নায়েব সুবেদার (অব.) আব্দুল মতিন সিকদারের মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা

ভয়াবহ সেই ১৯৭১ সনের মার্চ মাস। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের সবগুলি শহর দখল করে নেয়। এরপরে শুরু করে হত্যা-গণহত্যা, লুন্ঠন, নির্যাতন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ। তখন আমরা ছিলাম তৎকালীন ই.পি.আর (ইষ্ট পাকিস্তানী রাইফেল) ৪ নং উইং বর্তমান ব্যাটারিয়ান (ই.পি.আর) চুয়াডাঙ্গা কুষ্টিয়ায় কর্মরত ছিলাম। তখন পশ্চিমা হানাদার বাহিনী শুধু বৈষম্যমূলক আচরণই করে নাই, আমাদের উপর অনেক অত্যাচার, জুলুম করেছে কিন্তু তখন আমরা কিছুই বলতে পারি নাই শুধু অপেক্ষায় ছিলাম সুযোগের, যদি সুযোগ আসে তাহলে ওদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দিব। এরই মধ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ এবং আমাদের দুইজন কমান্ডারই ছিল বাঙ্গালী। তাদের নাম (১) মেজর আবু উসমান চৌধুরী (ব্যাটালিয়ান অধিনায়ক), (২) ক্যাপ্টেন এ আর আজম চৌধুরী (ব্যাটালিয়ান সহ অধিনায়ক), এদের নির্দেশে আমরা কুষ্টিয়া জেলা শহরে অবস্থানরত হানাদান বাহিনীর উপর আক্রমন করার প্রস্তুতি নেই। আর হানাদার বাহিনীর অবস্থান ছিল কুষ্টিয়া জেলা শহরে। ওদের গুরুত্বপূর্ণ ঘাটি ছিল পুলিশ লাইন জেলা স্কুল ও এক্সেঞ্জ অফিস। তবে সেই আক্রমণের আগে আমাদের ভিতরের যেই হানাদার বাহিনী ছিল অর্থাৎ পাঞ্জাবি আর পাঠান, ২৬ শে মার্চ ওদেরকে আমরা কৌশলে বন্দি করি। কারণ ওদেরকে সরাসরি গুলি করে মারতে গেলে ওরা যতজনই মৃত্যুবরণ করুক না কেন পক্ষান্তরে ঐ মুহুর্তে যদি আমাদের একজন সৈনিকও মারা যায় তাহলে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। হানাদার বাহিনীর ভারি অস্ত্র ও বহুসংখ্যক সৈনিক দ্বারা সংগঠিত বড় একটি দলের উপর আমরা মাত্র দুই প্লাটুন ইপিআর সদস্য এবং কিছু পুলিশ ও কিছু আনসার মুজাহিদ নিয়ে পরের দিন ২৭শে মার্চ কুষ্টিয়া শহর থেকে ছয় মাইল দূরে এক জঙ্গলে অবস্থান নিলাম। এরপর কিছু সংখ্যক সৈনিক নিয়ে কয়েকটি খন্ডদল এ বিভক্ত হয়ে পর্যবেক্ষণ (রেকি) করে তারপর সমস্ত সৈনিকদেরকে একত্রিত করে যুদ্ধের পরিকল্পনা প্রস্তুত করা হয় এবং যুদ্ধের দিক নির্দের্শনা নিয়ে কুষ্টিয়া জেলা শহরের আনুমানিক এক দেড় মাইল দূরে বারখাদা গ্রামের প্রফেসর মনিরুজ্জামানের বাড়ির এরিয়ায় আমরা শেষ অবস্থান নেই অর্থাৎ যেখান থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করা হয়। এরপর রাতের মধ্যেই আমরা ঐ ঘাটি ৩০০ (তিনশত) গজের ভিতরে অবস্থান নেই। নির্দেশনা ছিলো যে, ভোর রাত ৪.