নীরব ঘাতক ‘ডিপ্রেশন’

বর্তমানে অতি পরিচিত একটি শব্দ ‘ডিপ্রেশন’। এর বাংলা অর্থ বিষণ্ণতা, মানসিক অবসাদ। ছোট্ট এই শব্দটাই তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে একাধিক প্রাণ। ছোট্ট এই শব্দটার মধ্যে কত শক্তিই না রয়েছে যা মানুষের প্রাণ নিয়ে নিচ্ছে নিঃশব্দেই। আমরা মনের সমস্যায় ভোগী; কিন্তু এর সমাধানে এগিয়ে আসি না।
বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী অ্যারন বেকের তত্ত্ব অনুযায়ী, ‘নিজের, পরিবেশের ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার সম্মিলিত প্রকাশ হলো মানসিক অবসাদ বা ডিপ্রেশন’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ‘সারাক্ষণ মনের মধ্যে একটা দুঃখের ভাব, সাধারণত যেসব কাজ করতে আপনি ভালোবাসতেন তাতেও উৎসাহ হারিয়ে ফেলা, রোজের রুটিন মেনে চলার অক্ষমতা, এগুলো যদি দু’সপ্তাহ বা তার বেশি স্থায়ী হয়’, তবে আপনি অবসাদগ্রস্ত। এটি এক ধরনের মানসিক রোগ, যা আমাদের স্বাভাবিক কাজকর্মকে বাধাগ্রস্ত করে। রোগ জটিল আকার ধারণ করলে রোগীর মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখা দিতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে বিশ্বে এ রোগ ভয়াবহ আকারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন মানুষ ডিপ্রেশনে ভোগছে।
আমাদের শরীরের এ রক্ত মাংসের কাঠামো ছাড়াও আরেকটি প্রধান অংশ রয়েছে আমাদের মন। শারীরিক রোগের চেয়েও এই মনের রোগ অর্থাৎ মানসিক রোগ আরো জটিল। শরীরের মতো মনের রোগেরও চিকিৎসা দরকার। শারীরিক রোগ নিরাময়ে আমরা সবাই তৎপর হলেও মানসিক সমস্যার ক্ষেত্রে তার বিপরীত। মনে যে রোগ হতে পারে, এতে যেন কেউ বিশ্বাসীই নয়। ফলে অধিকাংশ মানুষ নিজেকে ঠেলে দেয়, মানসিক ব্যাধির দিকে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ডিপ্রেশন। এটি আমাদের শরীরে ও মনে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। যে কোনো বয়সেই ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। মেয়েদের এ রোগে ভোগার প্রবণতা পুরুষের চেয়ে দ্বিগুণ। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১৮ থেকে ৪৪ বছরের মধ্যে সাধারণত এ রোগ বেশি হয়। গবেষক ও চিকিৎসকরা মনে করেন সাধারণভাবে প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন তার জীবদ্দশায় কখনো না কখনো ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হয়ে থাকেন বা হতে পারেন।
ডোপামিন, এন্ডোরফিন, সেরোটোনিন, অক্সিটোসিন নামক হরমোনের অভাবের কারনে ডিপ্রেশন হতে পারে। মাদক গ্রহণ, শৈশবের কোনো ট্রমা, জেনেটিক সমস্যা, জীবনচক্রের পরিবর্তন, অতিরিক্ত চাপ, নেতিবাচক চিন্তা, পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কের অবনতি, বেকারত্ব, দারিদ্র্য, একাকিত্ব, গর্ভকালীন ও প্রসবপরবর্তী সময়, বিবাহবিচ্ছেদ, প্রিয়জনের মৃত্যু, অবহেলা, অপমান, উদ্দেশ্য ও আনন্দহীন অনিশ্চিত জীবনযাপন, শারীরিক অপূর্ণতা, কোনো মারাত্মক অসুখ, ওষুধের প্রভাব ইত্যাদি কারণে ডিপ্রেশন হতে পারে।
ডিপ্রেশনে আক্রান্ত ব্যক্তিদের কিছু উপসর্গ দেখা যায়। যেমন- কোনো কাজ করার উৎসাহ বা মনোযোগ হারিয়ে ফেলা, ঘুমের সমস্যা দেখা দেয়া বা সারা দিন তদ্রাচ্ছন্ন থাকা, খাবারে অরুচি তৈরি হওয়া বা রুচি বেড়ে যাওয়া, শরীরের ওজন বেড়ে বা কমে যাওয়া, ক্লান্ত ভাব বা শক্তিহীনতা অনুভব করা, নিজেকে মূল্যহীন বা দোষী মনে করা, সিদ্ধান্তহীনতা বা মনোযোগ কমে যাওয়া, আত্মহত্যা করার প্রবণতা, হতাশার প্রবণতা। বিভিন্ন শারীরিক উপসর্গ দেখা দেয়া, যেমন- হাত-পা জ্বালা করা, কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হওয়ার অনুভূতি, ভীষণ মাথা ধরা, কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর দেয়া গাইডলাইন অনুযায়ী ডিপ্রেশনকে যে ক’টি বিষয় দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলো হলো : দুঃখ, আগ্রহ বা আনন্দ হারিয়ে ফেলা, অপরাধবোধ, নিজেকে মূল্যহীন লাগা, ঘুম ও ক্ষুধায় বিরক্তি, ক্লান্তি, দুর্বল মনোযোগ।
ডিপ্রেশনের সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো জীবনের প্রতি আগ্রহ কমে যাওয়া। নিজের ক্ষতি করার প্রবণতা তৈরি হওয়া। মনে হয় অনেক কিছু পাওয়ার ছিল, করার ছিল, হলো না। অতএব, এই জীবনটা অর্থহীন। এটাকে বয়ে নিয়ে যেতে হবে; কিন্তু আর কত দিন? ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে গিয়ে অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। গত ১০ মে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাদিয়া আত্মহত্যা করে একটি চিরকুট রেখে যায়। চিরকুটে সাদিয়া লেখেন, ‘চোরাবালির মতো ডিপ্রেশন, বেড়েই যাচ্ছে, মুক্তির পথ নেই, গ্রাস করে নিচ্ছে জীবন, মেনে নিতে পারছি না।’ আত্মহত্যা হলো মানসিক ব্যাধি যা ডিপ্রেশন থেকে জন্ম নেয়।
