ঢাকা মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৫

পাহাড় ধস নিরসনে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে


আসাদুজ্জামান সম্রাট  photo আসাদুজ্জামান সম্রাট
প্রকাশিত: ২৭-৬-২০২১ দুপুর ৩:২৪
বাংলাদেশের পাহাড়-পর্বতগুলো  বিশাল এলাকা জুড়ে  সীমাহীন সৌন্দর্যের এক মহাসমাবেশ। আঁকাবাঁকা সবুজ-শ্যামল পাহাড়ী পথ আর পাহাড়ের কোল ঘেঁষে  হাজার-হাজার মানুষের বসবাস এবং সাজানো চা বাগান ও বিশাল ছায়া বৃক্ষে  যেন প্রকৃতি তার অকৃপণ হাতে  অপরূপ সৌন্দর্য আর মাধুর্যে ছড়িয়ে  সমৃদ্ধ করেছে এ দেশকে।এই অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমির পাহাড় গুলোতে প্রতিবছর পাহাড় ধস নামের একটা হৃদয় বিদারক প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে থাকে ।সাধারণত বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম,রাঙ্গামাটি খাগড়াছড়ি কক্সবাজার,বান্দরবান এবং  উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার জেলায় বিস্তীর্ণ পাহাড়ি ভূমি রয়েছে। উল্লেখ্য যে,দেশের প্রায় ১৪ লাখ হেক্টর পাহাড়ি এলাকা থাকলেও, মূলত চট্টগ্রাম বিভাগের ১৫ হাজার ৮০৯  বর্গমাইল বিস্তৃত পাহাড়ি এলাকা জুড়ে  পাহাড় ধসের  ঘটনাগুলো বেশি  ঘটে থাকে।
 
প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমের জুন ও জুলাই মাসে পাহাড় ধসের ঘটনাগুলো পাহাড়ি অঞ্চলে বেশ লক্ষণীয়।পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, পাহাড় ধস নামের  দুর্যোগটি মনুষ্যসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক কারণে হয়ে থাকে। তন্মধ্যে  প্রাকৃতিক কারণের চেয়ে কৃত্রিম কারণগুলো সর্বাধিক।মনুষ্যসৃষ্ট কারণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণ হলো নির্বিচারে বৃক্ষনিধন ও বনউজাড়করণ,পাহাড় কেটে অবৈধ বসতি স্থাপন, পাহাড় থেকে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়া এবং অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণের কারণে পাহাড়ের ধসের মূল কারণ। এছাড়া বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, পাহাড়ে উন্নয়নের নামে পাহাড়  কাঁটা হলেও  কোন এলাকায় মানা হচ্ছে না উন্নত প্রযুক্তি ও প্রকৌশল এবং বিল্ডিং কোড। তাছাড়া পাহাড়ি উন্নয়নমূলক সংস্থা গুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবও আরেকটি মূল কারণ। পাহাড়িদের অপরিকল্পিত জুম চাষের কারণে পাহাড়ের মাটি নরম এবং ফাটল সৃষ্টি হয়ে পড়ে। যা  পাহাড় ধসের সম্ভবনা শতগুণ বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া ভূমিদস্যুদের দ্বারা পাহাড় কেটে বালু ও পাথর উত্তোলন আরেকটি উল্লেখযোগ্য ভুমিধসের কারণ । পাশাপাশি এই দুর্যোগের প্রাকৃতিক কারণ গুলোর মধ্যে রয়েছে অতিবৃষ্টি, মাটির প্রকৃতি, দীর্ঘ খরার পর টানাবর্ষণ, ভূমিকম্পে পাহাড়ে ফাটল সৃষ্টি এবং জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তনের প্রভাব। 
 
