চাকরি হারিয়েছে অনেক অভিভাবক। যার প্রভাব পড়ছে তাঁদের পরিবারের করোনা দারিদ্র্যের হার বাড়িয়ে দিচ্ছে। প্রাথমিকে অনেক শিক্ষার্থী  ঝড়ে পড়ার মূল কারণ দরিদ্র্তা। ফলে করোনা পরবর্তী উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়েছে। কারন তাদের  অবিভাবকেরা কর্মহীন হলে  তাঁদের সন্তানদের পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া কঠিন । আবার সিলেবাস ঠিক রেখে মান সম্মত শিক্ষা দেওয়াটাও একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইতমধ্যে অনলাইনে শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেছেন। ফলে নতুন করে সঙ্কটে পড়েছেন অভিভাবকরা। এদেশের অধিকাংশ পরিবারের জন্য ল্যাপটপ, কম্পিউটার, এনড্রয়েড মোবাইল নতুন শব্দ। করোনাকালীন সময়ে সংসারের অন্যান্য খরচের পাশাপাশি তাদের প্রিয় সন্তানের জন্য এগুলো কিনার মতো বিলাসিতা দেখাতে পারছে না। ফলে পিতা এবং সন্তানের মধ্যে ভালবাসায় চিড় ধরছে। শিক্ষাব্যবস্থায় ধনী এবং গরিবের আসল চিত্র ফুটে উঠেছে। করোনাকালে শিক্ষার সুফল ভগ করছে ধনীরা এবং ছিটকে পরছে গরীবরা। এক্ষেত্রে ধনীক শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা উপকৃত হলেও মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়ছে।করোনাভাইরাস মোকাবেলা করার জন্য সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধ রেখেছে। আগামী কতদিন বন্ধ থাকবে বলা মুশকিল। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সকল প্রকার অফিস, শিল্প কলকারখানা, গণপরিবহন খোলা থাকলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। সরকারী ছুটি চলাকালীন সময়ে সবচেয়ে বেশি সঙ্কটে আছেন শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরা। চরম সঙ্কটে পড়েছে শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ক্লাস,পরীক্ষা, রেজাল্ট, গবেষণা সবকিছুই বন্ধ রয়েছে। তৈরি হচ্ছে সেশনজট। ভেঙ্গে পড়ছে ক্লাসের সিডিউল।শিক্ষার্থীর অভাবে অনেক স্কুল কলেজ বন্ধ হয়ে গেছে।কিন্ডারগার্টেন  শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের অনেক শিক্ষক ছাঁটাই করেছেন খরচ কমানোর জন্য।

অনেক রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন স্কুল খুলে দেওয়ার  জন্য ইতোমধ্যেই সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়েছে করেছে মানববন্ধন। তাদের দাবি দেশের সমস্ত ডিপার্টমেন্ট পর্যায়ক্রমে খুলে দেওয়া হয়েছে বাকি আছে শুধু স্কুল-কলেজ। সুতরাং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের খুলে দেওয়া হোক।  সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীদের টিকার আওতায় আনার পর বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়া হবে। অপরদিকে রোগ তত্ত্ববিদ্যা বলছেন করোনা নামক রোগটি একেবারে নির্মূল হবে না দীর্ঘদিন এর সঙ্গে আমাদের বসবাস করতে হবে। যেহেতু রোগটি একেবারে নির্মূল হবে না যেহেতু রোগটির সঙ্গে লড়াই করেই আমাদের বাঁচতে হবে। আর তার জন্য যা যা করা দরকার তা করতেই হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে মাস্ক পরিধান করে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে উপযুক্ত স্যানিটাইজেশন করে প্রয়োজনবোধে সপ্তাহে অন্তত একটি করে ক্লাস হলেও করার পক্ষে মত দিয়েছেন। অন্যথায় অনেক কোমলমতি শিশুরা ঝরে পড়ে যাবে বিশেষ করে গ্রামের স্কুল গুলো থেকে। ফলে সৃষ্টি হবে বিরাট এক শূন্যতা ভবিষ্যতে শিক্ষায় পিছিয়ে পড়বে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী। ইউরোপের বহু দেশে করনা কে মাথায় নিয়েই তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিয়েছে। আমাদেরও সেই পথে হাটা উচিত বলে অনেকে মনে করেন। অনেকেই বলেছেন গ্রামে এই রোগ নাই বললেই চলে। সুতরাং গ্রামের বিদ্যালয়গুলো অন্তত খুলে পরীক্ষামূলক ক্লাস করা যেতে পারে। শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ সুতরাং কোনো ক্রমেই যেন আমাদের ভুলের কারণে শিশুদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস না হয় সেদিকে সবার সজাগ দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।