ডিপ্রেশনের শেষ অবস্থায় পৌঁছালেই আত্মহত্যা করতে প্ররোচিত হয়। এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে বিশ্বের ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সি তরুণ-তরুণীদের আত্মহত্যার প্রধান কারণ এ ডিপ্রেশন। বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৮ লাখ পুরুষ ও মহিলা আত্মহত্যা করেন যা যে কোনো যুদ্ধে নিহতের চেয়েও বেশি। অর্থাৎ প্রতি ৪০ সেকেন্ডে ১ জন নারী বা পুরুষ আত্মহত্যা করছেন। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট-এর মতে, ডিপ্রেশন যে শুধু মনের ক্ষতি করবে তা কিন্তু নয়, এর সঙ্গে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হার্টের সমস্যা, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, মৃগী রোগ, পেটের সমস্যা, আলসার এর মতো রোগের প্রবণতা বেড়ে যায়। এটি মানুষকে তিলে তিলে শেষ করে দেয়। মনোচিকিৎসকরা বলছেন, ডিপ্রেশনে আক্রান্তদের ১৫ শতাংশের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি হয়ে থাকে। বাংলাদেশের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে ঢাকা পরিচালিত একটি জরিপে দেখা গেছে, শিশু-কিশোরদের ১৮ শতাংশের বেশি ডিপ্রেশনে আক্রান্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ধারণা ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে বড় সংকটের তৈরি করতে যাচ্ছে এই ডিপ্রেশন।
ডিপ্রেশন একটি চিকিৎসাযোগ্য রোগ। রোগের তীব্রতা ভেদে ওষুধ অথবা সাইকোথেরাপি (ধারণা ও আচরণ পরিবর্তনের চিকিৎসা) বা একই সঙ্গে উভয় পদ্ধতিতেই চিকিৎসা নিয়ে এ রোগ নিরাময় করা সম্ভব। ডিপ্রেশন কেন হচ্ছে, যদি বোঝা যায়, তাহলে যেমন মেডিটেশন তেমনি ভালো ডাক্তারের সুপরামর্শ তাড়াতাড়ি সেরে উঠতে সাহায্য করে। ডিপ্রেশন থেকে দূরে থাকার জন্য কিছু বিষয় আমাদের জানা প্রয়োজন। যেমন, ইতিবাচক চিন্তা করতে হবে, নিজেকে সময় দিতে হবে, ব্যায়াম করতে হবে অথবা নির্দিষ্ট সময় করে হাঁটতে হবে, পর্যাপ্ত ঘুমাতে হবে, সঠিক খাদ্যাভাসের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে, সামাজিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়িত রাখতে হবে, নিজের যত্ন নিতে হবে, পরিবারকে সময় দিতে হবে, আনন্দের উৎস খুঁজতে হবে। যেমন- নতুন কিছু করার চেষ্টা করা, বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা। ধর্মীয় আনুগত্য ও স্রষ্টার উপাসনা অনেকটাই প্রশান্তি দেয় ও মনকে হালকা রাখে। পর্নোগ্রাফি, হস্তমিথুন ও মাদকাসক্তি থেকে দূরে থাকতে হবে। এতে হরমোনাল ও ডাইজেস্টিভ ক্রিয়া স্বাভাবিক থাকবে, যা মানসিক ও শারীরিক অবস্থার উন্নতি করবে।
ডিপ্রেশনের রোগীরা সবার অগোচরে আত্মহত্যা করে বসেন। তাই তাদের সঙ্গে মিশুন, প্রাণ খুলে কথা বলুন, সময় দিন এবং বিশেষজ্ঞের সেবা নিতে উৎসাহিত করুন। শরীরের অসুখ সারাতে যেমন চিকিৎসা করা জরুরি, তেমনই মনের অসুখের ক্ষেত্রেও তা দরকার। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করলে এ রোগ কাটিয়ে সন্ধান পাওয়া যাবে নতুন জীবনের।
লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
এমএসএম / এমএসএম

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার গণতন্ত্রের জন্য চ্যালেঞ্জ

কোচিং-এর গোলকধাঁধায়, শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে গুরুত্ব নেই

সাংবাদিকের দল সমর্থন গণতন্ত্রের জন্য হুমকি

ইঁদুরের কৃতজ্ঞতা

নাগরিক সেবা ও প্রত্যাশার সংকট: রাষ্ট্রীয় কর্মচারী কোথায়?

টেকসই সমাজ গঠনে সাম্য একটি অপরিহার্য ভিত্তি

শুভ জন্মাষ্টমী : সত্য, সুন্দর ও সাম্য প্রতিষ্ঠায় শান্তির বার্তা

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অপরিহার্য

জনগণের অংশগ্রহণে নির্বাচিতরাই কাশ্মীরের শাসক

স্বৈরশাসকের বিদায়, বিদ্রোহ ও পলায়ন

জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় তারেক রহমান

এপিআই ও এক্সিপিয়েন্ট উৎপাদনে বাংলাদেশের আত্মনির্ভরশীলতা: স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির নবদিগন্ত উন্মোচন

ট্রাম্প-উরসুলার বাণিজ্য চুক্তিতে স্বস্তির হাওয়া
Link Copied