বিশেষজ্ঞদের মতে প্রতিবছর জুন-জুলাই মাসে যখন বর্ষকাল শুরু হয়, তখন পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড় ধসের আশঙ্কা বেশি থাকে। তাই এই সময়ে প্রতিবছর পাহাড়ে বসবাসরত জনগন চরম উৎকন্ঠায় জীবন- যাপন করে। পাহাড়ের পাদদেশে প্রান্তিক  জনগোষ্ঠী মানুষের বসবাস। মৃত্যুঝুঁকি যেনও পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করছে হাজার-হাজার হতদরিদ্র মানুষ। বর্ষাকালে বিশেষ করে  জুন-জুলাই মাসে খুব উদ্বিগ্ন জীবন যাপন করে পাহাড়বাসীরা। এমনকি বৃষ্টির সময়  পাহাড়িদের রাতের বেলায় ভূমিধসের কবলে পড়ার ভয়ে পরিশ্রান্ত দুচোখে ঘুম পর্যন্ত আসে না।তাছাড়া তাঁরা পরিবার-পরিজন নিয়ে ভয়ভীতির কারণে  মানসিক প্রশান্তির অভাবে জীবিকা নির্বাহের জন্য কাজ করতে পর্যন্ত অনীহা প্রকাশ করে।এমনকি পরিবার প্রধান  পাহাড় ধসের কবল থেকে নিজের জীবন ও পরিবারকে রক্ষার জন্য  চিন্তায় কপালে  ভাঁজ পড়ে।তবুও অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার জন্য, দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী মৃত্যুঝুঁকি জেনেও, কোনো বিকল্প উপায় না পেয়ে, পাহাড়ে বসবাস করছে  বিভিন্ন শ্রেণীর জনগণ ।কেউ পৈতৃকসূত্রে, কেউবা চাকরিসূত্রে আর কেউ জীবিকা নির্বাহের নিমিত্তে যুগ যুগ ধরে  তাঁরা পাহাড়ের পাদদেশে মৃত্যুকূলে বসবাস করছে। একবিংশ শতাব্দীতে পাহাড়ি  অঞ্চলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও মানুষের বিচরণ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে পাহাড় ধসের কারণে প্রাণহানির  ঘটনা গুলো বেশি ঘটছে।উল্লেখ্য, পাহাড়ে মাটি চাপা পড়ে মৃত ব্যক্তির সংখ্যা হিসাব করা অসম্ভব। তবে মৃত্যু জরিপে দেখা যায় ,  ২০০৭,২০১২,২০১৭ সালের মর্মান্তিক পাহাড় ধসের কবলে পড়ে  বেশ সংখ্যক মানুষ মারা গিয়েছিল। ইতিমধ্যে এই বছরেও দেশের বিভিন্ন জায়গায় স্বল্প পরিসরে পাহাড় ধসের কারণে  মাটি চাপায় কয়েকজন মানুষ মৃত্যু বরণ করেছে। অতি ভারী বৃষ্টি হলে পাহাড়ে আবারও বড় ধরনের পাহাড় ধসের আশঙ্কা দিয়েছে বিশেষজ্ঞরা। 
 
প্রতিবছর দেশে পাহাড় ধসের কারণে প্রচুর ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়, মানুষের প্রাণহানি ঘটে এবং দেশের সম্পদের ক্ষতি হয়ে থাকে।শুধু তাই নয়, পরিবেশের পাশাপাশি জীববৈচিত্র্যের উপরও ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।প্রকৃতপক্ষে, পাহাড় ধসের কারণে প্রতিবছর দেশের প্রাণিকূল ও উদ্ভিদকূল চরম হুমকি সম্মুখীন হচ্ছে।তাই পাহাড় ধস নিরসনের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহন করা একান্ত জরুরি।দেশের   পাহাড় ধসের  পেছনে প্রাকৃতিক কারণে তুলনায়   মনুষ্য কারণ বেশি।সেহেতু  এই দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সরকার ও জনগণকে  সম্মিলিত উদ্যোগে কাজ করতে হবে।দেশে বর্ষাকালে  পাহাড় ধস প্রতিরোধে প্রশাসন ব্যাপক  প্রস্তুতি নেয়।কিন্তু সেই পদক্ষেপ গুলো সাময়িক এবং পৌর এলাকার গুলোর জন্য নেওয়া হয়। মূলত প্রশাসন পাহাড় ধসের পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতি কমাতে কাজ করলেও,  ভূমিধসের প্রতিরোধের জন্য  আজও পর্যন্ত তৃণমূল পর্যায়ের বুঝিপূর্ণ পাহাড় গুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণের কোন টেকসই ব্যবস্থাপনা গ্রহন করেনি।লক্ষ্যণীয়,পাহাড় ধসে প্রাণহানির পর সাময়িক দৌড়ঝাঁপ ও তাৎক্ষণিক কিছু পদক্ষেপের পর ভুক্তভোগী ও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা সবকিছু ভুলে যান। ফলশ্রুতিতে প্রতিবছর পাহাড়ধস ও পাহাড়ে ঝুকিপূর্ণ বসাবাস,  পরিবেশ অরক্ষিত এবং সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দিন দিন বাড়তেছে।
 
