ভাষা আন্দোলনের সত্তর বছর : প্রত্যাশা প্রাপ্তি

১৯৫২ থেকে ২০২২। সত্তর বছর পূর্বে সালাম, বরকত, জব্বারেরা মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষাকরণের লক্ষ্যে ঢাকার পিচঢালা পথে জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন। বিশ্বে এমন ইতিহাস বিরল যে জাতিকে ভাষার জন্য প্রাণ দিতে হয়েছে। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা শুধু একটি ভাষা নয়, বাংলা জুড়ে আছে আমাদের আবেগ, অনুভূতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংগ্রাম। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রাণ দিয়েছিল এদেশের তরুণ ছাত্রসমাজ ও জনতা। তাদের বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল ঢাকার পিচঢালা রাজপথ। বাঙালি জাতির কাছে বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে প্রেরণার মাস ফেব্রুয়ারি। প্রাণের ভাষাকে তরুণ প্রজন্ম আজও ভালোবাসে, অনুভব করে মন থেকে।
যেকোনো জাতির সাহিত্য ও সংস্কৃতির মাধ্যম ভাষা। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বাহনও ভাষা। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ নিরীহ বাঙালির প্রতি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এমনকি সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও আঘাত শুরু করে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ঐতিহ্য নস্যাৎ করার অপতৎপরতায় লিপ্ত হলো ক্ষমতাশ্রয়ীরা। যার প্রেক্ষাপটে শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। প্রাণের ভাষা বাংলার অস্তিত্ব ও অন্যতম রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দেয়ার দাবিতে তুমুল আন্দোলনে যেতে বাধ্য হয় বাঙালিরা। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিবর্ষণে প্রাণ হারালেন সালাম, বরকত, রফিকসহ নাম না জানা শহীদেরা। এ আত্মত্যাগে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ল বিদ্রোহের আগুন। পরবর্তীতে নানা ঘাত-প্রতিঘাত, আন্দোলন সংগ্রামের পর বাংলা ভাষা পায় পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পেয়েছে স্বীকৃতি। তবে ভাষা আন্দোলনের মূল দাবি ছিলো সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন ঘটানো৷ কিন্তু আজও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন হয় নি। এখনো উচ্চ শিক্ষা,অফিস-আদালতে ইংরেজির প্রাধান্য বিদ্যামান। আদিবাসীরা আজও তাদের মাতৃভাষায় পড়ালেখার অধিকার থেকে বঞ্চিত। তাই, সরকারকে মাতৃভাষায় শিক্ষার প্রচলন করতে হবে। পাশাপাশি বাংলা ভাষায় প্রচুর সাহিত্য লেখা ও গবেষণায় লেখকদের অনুপ্রেরণা দিতে হবে। এখনি সময় বাংলা ভাষাকে ভালোবেসে ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে সমুন্নত করার।
পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নজির নেই ভাষার জন্য এত মানুষ জীবন দিয়েছে। এত রক্তের বিনিময়ে পাওয়া বাংলা ভাষার ব্যবহার ও চর্চা সম্পর্কে এখনো তরুণ প্রজন্ম সচেতন না। ইংরেজি ভাষায় কথা বলার চর্চা বাড়ছে। অনেকে ইংরেজি বলাকে স্মার্ট মনে করে। শুধু মূল্যবোধের অভাবে বাংলাভাষা তার নিজস্বতা হারাচ্ছে। একটি দেশের প্রত্যেকটি নাগরিকের তার নিজস্ব ইতিহাস জানা প্রয়োজন। নিজের দেশের ভাষাকে সম্মান করতে না পারলে সে অন্যে দেশের ভাষাকে সম্মান করতে পারবে না, শ্রদ্ধা