বঙ্গবন্ধুর শৈশব ও পূণ্যভূমি টুঙ্গিপাড়া

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা এক ও অভিন্ন সূত্রে গাঁথা। সূর্যের আলো বাদ দিয়ে যেমন দিনকে আশা করা বৃথা তেমনি বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা কল্পনা করাও অসম্ভব।সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী ,বাংলার রাখাল রাজা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান শুধুমাত্র স্বাধীনতাকামী বাঙ্গালির প্রধান পথ প্রর্দশকই ছিলেন না। তিনি ছিলেন একটি শ্বাসত সংগ্রাম,একটি র্দুবার আন্দোলন।
মুজিব মানে একটি কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা। মুজিব মানে স্বাধীনতার মহাকাব্য। বঙ্গবন্ধু মানে একটি জীবন্ত ইতিহাস,একটি লাল-সবুজের পতাকা,একটি নতুন মানচিত্র, মুজিব মানে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। মুজিব মানে বিশ্ব মঞ্চে একটি সুদৃঢ় আদর্শ। যে আদর্শের ছায়াতলে তৎকালীন পূর্বপাকিস্থানের লাখ জনতা আশ্রয় নিয়েছিল একই মঞ্চে। স্বাধীনতার উন্মাদনায় বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে সেদিন লাখ জনতা মিলিত হয়েছিল জয়ের নেশায়, বিশ্ব মানচিত্রে একটি নতুন মানচিত্র সংযোজন করতে, একটি লাল-সবুজের পতাকার জন্য ছিল সে লড়াই। এই জন্য প্রায় ৯ মাস রক্তক্ষীয় সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে ৩০ লক্ষ বাঙালির তাজা প্রাণ এবং ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বিশ্ব মানচিত্রে খচিত হল এক নতুন অধ্যায়, যার নাম স্বাধীন বাংলাদেশ।
স্বাধীনতা নামক মহাকাব্য যার মূল ভুমিকায় ছিলেন শতাব্দীর মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহন করেন ১৯২০ সালের ১৭ ই মার্চ দিনটি ছিল মঙ্গলবার রাত ৮ টায়। তদানীন্তন ভারত উপমহাদেশের বঙ্গ প্রদেশের অর্šÍভুক্ত ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার পাটগাতি ইউনিয়নের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। বঙ্গবন্ধুর জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়া সম্পর্কে অনিন্দ্য সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায় তাঁর সুযোগ্য কন্যা দেশরন্ত শেখ হাসিনা রচিত “শেখ মুজিব আমার পিতা” প্রবন্ধে উল্লেখ আছে-বাইগার নদীর তীর ঘেঁষে ছবির মতো সাজানো সুন্দর একটি গ্রাম। সে গ্রামের নাম টুঙ্গিপাড়া। বাইগার নদী এঁকে বেঁকে গিয়ে মিশেছে মধুমতি নদীতে। এই মধুমতি নদীর অসংখ্যা শাখানদীর একটি এই বাইগার। দু-পাশে তাল, তমাল, হিজল গাছের সবুজ সমারোহ। ভাটিয়ালী গানের সুর ভেসে আসে হালধরা মাঝির কন্ঠ থেকে। পাখির গান আর নদীর কলকল ধ্বনীতে এক অপূর্ব মনোরম পরিবেশ গড়ে তোলে। প্রায় দুইশ বছর আগে ইসলাম ধর্ম প্রচারের দায়িত্ব নিয়েই আমাদের পূর্ব পুরুষ শেখ আউয়াল টুঙ্গিপাড়ায় এসে এই নদীবিধৌত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সুষমামন্ডিত ছোট্ট গ্রামটিতে তাদের বসতি গড়ে তোলেন। বঙ্গবন্ধুর পূর্ব পুরুষগণ হলেন শেখ আউয়ালের পুত্র শেখ জহির উদ্দিন তাঁর পুত্র শেখ জান মাহমুদ। শেখ জান মাহমুদের পুত্র শেখ বোরহান উদ্দীন তাঁর পুত্র শেখ কুদরত উল্লাহ কদু।শেখ কুদরত উল্লাহ কদু’র পুত্র শেখ আব্দুল হামিদ ছিলেন বঙ্গবন্ধুর পিতামহ এবং পিতার নাম-শেখ লুৎফর রহমান। এই ঐতিহ্যবাহী, সমভ্রান্ত শেখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন বাঙ্গালি জাতির অহংকার, মুক্তির দেবদূত, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। চার বোন আর দুই ভাইয়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধু ছিলেন মা-বাবা তৃতীয় সন্তান। নানা শেখ আব্দুল মজিদ তাঁর নাতির নাম রাখেন শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু পিতা শেখ লুৎফর রহমান এবং মাতা সায়েরা খাতুন আদর করে বঙ্গবন্ধুকে ‘খোকা’ বলে ডাকতেন ।