৩০ মিনিটে পুরা শহরের বিদ্যুৎ বন্ধ হয়ে যাবে এবং সেই সঙ্গে ফায়ার শুরু হবে। আমি ছিলাম এলএমজি ম্যান এবং পুলিশ লাইনের আক্রমণে। আমরা ফায়ারের শুরুতেই ওদের যেই দূর পাল্লার অস্ত্র ছিল রিকয়েল রাইফেল (আর আর) যাহার কার্যকারিতা ছিল ১০ কিলোমিটার। ঐ অস্ত্রকে আমরা লেঞ্চার রকেটের গোলার আঘাতে বিকল করিয়া দেই। এতেই ওরা বাংকার ছেড়ে বিল্ডিং-এর দুই-তিন তলায় উঠিয়া যায়। এরপর হানাদার বাহিনী দুই-তিন তলা থেকে ফায়ার করতে থাকে আর আমরা ভূমি থেকে ফায়ার করতে থাকি। এমনিভাবে ফায়ার করতে করতে এক পর্যায়ে এক মর্মান্তিক প্রাণহানি ঘটে গেল অর্থাৎ হানাদার বাহিনীর মেশিনগানের একটি ব্রাশ ফায়ারে আমার সহযোদ্ধা সিপাহী আব্দুস সাত্তারের বুকে লাগে, এতে করে তার বুকটা ঝাঁজরা হয়ে যায় এবং সে শাহাদাৎ বরণ করে।
এরপর অনেক কষ্টে তার দেহটাকে টেনে টেনে একটু পিছনে আনা হল। ঐ অবস্থা দেখে আমাদের সৈনিকরা অনেকেই দুর্বল হয়ে গেলো এবং অবস্থান ছেড়ে এলোমোলো হয়ে গেল। একপর্যায় গিয়ে ফায়ারও বন্ধ করে দেয়, তখন বেলা ১টা বাজে। আমি তখন মনে মনে ভাবলাম এমনি করে করে যখন সন্ধ্যা হয়ে যাবে তখনতো হানাদার বাহিনী আবার বের হয়ে পরবে, ওদেরকে আর ঠেকানো যাবে না। আমি তখন আমার আর একজন সহযোদ্ধাকে বললাম যে, চল যাই ঐ বাংকারে, যেই বাংকারগুলি হানাদার বাহিনী ছেড়ে চলে গেছে। তখন সে আমাকে বললো, একজনতো মরেছে, আমি আর মরতে চাই না। সাঁধ থাকেতো আপনিই যান। তখন আমি ছিলাম এলএমজি ম্যান। আমি বললাম যে, একটিা এলএমজি এবং গুলিভর্তি মেগাজিনের বক্স একা নিয়ে যাওয়া খুবই কঠিন। আর একজন কি কেহ আছেন ? আমার সঙ্গে যাওয়ার জন্য। কিন্তু এতে কেহ রাজী হল না। তখন আমি বলালম যে ঠিক আছে, আমি একাই যাব। তখন আমি ছিলাম সিপাহী। আমার কমান্ডার ছিল হাবিলদার খোয়াজ আলী। তিনি বললেন, না তুমি যাবে না। খোলা মাঠ দিয়ে তুমি গেলে একটা গুলিতেই তুমি মরে যাবে। আমি বললাম আমার কোন দুঃখ নাই। আমি যাবোই। এই কথা বলে আমি এলএমজি এবং গুলি ভর্তি মেগাজিনের বক্স নিয়ে কোরলিং করতে শুরু করলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর ঐ হাবিলদার আমার আমাকে ডাকতেছে, মতিন তুমি যেওনা, তার সঙ্গে একজন সে বলতেছে ওকে যেতে দিন, ও মরার জন্য যাচ্ছে। এই কথার পর আমি পুলিশ লাইনের এক কোনা দিয়ে কাটা তারের বেড়া ভেদ করলাম। বেড়া ভেদ করতেই দেখি কোনায় একটি বাংকার, তার ভিতরে একজন ইউনিফরমধারী সৈনিক একটি রাইফেল নিয়ে বসে আছে, আমাকে দেখে সে দাঁড়িয়ে গেলো। আমি হঠাৎ করে তাকে দেখে চমকিয়ে গেলাম। বুকের মধ্যে ধড়ফড় করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে ঐ লোকটা আমাকে আওয়াজ দিয়ে বলল ভাই আমি বাঙালি, আমি বাঙালী। ফায়ারের শুরুতেই ওরা বাংকার ছেড়ে চলে গেছে, আমি যাইনি। হানাদার বাহিনী আমাদেরকে বাধ্য করেছে আপনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। এখনতো আর আমি পিছনেও যাইতে পারিনা, তাই আমি বাংকারে বসে আছি। এই কথা শুনে আমি অনেকটা স্বস্তি পেলাম সত্য, তবে বাংকারের আশে পাশেতো আরো বাংকার আছে, বিল্ডিং আছে, তার ভিতরেওতো হানাদার বাহিনী থাকতে পারতো। যদি থাকতো তাহলে একটি ব্রাশ বা একটি গুলিই যথেষ্ট ছিল আমাকে মারার জন্য। আসলে মৃত্যুর বিন্দুমাত্র ভয় আমার ভিতরে ছিল না। আমার ভিতরে ছিল পশ্চিমা হানাদার বাহিনীকে খতম করা।
এরপর আমি আর একটু সামনের দিকে গেলাম। গিয়ে দেখলাম, ওদের যে গার্ডরুম ছিল সেই গার্ডরুমের বারান্দায় বালুর বস্তা দিয়ে বাংকার তৈরি করা আছে ঐ বাংকারে আমি অবস্থান নেই এবং এলএমজি লাগিয়ে ফায়ার করতে শুরু করি। আমি এমন কৌশলে ফায়ার করতেছি যে, ওরা যাতে বুঝতে না পারে যে আমি একটি অস্ত্র দিয়েই ফায়ার করতেছি। অর্থাৎ আমি দ্রুত লম্বা লম্বা ব্রাশ ফায়ার করতেছি এবং ধীরে ছোট ছোট ব্রাশ ফায়ার করতেছি। ডানের বিল্ডিং, বামের বিল্ডিং এবং সামনের বিল্ডিং-এ ফায়ার করতেছি। এমনিভাবে ফায়ার করতে করতে প্রায় ৩০০ (তিনশত) রাউন্ড গুলি ফায়ার হয়ে গেছে। তখন আমার মনের মধ্যে একটু চিন্তা হলো যে, গুলিতো প্রায় শেষ আর মাত্র ২৮ রাউন্ড এর দুইটি মেগাজিন আছে। আর আমার সাথেও কেউ নেই। এখন কি হবে? এরই মধ্যে দেখা গেল যে, হানাদার বাহিনীর ফায়ার সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে গেছে। অর্থাৎ ওরা আত্মসমর্পণ করেছে। হানাদার বাহিনীর ফায়ার বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে আমাদের সৈনিকরা যারা কাটা তারের বাহিরে ছিল তারা এবং এলাকার জনগণ ও স্কুল কলেজের ছাত্র সহ সবাই জয় বাংলার ধ্বনি দিয়ে পুলিশ লাইনের ভিতরে ঢুকে গেলো। ভিতরে গিয়ে আমাকে দেখে তারা আমাকে মাথার উপরে উঠাইয়া নাচানাচি ও আনন্দ উল্লাস করতে লাগলো। তখন আমি বললাম যে, শোন আমার কাছেতো গুলি নেই। আমাকে কিছু গুলি সংগ্রহ করে দাও। এই কথা শুনে স্কুল-কলেজের ছাত্ররা আমাকে গুলি সংগ্রহ করে দিল। এরপরে গেলাম আর একটু সামনের দিকে। যেয়ে দেখি অনেক লাশ পড়ে আছে এবং বিল্ডিংয়ের একটি রুমের দরজা দিয়ে রক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে নামতেছে। বাকি যেই সৈনিকরা জীবিত ছিল তারা সবাই সেনাবাহিনীর পোষাক খুলে পুলিশের পোষাক পড়ে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বলতেছে যে, ভাই মে তো পুলিশ হো, মুঝে মত মারো, মে তো বিহারী হো, মুঝে মত মারো। কিন্তু এলাকার যে সকল জনসাধারণ ছিল তারা সবাই বলতেছে যে, এখন আর আপনারা না, আমরাই ওদেরকে মারবো। কারণ ওরা আমার বোনকে নিয়ে আসছে। কেউ বলছে ওরা আমার মেয়ে নিয়ে আসছে, কেউ বলছে ওরা আমার স্ত্রীকে নিয়ে আসছে। ওদেরকে আজও আমরা ফেরত পাই নাই। কাজেই ওদেরকে আমরা মরাবো। এরই মধ্যে আর একজন লোক দৌড়ে এসে রাগান্বিত হয়ে বলল, আমি ওদের মাংস কেটে নিয়ে খাব। কারণ ওরা আমার ছেলের বৌকে ধরে নিয়ে আসছে, তাকে আর পাওয়া যায় নাই। এই কথার পর ওদের হাতে ছিল বড় বড় হাঁসুয়া, যাকে আমাদের দেশে বলে কাচি। ঐ হাঁসুয়া দিয়েই ওরা সবাইকে জবাই করে ফেললো। এরপর হানাদার বাহিনীর হালকা ও ভারি অস্ত্র সহ বিপুল পরিমাণে গোলাবারুদ আমরা পাই। তখন আনুমানিক বেলা ৩.০০ টা বাজে। এরই সঙ্গে কুষ্টিয়া জেলার পুলিশ লাইন হানাদার মুক্ত হল।