তাই এই মুহূর্তে প্রশাসনের উচিত,  পাহাড় ধস ব্যবস্থাপনা ও পূর্ণবাসন কমিটি-২০০৭ এর কার্যক্রম সমূহ  আরো স্থায়ীভাবে দৃশ্যমান করতে হবে।পাহাড়ে সরকারি অর্থায়নে ব্যাপক হারে বৃক্ষরোপন ও রক্ষানাবেক্ষণ করতে হবে ।কেননা বৃক্ষ মাটির সহনশীলতা বৃদ্ধি ও পাহাড় ধস প্রতিরোধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। দেশে পাহাড়ের চূড়ায় এবং ঢালে  যারা অবৈধভাবে বসবাস করছে তাদেরকে দ্রুত অপসারণ করতে হবে এবং পুনর্বাসনে নিতে হবে। একইসাথে বৈধভাবে লোকজন বসবাসকারী পাহাড় গুলো ঝুঁকিমুক্ত এবং  বসবাসের উপযোগী কিনা তা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। তাছাড়া পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫ এর ৬(খ) ধারা যথাযথ ভাবে সর্বস্তরে প্রয়োগ করতে হবে। পাহাড়ের বনাঞ্চল সংরক্ষণের জন্য বন বিভাগকে আরো উদ্যোগী হতে হবে। সরকারকে ধস প্রবণ পাহাড়ি এলাকা গুলো দ্রুত চিহ্নিত করে  রিটেইনিং ওয়াল দিতে হবে  এবং জিও টেক্সটাইল প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভূমি ক্ষয় ও ধসের প্রকোপ হ্রাসমান করা উচিত।ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলোকে ভূমিধস পূর্বানুমান মানচিত্রের অধীনে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং সঠিক তথ্য মোতাবেক মাইকিং করে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের সরে যেতে প্রচারণা চালাতে হবে।। একইসাথে সরকারের পাশাপাশি পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী  লোকজনকে ও খুব সচেতন থাকতে হবে। কেননা বেশির ভাগ পাহাড় ধস মূলত  মানুষের কুকর্ম কারণে হয়ে থাকে । তাই সর্বপ্রথম জনগণকে পাহাড় কাটাঁর মহোৎসব বন্ধ করতে হবে,পাহাড়ের পাদদেশে বসতি স্থাপনা নির্মাণ থেকে বিরত থাকতে হবে ,বৃক্ষনিধন এবং ব্যাপকহারে  জুম  চাষ করা থেকে বিরত থাকতে হবে , বনায়নের ক্ষেত্রে  পরিবেশবান্ধব বৃক্ষ যেমন  তাল ও সুপারি গাছ প্রচুর পরিমাণ রোপন করতে হবে।এবং প্রয়োজনে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কাছে যথাযথ সাহায্য গ্রহণ করতে হবে। ধস প্রবণ ঢ়ালের উপর সরাসরি কৃষি কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।পাহাড় ধস যেহেতু একটি পরিবেশগত বিপর্যয়। তাই এই বিপর্যয় প্রতিরোধে সরকার ও জনগণকে সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে অকাতরে কাজ করতে হবে । সর্বোপরি,পাহাড় ধস,  মানুষের মৃত্যুহানি, জীববৈচিত্র্য এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষা,  হাজারো মানুষের উৎকণ্ঠা নিরসন করতে, দেশের ভূমি অধিদপ্তর,  পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে যৌথভাবে টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনার জন্য  দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নীতি  গ্রহণ করতে হবে।
 
 
আসাদুজ্জামান সম্রাট   
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। 
ক্যাডেট, বিএনসিসি। 

এমএসএম / জামান

বিএনপির ভাবনায় আগামীর শিক্ষা ব্যবস্থা: জ্ঞানভিত্তিক দেশ গড়ার দূরদর্শী রোডম্যাপ

রেলের উন্নয়ন কেবল প্রকল্প নয়, দরকার র্কাযকর ব্যবস্থাপনা

অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতি

টেকসই উন্নয়নে প্রাথমিক শিক্ষা

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি ও বাস্তবতা

গাজায় যুদ্ধের নৃশংসতা ও আন্তর্জাতিক বিচার আদালত

বন্ধ হোক অপসাংবাদিকতা

বিভাজনের রাজনীতি দেশের জন্য হুমকি হতে পারে

প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের স্বপ্নের সৌদি আরব

শারদীয় দুর্গোৎসবে সম্প্রীতির বাংলাদেশ ভাবনা

দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য প্রয়োজন পর্যটন গন্তব্যগুলোর সামগ্রিক উন্নয়ন এবং শক্তিশালী ব্র্যান্ডিং

গণতান্ত্রিক অধিকার ও নতুন নেতৃত্বের অন্বেষণ

দুঃখই সবচেয়ে আপন