একুশে আগস্ট-এর গ্রেনেড হামলার রাজনৈতিক ধারার শেষ কোথায়!

৭৫ -এর ১৫ আগস্টে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে মুশতাকের নেতৃত্বে একটি রাজনৈতিক ধারা সূচিত হয়। এ ধারার ধারকেরা বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারকে সমূলে নির্মূল করার নীলনকশা বাস্তবায়নে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি ও আপামর জনগোষ্ঠীর মনোজগতে আমূল পরিবর্তন আনার প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। এই ধারার সাথে একটি সিভিল মিলিটারি নেক্সাস -এর ফলে বিএনপি নামক একটি রাজনৈতিক বিষবৃক্ষ বাংলার মাটিতে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে রোপিত হয়।
এরাই জনগণকে নানারকম বিভ্রান্তিমূলক তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করে, মিথ্যাচার ও অপপ্রচার করে এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ওপর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নানারকম হত্যা এবং ক্যূ -এর রাজনীতি চালাতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগকে সমূলে নেতৃত্বহীন এবং মেধাশূন্য করতে ২০০৪ সালে একুশে আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় ইতিহাসের পৈশাচিক এবং জঘন্যতম গ্রেনেড হামলা চালানো হয়।
এই হামলার মূল টার্গেট ছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এবং তাঁর দলের উর্ধ্বতন নেতৃবৃন্দ। এদেশের রাজনীতিতে সিরিজ বোমা হামলা, সিলেটে ব্রিটিশ হাই কমিশনারের ওপর নৃশংস হামলা, সাবেক অর্থমন্ত্রী এসএম কিবরিয়ার ওপর বর্বরোচিত হামলা, আহসান উল্লাহ মাস্টারের ওপর হামলা, রমনা বটমূলের সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলা এবং সর্বশেষ একুশে আগস্ট -এর গ্রেনেড হামলা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি মর্মান্তিক ও কলঙ্কজনক ঘটনা। এ ধরনের প্রতিহিংসামূলক রাজনীতি অব্যাহত রাখতে স্বাধীন দেশের আপামর জনসাধারণ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। সকল রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে পুনঃতদন্ত, অধিকতর তদন্ত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা, কলাকৌশলী বিশেষ করে মামলার প্রধান কৌসুলি অ্যাডভোকেট সৈয়দ রেজাউর রহমান -এর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এই মামলায় অন্তত একটি বিচার পেতে আমরা সক্ষম হয়েছি।
যদিও ভুক্তভোগীরা এই রায়ে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। ১৯ জনের ফাঁসি ও ২৩ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলেও আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ নেতাকর্মী ভুক্তভোগীরা মনে করেন হামলার মূল আসামি মাস্টারমাইন্ড বিএনপির তারেক রহমানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে অনুকম্পা দেখানো হয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেড তৎকালীন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় যে জঙ্গিদের হাতে এসেছে তা হামলা-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ পর্যালোচনা করলে সহজেই অনুমেয়। সন্ত্রাসীদের নিরাপদ প্রস্থানে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ, আহতদের সাহায্য-সহযোগিতা না করে উল্টো নেতাকর্মীদের ধরপাকড়, আলামত নষ্ট, আহতদের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিসহ প্রতিটি ঘটনাপ্রবাহ সন্ত্রাসীদের সরকারি মদদের এক ন্যাক্কারজনক দৃষ্টান্ত। শুধু গ্রেনেড হামলাই নয়, দুষ্কৃতিকারীরা সমাবেশে উপস্থিত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর পুলিশের উপস্থিতিতে উপর্যুপরি গুলি চালিয়ে পাশবিক হত্যালীলায় মেতে ওঠে, যা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সুদূরপ্রসারী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডেরই বহিঃপ্রকাশ।