এরপর আর একটু সামনের দিকে গেলাম, গিয়ে দেখি বিল্ডিং এর একটা রুমে ফাঁসির রশি ঝুলানো আছে। হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের পড়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে জীবিত মানুষের উপরে ব্যানেট চার্জ করত। যারফলে জীবিত মানুষের রক্ত দেয়ালে ছিটকে লাগতো। বিশেষ করে যুবতি মেয়েদের উপরে এটা বেশি হতো। কেননা এর নমুনা, দৃশ্য ও চিত্র আমরা অনেক জায়গায় পেয়েছি। তবে এর জন্য কারা দায়ী ? আমি বলব হানাদার বাহিনীরর পাশাপাশি ওদের যে এই দেশীয় দোসর যারা ছিল, যারা বিভিন্ন গ্রাম থেকে মেয়েদেরকে ধরে এনে ওদের হাতে তুলে দিয়েছিলো। তারাই হল মানবতা বিরোধী বিশেষ করে তখনকার জামাত মুসলিমলীগ এবং কিছু সংখ্যক মুন্সী মৌলভী। তাই মহোদয়ের মাধ্যমে সরকারের কাছে আমার জোর দাবী, সকল মানবতা বিরোধী, যাদের আজও বিচার হয়নি। সে সকল মানবতা বিরোধী, যুদ্ধাপরাধী, স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার, আলবদর, আলশামস, পীচ কমিটির চেয়ারম্যান এর বাংলাদেশের ভিতরে অথবা বাহিরে যেখানেই লুকিয়ে থাকুক না কেন, ওদেরকে খুঁজে খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় এনে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হোক। তাহলেই ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে সে দেশ কলংকমুক্ত হবে। এই আশাবাদ ব্যাক্ত করে ভুল ত্রুটি ক্ষমা চেয়ে আমি আমার প্রথম যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত কাহিনী শেষ করলাম। খোদা হাফেজ।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
(বীর মুক্তিযোদ্ধা বি.ডি.আর (অবঃ) নায়েব সুবেদার আব্দুল মতিন সিকদার)
এমএসএম / জামান

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার গণতন্ত্রের জন্য চ্যালেঞ্জ

কোচিং-এর গোলকধাঁধায়, শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে গুরুত্ব নেই

সাংবাদিকের দল সমর্থন গণতন্ত্রের জন্য হুমকি

ইঁদুরের কৃতজ্ঞতা

নাগরিক সেবা ও প্রত্যাশার সংকট: রাষ্ট্রীয় কর্মচারী কোথায়?

টেকসই সমাজ গঠনে সাম্য একটি অপরিহার্য ভিত্তি

শুভ জন্মাষ্টমী : সত্য, সুন্দর ও সাম্য প্রতিষ্ঠায় শান্তির বার্তা

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অপরিহার্য

জনগণের অংশগ্রহণে নির্বাচিতরাই কাশ্মীরের শাসক

স্বৈরশাসকের বিদায়, বিদ্রোহ ও পলায়ন

জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় তারেক রহমান

এপিআই ও এক্সিপিয়েন্ট উৎপাদনে বাংলাদেশের আত্মনির্ভরশীলতা: স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির নবদিগন্ত উন্মোচন