করতে পারবে না। ইতিহাস থেকেই মানুষ শিক্ষা নেয়। তরুণ প্রজন্ম যদি আধুনিকতার নামে শিকড়কে অগ্রাহ্য করে তবে নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতির অস্তিত্ব ঠিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। সাবলীল ব্যবহারের মাধ্যদিয়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিক সদিচ্ছা আর সচেতনতাই পারে, বাঙালির এই গৌরবের ভাষাকে প্রজন্মে পর প্রজন্ম ঠিকিয়ে রাখতে। একুশের চেতনা বুকে ধারণ করে এগিয়ে যাক নতুন প্রজন্ম।
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি। আমরা সবাই এই লাইনটির সাথে পরিচিত। এর মাঝেই লুকিয়ে আছে ভাষার জন্য জীবন দেয়া শহীদদের আত্নত্যাগ আর তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও অকৃত্তিম ভালোবাসা। ১৯৫২ সালের ২১ এ ফ্রেব্রুয়ারির ইতিহাস আমাদের অহংকার। ২১ এর মধ্যে যে বাঙালি জাতীয় চেতনা ও আবেগ আছে, তা প্রচণ্ড শক্তি হিসেবে এখনো বর্তমান রয়েছে। আমাদের অস্থিমজ্জায় ভাষায় ও সংস্কৃতিতে এবং ইতিহাসে যে চেতনা গাঢ় হয়ে মিশে আছে, তাকে ধ্বংস করা অত সহজ নয় এত রক্তের বিনিময়ে পাওয়া বাংলা ভাষার ব্যবহার ও চর্চার ক্ষেত্রে তরুণ প্রজন্ম এখনও সচেতন নয়।
বাঙালিদের মধ্যে ইংরেজি ভাষায় কথা বলার চর্চা বাড়ছে। শুধু মূল্যবোধের অভাবে বাংলা ভাষা তার নিজস্বতা হারাচ্ছে। তাই ভাষার সম্মান এবং শুদ্ধ ভাষার চর্চা আমাদের সবারই উচিৎ। একটি দেশের প্রত্যেক নাগরিকের তার নিজস্ব ইতিহাস জানা প্রয়োজন। ইতিহাস থেকেই তো মানুষকে শিক্ষা নিতে হবে। একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় জীবনের এক অমর অধ্যায়। এ মাসটি যেমন আমাদের বেদনার তেমনি চেতনার অগ্নিমশাল। একুশের চেতনায় উজ্জীবিত হয়েই আমরা পেয়েছি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। জাতীয় জীবনকে একটি স্বতন্ত্র মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করার জন্য অমর একুশের সীমাহীন অবদানের কথা তাই কখনোই ভোলার নয়। স্বাধীনতাযুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষ যে দুর্বার সাহসের পরিচয় দিয়েছিল এবং অগণিত জীবন উৎসর্গ করেছিল, তার প্রেরণা এসেছিল একুশের চেতনা থেকেই। আর সেই চেতনা আমাদের তরুণন প্রজন্মের ভাবনায় ধারণ করে এগিয়ে যেতে হবে সামনের দিনগুলিতে।
বাঙ্গালি জাতি বরাবরই নিজেদের দাবী আদায়ে সোচ্চার হয়ে উঠেছিলো। যা আমাদের স্বাধীকার আন্দোলনের ইতিহাস ঘাটলেই পাওয়া যায়।পৃথিবীর ইতিহাসে বাঙ্গালি একমাত্র বিরল জাতি যারা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে। প্রতিটি জাতি চায় নিজস্ব ভাষার স্বাধীনতা, প্রাণ খুলে কথা বলার অধিকার। মা, মাটি, মাতৃভাষা আমাদের অহংকার। মাতৃভাষা বাংলার জন্য বাঙালির আত্মত্যাগের মহিমা ছড়িয়ে পড়েছে ভৌগোলিক সীমারেখা অতিক্রম করে পৃথিবীর সব জাতি- গোষ্ঠীর মাতৃভাষার স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে। বাংলা ভাষা কেবলই বাঙালি বা বাংলাদেশের মানুষেরই একমাত্র ভাষা নয়। আফ্রিকার দেশ সিয়েরালিওন বাংলাকে সে দেশের দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের জন্য কাজ চলছে। আমাদের গৌরবের ইতিহাসকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে ২১ শে ফেব্রুয়ারি কে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” রূপে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। যা আমাদের জন্য সত্যিই গৌরবের। অপসংস্কৃতির প্রভাবে পৃথিবীর বহু ভাষা আজ হুমকির সম্মুখীন। শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা আজ বাংলার পরিবর্তে ইংরেজি রপ্ত করতেই বেশী আগ্রহী।উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার সীমিত। দেশের বিভিন্ন সাইনবোর্ডগুলো ইংরেজিতে লেখা। মাতৃভাষাকে বুকে ধারন করে তরুণদের এগিয়ে যেতে হবে। যেন কখনো এই ভাষার বিলুপ্তি না ঘটে।আমাদের ভাষার সঠিক ব্যবহার আর মর্যাদা আমাদেরই নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে আমাদের আত্নত্যাগের ইতিহাস ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। যা মোটেও কাম্য নয়।
পলাশীর যুদ্ধে সিরাজের পরাজয়ের প্রায় দু’শ বছর পর সাতচল্লিশ সালে এসেও আমরা প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার সূর্যের দেখা পাইনি। আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে আরো চব্বিশ বছর। বায়ন্নোর ভাষা আন্দোলন ছিলো সাতচল্লিশের পরে প্রথমবারের মতন বড় কোনো আন্দোলন যেখানে মাতৃভাষার সন্মান রক্ষার্থে রাজপথে রক্ত বলি দিয়েছে কিছু উদ্যমি তরুণ, সাধারণ জনতা। ভাষার জন্য আর কোনো জাতির এত রক্ত দিতে হয়নি। এটা আমাদের জাতীয়তাবাদের জাগরণের সমুজ্জ্বল ইতিহাস।আমাদের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বাংলা ভাষার ব্যবহার ও চর্চার ক্ষেত্রে আরো সচেতন হওয়া উচিত।শুধু ফেব্রুয়ারী মাসে শহীদ বেদিতে ফুল দিয়ে ভাষার প্রতি উদারতা দেখানো সোশ্যাল মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকুক। ভাষার ইতিহাস, শুদ্ধ চর্চা, মননে জাতীয়তাবাদ ধারণ করার মধ্যেই একুশের চেতনা প্রতিফলিত হোক। বাংলাকে বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করার চর্চা চলুক। নিজ ভাষাকে ছোট না করে পাশাপাশি অন্যান্য ভাষা শিক্ষার চর্চা অব্যাহত থাকুক। নতুন প্রজন্মের কাছে বাংলা ভাষাকে তুলে ধরতে আমাদের এতটুকু দায়বদ্ধতা থাকা উচিত।
মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ
শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাস সাংবাদিক
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
সংগঠক, জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি ফিচার, কলাম এন্ড কন্টেন্ট রাইটার্স
এমএসএম / এমএসএম

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার গণতন্ত্রের জন্য চ্যালেঞ্জ

কোচিং-এর গোলকধাঁধায়, শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে গুরুত্ব নেই

সাংবাদিকের দল সমর্থন গণতন্ত্রের জন্য হুমকি

ইঁদুরের কৃতজ্ঞতা

নাগরিক সেবা ও প্রত্যাশার সংকট: রাষ্ট্রীয় কর্মচারী কোথায়?

টেকসই সমাজ গঠনে সাম্য একটি অপরিহার্য ভিত্তি

শুভ জন্মাষ্টমী : সত্য, সুন্দর ও সাম্য প্রতিষ্ঠায় শান্তির বার্তা

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অপরিহার্য

জনগণের অংশগ্রহণে নির্বাচিতরাই কাশ্মীরের শাসক

স্বৈরশাসকের বিদায়, বিদ্রোহ ও পলায়ন

জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় তারেক রহমান

এপিআই ও এক্সিপিয়েন্ট উৎপাদনে বাংলাদেশের আত্মনির্ভরশীলতা: স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির নবদিগন্ত উন্মোচন

ট্রাম্প-উরসুলার বাণিজ্য চুক্তিতে স্বস্তির হাওয়া
Link Copied