তাছাড়া সরকারের এতগুলো গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই, ডিজিএফআই, সিআইডি, এসবি, ডিবি কারো কাছে কোনো আগাম তথ্য ছিল না— তা বিশ্বাস করেন না সাধারণ মানুষ। এই ঘটনার সাথে শুধু তৎকালীন ক্ষমতাসীন চারদলীয় জোট সরকার জড়িত এমনটি ভাবলে হবে না, পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা খুঁজে বের করার দরকার হয়ে পড়েছে। আদালতের রায়ে আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা খোঁজার ব্যাপারে তেমন কোনো অবজারভেশন দেওয়া হয়নি। যেটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশ এবং রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য নতুনভাবে খতিয়ে দেখার সময় এসেছে। পুরো ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য জর্জ মিয়া নাটক বিএনপির অপরাজনীতি ও অভ্যন্তরীণ দেউলিয়াত্বের একটি বড় প্রমাণ হিসাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে স্পষ্টাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বর্তমানে খালেদা জিয়া কারাবন্দি আছেন। তিনি ঘটনা পূর্ব থেকে জানতেন বলে অনেকে বিশ্বাস করেন। তাই তিনিও কোনোভাবেই এই হত্যা মামলার দায় এড়াতে পারবেন। ফলে তাকেও এই মামলায় বিচারের আসামি করলে একুশে আগস্ট হামলার ঐতিহাসিক রায়টি পরিপূর্ণতা পেত — এটা বিদগ্ধজনের ধারণা। পলাতক আসামি তারেক রহমান লন্ডনে বসে বিবৃতিতে পূর্বনির্ধারিত একুশে আগস্টের জনসভার নির্ধারিত স্থান তাৎক্ষণিকভাবে মুক্তাঙ্গন থেকে কেন ২৩ নং, বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে নেওয়া হয়েছিল—সে বিষয়ে আত্মরক্ষার্থে নিজের দলের নেতাকর্মীদের সামনে প্রশ্ন তুলেছেন এবং এর দায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন।
যদিও আদালতের অবজারভেশনে এই বিষয়টি আলোচিত হয়নি, তবে রাজনৈতিকভাবে এর একটি সদুত্তর থাকা উচিত বলে মনে করি। বিশেষ করে যেকোনো রাজনৈতিক জনসভায় নিরাপত্তার দায়িত্ব রাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তথা পুলিশ প্রশাসনের ওপর থাকে। নিরাপত্তাজনিত কারণে কোনো জনসভা সংঘটিত হওয়া, বা না হওয়া, এটি নির্ভর করে রাষ্ট্রের পুলিশ প্রশাসন কাকে, কোথায় জনসভা করার অনুমতি দিবে তার উপর। এসব বিবেচনায় নিলে তৎকালীন পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তাগণ এ দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না। এটি একটি খোঁড়া যুক্তি এবং অন্তঃসারশূন্য রাজনৈতিক বচন ছাড়া আর কিছুই নয়। সম্ভবত এ কারণেই তারেক রহমানের এ ধরনের বিপরীতধর্মী চিন্তা বা অভিযোগ আদালত বিবেচনায় নেয়নি।
রাজনৈতিক কারণে একুশে আগস্ট -এর গ্রেনেড হামলার রায় এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। বিশেষ করে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের ফাঁসির রায় ঝুলে আছে দীর্ঘদিন ধরে। সামরিক স্বৈরাচারের হাতে ক্যান্টনমেন্ট থেকে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দল বিএনপির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তারেক রহমান লন্ডনে বসে আয়েসি জীবনযাপন করছেন।
একুশে আগস্ট -এর গ্রেনেড হামলার মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত তারেক রহমানকে কূটনৈতিক চ্যানেলে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের আওতায় আনার প্রক্রিয়া এখন পর্যন্ত জাতি কেন নিতে পারেনি, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকার গত এক যুগ ধরে ক্ষমতায় থাকার পরেও এই রায় সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা কেন যায়নি,তার একটি সদুত্তর জাতির সামনে তুলে ধরার এখন সময় এসেছে। তাছাড়া বিএনপির আমলে তারেক রহমানের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে দেশ থেকে যে বিপুল অর্থ পাচার হয়েছে, তারও একটি তালিকা বর্তমান সরকারের প্রকাশ করা উচিত বলে অনেকে মনে করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু কন্যা যে দীর্ঘ এক যুগের বেশি দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক নেতৃত্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন, সেটি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসা কুড়িয়েছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের বিচারসহ যাবতীয় অন্যায় এবং সন্ত্রাসের বিচারে তিনি জিরো টলারেন্স দেখিয়েছেন। প্রতিটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড বিচারের দাবি রাখে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে দেশ স্বাধীন হবার পর তৎকালীন সমাজতন্ত্রীরা বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি এবং তাঁর শাসনকে চ্যালেঞ্জ করে একটি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটাতে চেয়েছিলেন। যেটি পরবর্তীতে দেশের রাজনীতিতে একটি রক্তক্ষয়ী গেরিলা যুদ্ধে পরিণত হয়েছিল। যার খেসারত ৭৫ -এর ১৫ আগস্ট এক হৃদয়বিদারক ঘটনার মধ্য দিয়ে জাতিকে বহন করতে হয়েছিল। আজ সেই রক্তের ঋণ পরিশোধের সময় এসেছে। সেসময় যারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিল, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্ররোচনা দিয়েছিল, তারাও ১৫ আগস্ট এবং একুশে আগস্ট -এর হত্যার প্ররোচনার দোষে সমদোষী। রাজনৈতিক সুবিধার জন্য এ বিষয়টিকে উপেক্ষা করা বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কোনোক্রমেই উচিত হবে না।
আজ সময় এসেছে, ৭১ পরবর্তী রাজনৈতিক যে হত্যাকাণ্ডগুলো সংঘটিত হয়েছে এবং যারা জড়িত ছিলেন তাদের সকলকে অসমাপ্ত বিচারের মুখোমুখি করা। যাতে বাঙালি জাতি হত্যা ও ক্যূ-এর রাজনীতি থেকে চিরতরে সরে গিয়ে গণতন্ত্রের ধারায় ফিরে আসে। একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলায় নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে তৎকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ, জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনান এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দসহ অসংখ্য আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব নিন্দা জানিয়েছেন এবং ন্যায়বিচারের দাবি জানিয়েছেন। তবে এই পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের পেছনে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের যারা আজও নেপথ্যে থেকে বিভিন্ন রকম সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়, তাদের ব্যাপারে সরকারের আরো কঠোর নীতি অবলম্বন করা উচিত বলে আমি মনে করি।
একুশে আগস্ট-এর গ্রেনেড হামলার মতো বা ১৫আগস্ট -এর পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের অনুরূপ কোনো দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি বাঙালি জাতি আর দেখতে চায় না। হত্যা ও ক্যূ -এর ঘৃণ্য রাজনীতির সলিল সমাধি করে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে এসে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবায়ন হোক এবং বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার উন্নয়নের রাজনীতি চিরবহমান থাকুক, এটাই হোক আগামীদিনের দেশপ্রেমিক জাতির একমাত্র প্রত্যাশা।
লেখকঃ ফিকামলি তত্ত্বের জনক, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, ওয়াইল্ড লাইভ বিশেষজ্ঞ, প্রেসিডেন্ট: ওয়ার্ল্ড ফুটবলার্স ফোরাম(WFFB), প্রধান পৃষ্ঠপোষক: বাংলাদেশ মনোবিজ্ঞান সমিতি, সভাপতি: শহিদ সেলিম-দেলোয়ার স্মৃতি পরিষদ।
এমএসএম / এমএসএম

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার গণতন্ত্রের জন্য চ্যালেঞ্জ

কোচিং-এর গোলকধাঁধায়, শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে গুরুত্ব নেই

সাংবাদিকের দল সমর্থন গণতন্ত্রের জন্য হুমকি

ইঁদুরের কৃতজ্ঞতা

নাগরিক সেবা ও প্রত্যাশার সংকট: রাষ্ট্রীয় কর্মচারী কোথায়?

টেকসই সমাজ গঠনে সাম্য একটি অপরিহার্য ভিত্তি

শুভ জন্মাষ্টমী : সত্য, সুন্দর ও সাম্য প্রতিষ্ঠায় শান্তির বার্তা

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অপরিহার্য

জনগণের অংশগ্রহণে নির্বাচিতরাই কাশ্মীরের শাসক

স্বৈরশাসকের বিদায়, বিদ্রোহ ও পলায়ন

জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় তারেক রহমান

এপিআই ও এক্সিপিয়েন্ট উৎপাদনে বাংলাদেশের আত্মনির্ভরশীলতা: স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির নবদিগন্ত উন্মোচন