মা-বাবার আদরের খোকা জীবন সংগ্রাম ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন পরিণত। একজন দক্ষ সংগঠক, মহান নেতা। শেখ মুজিব তার অসীম সাহস, বাগ্মিতা ও দুরদর্শীতা দিয়ে ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্ববন্ধু । বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের গুনাবলী অনেক ছোট বয়স থেকে পরিলক্ষিত হলেও তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুভ সুচনা হয়েছিল১৯৩৮ সালের ১৫ ই জানুয়ারি। সেদিন স্কুল পরির্দশনে আসেন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ, কে ফজলু হক ও তাঁর বানিজ্য ও পল্লি উন্নয়ন মন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পরবর্তীতে যার রাজনৈতিক আর্দশ বঙ্গবন্ধুকে অনেক বেশি অনুপ্রাণিত করে। সেদিন স্কুলের ছাদ সংস্করের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে একটি দল নিয়ে বঙ্গবন্ধু অত্যান্ত দক্ষতার সহিত দাবি আদায়ে সফল হন। যার রোষানলে পড়ে মাত্র ১৮ বছর বয়সে ৭দিনের জন্য প্রথম কারাবরণ করতে হয়েছিল। এটাই ছিল বঙ্গবন্ধরু জীবনের প্রথম কারাবরণ। প্রথম কারাবরণের অভিজ্ঞতা বর্ননা করতে গিয়ে তিনি বলেন আমার যেদিন প্রথম জেল হয় সেদিন থেকেই আমার নাবালকত্ব ঘুচেছে । তার পর থেকে একের পর এক কারাবরণ তার রাজনৈতিক জীবনে এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিনত হয়। এবং নেলসন ম্যান্ডেলার পরে বঙ্গবন্ধু একমাত্র রাজনীতিবীদ যিনি সর্বোচ্চ কারাবরণ করেন। বঙ্গবন্ধু সন্তানেরা ছিল বাবার স্নেহবঞ্চিত। যে বয়সে একটি শিশু বাবার হাত ধরে স্কুলে যাওয়ার কথা সে বয়সে আমাদের আজকের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কণ্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা বাবাকে দেখতে জেলে যেত মায়ের হাত ধরে। কতইনা হৃদয় বিদারক ছিল সেই করুন চিত্র, সময় এবং দিনগুলো! একটি অবুঝ শিশুর যে বয়সে বাবার কোলে বসে খেলাধুলা করার কথা ঠিক সেই বয়সে জেলগেটে বাবাকে বিদায় জানিয়ে বুকে পাথর চাপা ব্যাথ্যা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসা যে কত বড় যন্ত্রনার তা কেবল তারাই বুঝতেন।
বঙ্গবন্ধুর শৈশব সম্পর্কে তাঁর যোগ্য কণ্যা শেখ হাসিনা রচিত ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ প্রবন্ধে লিখেছেন -“আমার বাবার শৈশব কেটেছিল টুঙ্গিপাড়ার নদীর পানিতে ঝাঁপ দিয়ে। মেঠো পথের ধুলোবালি মেখে। বর্ষার কাদা পানিতে ভিজে”। পল্লী প্রকৃতির প্রতি শেখ মুজিবের ছিল অপরিসীম আর্কষণ। এজন্য তিনি শৈশবে গ্রামের অন্য ছেলেদেরে সাথে মিশে টুঙ্গিপাড়ার মাঠে-ঘাঠে ঘুরে বেড়াতেন, মাছরাঙ্গা পাখির মাছ ধরা দেখতেন, বিভিন্ন পাখির সুমধুর সুর ছোট্ট মুজিবকে খুব বেশি আর্কষন করত। শেখ মুজিব শৈশবে ময়না পাখির ছানা, শালিক পাখির ছানা ধরে তাদের কথা বলা শেখাতেন। কে জানত এই বিশ্ময় বালক একদিন এ জাতির মুক্তির মহানায়ক হবে। শেখ মুজিবের পিতৃালয়ের দক্ষিন-পশ্চিম দিক ঘেঁষে একটি সরুখাল। এই খাল পাড়েই ছিল বড় কাছারিঘর। এই কাছারিঘরের পাশে গৃহ শিক্ষকদের থাকায় ঘর ছিল। শৈশবে বঙ্গবন্ধুর গৃহ শিক্ষক ছিলেন পন্ডিত সাখাওয়াত উল্লাহ। শেখ মুজিব গৃহ শিক্ষকদের কাছে বাংলা, আরবি, অংক, ইংরেজী ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান লাভ করেছিলেন। শেখ মুজিব ১৯৭২ সালে গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়াশুনা শুরু করে ৩য় শ্রেণি পর্যন্ত এই বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন। তিনি গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং ৭ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন।১৯৩৪ সালে ৭ম শ্রেণিতে অধ্যয়রনত অবস্থার বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হন এজন্য পড়ালেখার কিছুটা ক্ষতি হয়। দু’বছর পর তিনি ১৯৩৬ সালে আবারও ৭ম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এ সময় তার চোখে গ্লুকোমা নামক রোগ হলে আবারও লেখা পড়ার ক্ষতি হয় এবং জীবন সংগ্রামে জয়ী এ মানুষটি ২২ বছর বয়সে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। সুজলা সফলা, শষ্য-শ্যামলা ছবিরমত এ পণ্যভুমি, টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেওয়া শতাব্দীর মহানায়ক, বাঙলী জাতির অবিসংবাদিত নেতা,বাঙালী জাতির মুক্তির দূত যার তেজদীপ্ত তর্জনী এদেশের লাখ লাখ জনতাকে একত্রিত করেছিল, যে মহান নেতার ভাষন বাঙালীর কোটি প্রাণে আশার সঞ্চার করত সেই বঙ্গবন্ধু তথা বিশ্ব বন্ধু শেখ মুজিব গোপালগঞ্জে সর্বশেষ এসেছিল ১৯৭৫ সালের ১৬ আগষ্ট নিরব, নিষ্প্রাণ দেহে। যার বাগ্মিতার স্বৈরশাসকদের হৃদ কম্পন শুরু হত আজ সেই মহা মানব শুয়ে আছে নিষ্প্রাণ দেহে, নবজাতক শিশুর মত মাতৃসমতুল্য পুণ্য ভুমি টুঙ্গিপড়ার পবিত্র মাটিতে। মুলত ১৯৭৫ সালে ১৫ ই আগষ্ট বঙ্গবন্ধুকে শুধু হত্যা করা হয়নি, সেদিন হত্য করা হয়েছিল বিশ্বের শোষিত জনগনের অকৃতিম বন্ধুকে, সেদিনের এই হত্যাকান্ডের মধ্যে দিয়ে ছিঁড়ে ফেলা হয় লাল-সবুজের পতাকাকে। ফিদেল কাস্ট্রো সেদিন বলেছিলেন-“শেখ মুজিবের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারাল তাদের একজন মহান নেতাকে”। যে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে সেদিন দেশের মানুষ বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে দেশকে স¦াধীন করেছিলেন। আর সেই স্বাধীন বাংলাদেশে নিজের ও তাঁর পরিবারে তাজা রক্ত দিয়ে সেই স্বাধীনতার ইতিহাসকে করুন মহাকাব্যে পরিনত করে গেল মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
স্বাধীনতার মহাকবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চিরনিদ্রায় শায়িত তাঁর মাতৃসমতুল্য জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়ার পূণ্যভূমিতে। এখানে প্রতিদিন অসংখ্যা মানুষ আসে তাদের মহান নেতাকে দেখতে। প্রিয় মানুষটির মাজার জিয়ারতে স্মৃতির আঙ্গিনায় ফিরে পায় প্রিয় নেতার সান্নিধ্য। সেখানে গেলে আজও মনে পড়ে জাতির জনকের সেই তেজদ্বীপ্ত তর্জনীয় অমোঘ নির্দেশনা-
“এবারের সংগ্রাম
আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম
আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
লেখকঃ মোঃ বাবলুর রহমান
প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ, বড়দল আফতাব উদ্দীন কলেজিয়েট স্কুল ।
এমএসএম / এমএসএম

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার গণতন্ত্রের জন্য চ্যালেঞ্জ

কোচিং-এর গোলকধাঁধায়, শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে গুরুত্ব নেই

সাংবাদিকের দল সমর্থন গণতন্ত্রের জন্য হুমকি

ইঁদুরের কৃতজ্ঞতা

নাগরিক সেবা ও প্রত্যাশার সংকট: রাষ্ট্রীয় কর্মচারী কোথায়?

টেকসই সমাজ গঠনে সাম্য একটি অপরিহার্য ভিত্তি

শুভ জন্মাষ্টমী : সত্য, সুন্দর ও সাম্য প্রতিষ্ঠায় শান্তির বার্তা

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অপরিহার্য

জনগণের অংশগ্রহণে নির্বাচিতরাই কাশ্মীরের শাসক

স্বৈরশাসকের বিদায়, বিদ্রোহ ও পলায়ন

জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় তারেক রহমান

এপিআই ও এক্সিপিয়েন্ট উৎপাদনে বাংলাদেশের আত্মনির্ভরশীলতা: স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির নবদিগন্ত উন্মোচন