করোনা যেন শিশুদের পড়াশোনাকে আর ব্যাহত করতে না পারে সেজন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়ে সরকারগুলোর প্রতি স্কুল খোলা রাখার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের শিশুদের উন্নতি ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিশেষ সংস্থা ইউনিসেফ। শুক্রবার ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর এক বিবৃতিতে এ আহ্বান জানান। করোনার ‘ওমিক্রন’ ধরনটি ছড়িয়ে পড়ায় স্কুল পুরোপুরি বা আংশিক বন্ধ থাকার কারণে বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ৬১ কোটি ৬০ লাখ শিশু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানান তিনি। বিবৃতিতে তিনি বলেন, সংকটময় পরিস্থিতিতে সবসময় কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কোভিড-১৯ মহামারি বিশ্বজুড়ে শিক্ষা ব্যবস্থায় যে নজিরবিহীন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে তা আমরা স্বীকার করি। তবে এক্ষেত্রে ঝুঁকি খুবই বেশি। শিশুদের স্কুলে রাখার জন্য সম্মিলিতভাবে আমাদের পক্ষে সম্ভব সবকিছু করতে হবে। হেনরিয়েটা ফোর বলেন, অগ্রাধিকার প্রাপ্য জনগোষ্ঠীকে পুরোপুরি সুরক্ষিত করার পর এবং টিকার যথেষ্ট প্রাপ্তি নিশ্চিত হলে ইউনিসেফ শিশুদের টিকাদানকে সমর্থন করে। সশরীরে স্কুলে যাওয়ার জন্য টিকাদানকে পূর্বশর্ত করবেন না। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, কোভিড-১৯ টিকা প্রাপ্তি সাপেক্ষে সশরীরে স্কুলে যাওয়ার শর্ত আরোপ করলে তা শিশুদের শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ না পাওয়া এবং ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে ফেলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সুপারিশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ইউনিসেফ শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের টিকাদান ছাড়াই স্কুলগুলো খোলা রাখার এবং কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ কৌশল যাতে পড়াশোনা ও সামাজিক জীবনের অন্যান্য দিকগুলোতে শিশুদের অংশগ্রহণকে সহজতর করে তা নিশ্চিত করার সুপারিশ করে।

লেখকঃ শিক্ষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

শাফিন / শাফিন

কোচিং-এর গোলকধাঁধায়, শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে গুরুত্ব নেই

সাংবাদিকের দল সমর্থন গণতন্ত্রের জন্য হুমকি

ইঁদুরের কৃতজ্ঞতা

নাগরিক সেবা ও প্রত্যাশার সংকট: রাষ্ট্রীয় কর্মচারী কোথায়?

টেকসই সমাজ গঠনে সাম্য একটি অপরিহার্য ভিত্তি

শুভ জন্মাষ্টমী : সত্য, সুন্দর ও সাম্য প্রতিষ্ঠায় শান্তির বার্তা

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অপরিহার্য

জনগণের অংশগ্রহণে নির্বাচিতরাই কাশ্মীরের শাসক

স্বৈরশাসকের বিদায়, বিদ্রোহ ও পলায়ন

জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় তারেক রহমান

এপিআই ও এক্সিপিয়েন্ট উৎপাদনে বাংলাদেশের আত্মনির্ভরশীলতা: স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির নবদিগন্ত উন্মোচন

ট্রাম্প-উরসুলার বাণিজ্য চুক্তিতে স্বস্তির হাওয়া

মানবিক সংকটের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব